Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ইহজন্মে নয়, কিন্তু যদি পরজন্ম থাকে...

বঙ্কিমের লেখার এই লাইন এখনও তাঁর বুকের ভেতর মোচড় দেয়। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়-এর সাক্ষাত্‌কার নিলেন স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়।হাফ শার্ট আর লুঙ্গি পরে রোজ বাজার যান, আবার সাহিত্যের নিমন্ত্রণে যান আমেরিকায়। এই দুই ধারাকে মেলান কেমন করে? মেলানোর দরকার পড়েনি কখনও। ছেলেবেলা থেকেই নিজের অস্তিত্বকে ঘিরে একটা অদ্ভুত বিষণ্ণতা আমায় তাড়া করে বেড়ায়। সেই আবেশঘন বিষাদ আমার ওপর এমনই ভর করে আছে যে, আমি লিখি বা আমি বিখ্যাত লেখক এ সব মাথায় কখনওই আসে না।

ছবি: কৌশিক সরকার।

ছবি: কৌশিক সরকার।

শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

হাফ শার্ট আর লুঙ্গি পরে রোজ বাজার যান, আবার সাহিত্যের নিমন্ত্রণে যান আমেরিকায়। এই দুই ধারাকে মেলান কেমন করে?

মেলানোর দরকার পড়েনি কখনও। ছেলেবেলা থেকেই নিজের অস্তিত্বকে ঘিরে একটা অদ্ভুত বিষণ্ণতা আমায় তাড়া করে বেড়ায়। সেই আবেশঘন বিষাদ আমার ওপর এমনই ভর করে আছে যে, আমি লিখি বা আমি বিখ্যাত লেখক এ সব মাথায় কখনওই আসে না।

লেখক হিসেবে স্বীকৃতি, সম্মান, গোছানো সংসার এত কিছু পেয়েও এত বিষাদের মেঘ কেন?

দু’কোটি টাকা জমল নাএমন জাগতিক বিষাদ নেই আমার। কিন্তু আমি কোথা থেকে এলাম? কোথায় যাব? মহাবিশ্বের সঙ্গে আমার যোগটাই বা কী? এই প্রশ্ন তাড়া করে আমায়। দর্শনের কাছে গেলে দর্শন আরও গুলিয়ে দেয়। বিজ্ঞান তো গুটি গুটি পায়ে এগোচ্ছে, তার কাছেও আমার অস্তিত্বের খবর নেই।

সেই খবর জানতেই কি অধ্যাত্মবাদের রাস্তা নিয়েছিলেন?

ঠাকুরই আমার মেলাঙ্কলি দূর করেছিলেন। তাঁর কাছে গিয়েই আমার জীবনের যে পরিণতি, আমার জন্য অপেক্ষা করেছিল তা সম্পূর্ণ বদলে যায়। ওঁর পজিটিভ ফোর্সই আমার জীবনের সমস্ত পাওয়াকে আমার সামনে এনে দিয়েছে।

চলতি পথের সঙ্গে অধ্যাত্মবাদ কেমন করে মেলে?

আত্মাকে অধিকার করে যা কিছু আছে, সেটাই তো আধ্যাত্মিকতা। নিজেকে জানাটাই আধ্যাত্মিকতা। লোকে এটা বুঝতে পারে না। ঠাকুর বলছেন সংসারে সন্ন্যাসী চাই।

সংসারে সন্ন্যাসী হতে গিয়েই কি আপনি প্রেম, কাম, সম্পর্ক নিয়ে নীরব?

তা কেন? কাম, মোহ, লোভ এই যে দেওয়া হয়েছে, তার কারণ পৃথিবীকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এর প্রত্যেকটারই প্রয়োজন আছে। কিন্তু আজকের দিনে আর ভালবাসা নেই।

সে কী! এমন কেন মনে হচ্ছে?

ভালতে বাস কেউ করে না আর। অগভীর ভালবাসা ভাগ হয়ে যাচ্ছে, পাত্র বদলে যাচ্ছে।

ভালবাসা তো অনেকই হবে। একজনকেই কি শুধু ভালবাসা যায়?

আরণ্যক জীবনে বিবাহ ছিল না। কিন্তু নিরাপত্তার জন্যই সংসারের বাঁধন। সংসার ঘিরে আমরা যা সৃষ্টি করছি সেটাই তো ভালবাসা। আমি বাড়ি ফিরে যদি দেখি আমার স্ত্রী পালিয়ে গেছে, অন্য কাউকে বিয়ে করার জন্য, তখন প্রথমেই তো আমার বিশ্বাসটা চলে যায়। এখন অহং-এর লড়াই। নারী-পুরুষ কেউ কারওর কাছে নিজেকে সমর্পণ করবে না। এখন স্বামীরা অফিস থেকে ফিরে স্ত্রীর কাছে নাকি এক গ্লাস জল চাইতেও পারে না।

আপনার এই ধারণা একটু সেকেলে নয়? ‘গয়নার বাক্স’তে সোমলতা তার স্বামীকে বলছে ‘আপনি অন্য নারীর প্রতি আকৃষ্ট হলে সেটা আমাকে জানিয়ে করুন।’ এটা আপনার গল্পে কোনও পুরুষ চরিত্রকে দিয়ে আপনি বলাতে পারবেন?

অবশ্যই পারব। এখানে আনুগত্যের কথা বলতে চাইছি আমি। আনুগত্য মানে কিন্তু পরাধীনতা নয়, বিশ্বস্ততা। সম্পর্কের ভেতর কোনও আবছায়া রাখতে চাই না। যৌবনে মানুষ যাই করুক তার পরের যে মোহনামুখী জীবন, সেখানে মানুষ ভাবতে বসে কী পেলাম আর কী পেলাম না। সেখানে বিশ্বস্ততা না থাকলে, আশ্রয় না থাকলে মানুষ কী নিয়ে বাঁচবে?

নারীর পূর্ণতা মানে কি মাতৃত্ব?

একটি মেয়ে ভাবতেই পারে সে মা হবে না। কিন্তু প্রকৃতি কি সেটা ভাবে? সমস্যাটা সেইখানেই। জীবনানন্দ দাশ বনলতা সেনের মধ্যে আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিলেন বলেই ‘পাখির নীড়ের’ শব্দটা ব্যবহার করেছিলেন। নীড় তো আশ্রয়েরই প্রতীক।

‘অসুখের পর’ উপন্যাসে আপনি নায়কের দুই বিবাহকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। আপনি কি বহুবিবাহ সমর্থন করেন?

মানুষ মাত্রেই বহুগামী। আগেকার দিনে সেরকম বাপের বেটা ছিল বলেই অনেকগুলো বিয়ে করত। এখন লুকিয়ে লুকিয়ে মানুষ বিয়ে ছাড়া সবই করে। আর ডিভোর্স? ওটা তো রিজেকশন অফ উইমেন। সেটা আরও খারাপ। আমার দেখা অনেক লেখক আছেন বিতর্ক সভায় বহুবিবাহর বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিয়ে নিজেরা গোপনে চার-পাঁচটা সম্পর্ক রাখছেন।

আপনার আশ্রয় কি পেয়েছেন আপনি?

আশ্রয়ের জন্যই আমি খুব ঘরমুখো। মায়ের গায়ের গন্ধ নিয়েই আমার বড় হওয়া। তার পরে তো বিয়ে হল। ধীরে ধীরে আমার গৃহ রচনা হল। আমি আমার স্ত্রী দু’জনে সিনেমা দেখতে যাওয়ার চেয়ে বাড়িতে, সন্তানদের সঙ্গে সময় কাটাতে ভালবাসতাম।

আপনার স্ত্রী সোনামন মুখোপাধ্যায়কে বলতে শুনেছি, আপনি স্বামীর চেয়ে লেখক হিসেবে আধুনিক এটা কি ঠিক?

হ্যাঁ, ঠিক। আমি শক্তি বা সুনীলের মতো ফসফস করে কোথাও চলে গেলাম। প্রচুর মদ্যপান করলাম। এমনটা ছিলাম না।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদারের মতো লেখকরা আপনার চারপাশে থাকতেন। কখনও গোষ্ঠীকোন্দল বা ঈর্ষার সম্মুখীন হননি?

আমাদের সময় এটা একদম ছিল না। সুনীল আমার ভাল লেখা পড়ে ভাল বলার জন্য মুখিয়ে থাকতেন। আমিও তাই। সমালোচনা করতে চাইলেও করতাম। সুনীলকে আমিই একমাত্র শাসন করতাম। পঁচাত্তরের জন্মদিনে দেখেছিলাম ওঁর পা কাঁপছে। বললাম, সুনীল, আপনাকে বাংলা সাহিত্যের জন্য অনেক দিন বাঁচতে হবে। তার জন্য যা যা নিয়ম মানার আপনি এবার সেটা করুন। কোথায় আর শুনলেন?

আর শক্তি চট্টোপাধ্যায়?

সুনীলের দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষমতা ছিল অপরিসীম। শক্তিকে ধরাই যেত না।

‘ঘুণপোকা’ প্রথম দিকে লোকে পড়েনি। আজ যদিও তা বেস্ট সেলার। দেশ পত্রিকায় আপনার উপন্যাস নিয়েও একবার কড়া সমালোচনা হয়েছিল। খারাপ লাগে না পাঠক আপনার লেখা না পড়লে? ভাল না বললে?

পাঠকের ভাল কি খারাপ লাগবে সেই ভেবে কখনও তো লিখিনি।

কিন্তু লেখাই যেখানে জীবিকা সেখানেও কোনও বাড়তি চাপ ছিল না?

লেখা শেষ করার চাপ তো থাকেই। তবে সাহিত্য এমনই একটা বিষয় কোনও প্রতিষ্ঠান, মিডিয়া দিয়ে তার বিচার হয় না।

মিডিয়া কোনও সাহিত্যিককে খ্যাতি এনে দিতে পারে না। বিমল কর বলতেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় লেখকই নন। কাউকে আবার বলতে শুনেছি ‘আরণ্যক’ সাহিত্য কোথায়? ওটা তো বোটানির লেকচার। তা হলে আমি সমালোচনা শুনব না কেন?

আপনার গল্প বা উপন্যাস আদৌ কি চলচ্চিত্রের উপযোগী? আপনার লেখায় যে ম্যাজিক রিয়্যালিজমের কথা বলছেন সেটা দেখাতে গেলে তো হলিউডের বাজেট লাগবে।

আমার লেখা নিয়ে যা ছবি হয়েছে সেগুলো কোনওটাই ভাল হয়নি।

তা হলেও ছবি করতে দেন কেন?

আরে পয়সার জন্য দিই। তবে ছবির ভাল-মন্দের ওপর কিন্তু আমার লেখার মান ওঠানামা করে না।

উপন্যাস, হাসির গল্প, ছোটদের লেখা, খেলা নিয়ে লেখা, এত বিষয় নিয়ে অনায়াস লেখন সম্ভব হয় কেমন করে? রোজই কি লেখেন?

রোজের লেখা বলে কিছু নেই আমার। লেখার প্রয়োজনে লিখি। আমি যখন কিছু লিখি, তখন কিছু ক্রিয়েট করি না। বড় উপন্যাস থেকে ছোট গল্প কখনওই কিছু প্ল্যান করে প্লট ভেবে লিখিনি। হঠাত্‌ একটা লাইন এসে যায়। ওই যেমন তুলোর থেকে একটা একটা করে সুতো বেরিয়ে আসে, তেমনি ওই লাইন থেকে শব্দেরা ভিড় জমায়। ভাবনা শুরু হয়। চরিত্র আসে, ঘটনা আসে। আমি শব্দ দিয়ে ছবি দেখতে আরম্ভ করি। সেগুলোকে অনুসরণ করতে করতেই লেখা হয়ে যায়।

এই তৈরি হয়ে যাওয়া লেখায় জীবনরহস্য উন্মোচিত হয়?

জীবনকে আঁতিপাতি করে খুঁজতে গিয়েই লিখে চলেছি আজও। হয়তো সমাধান দিতে পারি না, কিন্তু প্রশ্ন থাকেই। এই প্রশ্ন, নিজের অস্তিত্ব নিয়ে চিন্তাই মনুষ্যত্বের খানিকটা ভাগিদার করে রেখেছে আমায়।

আর জীবনে প্রেম বা কোনও দুর্বলতা?

দুর্বলতা তো থাকবেই। কিন্তু দরজা খুলে দিইনি। আসলে প্রেম এলেই যে তাকে মাংসল পরিবেশে নিয়ে যেতে হবে এমনটাও নয়। ভোগতৃষ্ণা থেকে নিজেকে সংযত রেখেছি। স্ত্রী ছাড়া দ্বিতীয় কোনও মহিলার সংস্পর্শে যাইনি। সেটা পরাভব না গৌরব? জানি না।

প্রিয় অভিনেত্রী কে?

সাধনা। কেমন মোটা হয়ে গেল! মধুবালা, সুচিত্রা সেন, সন্ধ্যারানিকেও খুব ভাল লাগত।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে এত ভাল যোগাযোগ অথচ ভোটে দাঁড়ালেন না?

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো লড়াকু মহিলাকে খুব শ্রদ্ধা করি। এত সাধারণ জীবন যাপন। দেখা হলেই লেখার কথা জানতে চান। নিজেও তো লেখেন। ছবি আঁকেন। একটা জীবনবোধ আছে। কখনও রাজনীতির কথা বলেন না। ভোটে দাঁড়াবার প্রশ্নই ওঠে না।

‘শ্যাওলা’য় নকশাল আন্দোলনের পটভূমি দেখেছি। ‘দূরবীন’য়ে দেখেছি কৃষ্ণকান্তের রাজনীতি। লেখায় রাজনীতি কী ভাবে আসে?

আমি রাজনীতির লোক নই। আমার রাজনৈতিক মতবাদ সচেতন ভাবে লেখায় কোনও দিন আসেনি। অনেক সময় পটভূমি বোঝাতে গিয়েই, রাজনীতির আঙিনায় যেতে হয়েছে।

আজও কি বঙ্কিমের লবঙ্গর মতো পরজন্মের দিকে তাকিয়ে থাকেন?

ইহজন্মে নয়....কিন্তু যদি পরজন্ম থাকে। উফফ্...বুকে মোচড় দেয় এই কথা...

পরজন্ম আছে বলে কি ভূতে বিশ্বাস করেন?

হ্যাঁ, অবশ্যই ভূতে বিশ্বাস করি। ভূতের সঙ্গে দেখাও হয়েছে কয়েকবার।

পরজন্মে কি শীর্ষেন্দু থাকবেন না?

জন্ম আছে কি না জানি না। কিন্তু মনে হয় সব শেষ হয়ে যাবে না। আত্মা... আত্মার সঙ্গে স্মৃতি হয়তো থেকে যাবে....

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE