Advertisement
১১ মে ২০২৪
Tathagata Mukherjee

ইন্ডাস্ট্রিতে মেয়েদের যৌন লাঞ্ছনা যতটা হয়, ছেলেদেরও ততটাই হয়, লিখলেন তথাগত

‘‘তোদের আমার ছবিতে পর পর তিনটে চরিত্রে নায়কের চরিত্র দেব, তুই আমার সঙ্গে শো।”

নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানালেন অভিনেতা তথাগত মুখোপাধ্যায়। ছবি ফেসবুক থেকে নেওয়া।

নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানালেন অভিনেতা তথাগত মুখোপাধ্যায়। ছবি ফেসবুক থেকে নেওয়া।

তথাগত মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০২০ ১৫:৪৩
Share: Save:

সময় আজ আমাদের এমন পরিস্থিতিতে নিয়ে এল যে মনে হচ্ছে নিজের কথা, অভিজ্ঞতা লেখে ফেলি। এই ইন্ডাস্ট্রিতে যখন কাজ করতে আসি তখন আমার বয়স বাইশ। অভিনয় করতেই চেয়েছিলাম। তখন চ্যানেল ধারাবাহিকে কাস্টিংয়ের দায়িত্বে থাকত না। চরিত্র নির্বাচনের বিষয়টা প্রযোজকদের হাতে। এখন টেলিভিশনে চরিত্র নির্বাচন চ্যানেলের মধ্যস্থতায় অনেক বেশি পরিচ্ছন্ন বলা যেতে পারে। একটা মেয়েকে ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন এলে যে ভাবে চরিত্র নির্বাচনের ক্ষেত্রে অপমান বা লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়, এক জন ছেলেকেও সে ভাবে বা বলতে পারি তার থেকেও বেশি লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়। ছেলেরা বলতে পারে না। ছেলেরা তত দিনে কিন্তু পাড়াতুতো মামা, দাদা, কাকাদের দ্বারা যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছে। আমিও হয়েছি। আমার বন্ধুরাও। ওই দাদা-কাকারাই পর্ন ম্যাগাজিনটা প্রথম হাতে ধরায়।

এ রকম অভিজ্ঞতা নিয়ে টেলিভিশনে যখন কাজ চাইতে গিয়েছি তখন দু’জন পরিচালক আমার কাছ থেকে ‘বিশেষ ট্রিটমেন্ট’ আশা করেছিলেন। এখন যদিও তাঁরা খুব সাধারণ পরিচালকে পরিণত হয়েছেন। তখন তার মধ্যে এক জন বাড়িতে ডেকে দরজা-জানলা বন্ধ করে, লাইট জ্বালিয়ে অভিনয় শেখাব বলে কাছে, আরও কাছে আনতে চেয়েছিলেন, অবস্থা বুঝে আমি বেরিয়ে আসি। তবে ছোট থেকেই শুনেছি পরিচালক আর প্রযোজককে সন্তুষ্ট করা না হলে ব্ল্যাক্ললিস্ট করে দেওয়া হবে। এখনও শোনা যায় নতুন ছেলেদের বলা হচ্ছে, ‘তুই আমার কথা না শুনলে ব্ল্যাকলিস্ট করে দেব’। আর এই ‘কথা’ শুধু যৌন নিগ্রহ হিসেবে নয়, বাজার করাও হতে পারে। আসলে ইন্ডাস্ট্রিতে একটা নেক্সাস তৈরি হয়েছে। ধরা যাক, একটা দল। সেই দলের লোকজন একে অন্যের ছবি দেখবে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাল ভাল কথা লিখবে। কিন্তু নতুন ছবি নিয়ে লিখবে না।

আমার অভিজ্ঞতা বলি, ‘ভটভটি’-র টিজার দেখে ইন্ডাস্ট্রিতে আমায় অনেকে ফোন করেছে। টিজারের প্রশংসা করেছে। কিন্তু তারা কখনও ফেসবুকে টিজার শেয়ার করেনি। অথচ পরিচিত পরিচালকের টিজার ভাল লাগুক বা না লাগুক তারা শেয়ার করে দেয়। অভিনেতাদের ক্ষেত্রেও গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। আমি নিজে দু’জন নাম করা প্রোডাকশন হাউজের বড় কাস্টিং ডিরেক্টরদের কাছে শুনেছি, তাঁরা বলেই দেন সম্পর্কের ভিত্তিতে আমরা ছবিতে কাস্টিং করি। আমার মুখের ওপর বলা হয়েছে, এই নয় যে আমি ভাল অভিনয় করলে চরিত্র পাব। আমি কিন্তু পারিনি সম্পর্ক রাখতে তাই আমার চরিত্র পাওয়া হয়নি। এটা আমার অক্ষমতা। কাস্টিং কাউচ পুরো দমে আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে আছে।

দেবলীনাকেই টলিউডের প্রথম সারির এক পরিচালক বলেছিলেন, “আচ্ছা, আমি যে তোকে আমার ছবিতে নেব তার বদলে তুই কী দিবি?” ছবি ফেসবুক থেকে নেওয়া।

এক জন বাঙালি পরিচালক, যিনি লেখক হিসেবেও নাম করা, তাঁর সম্পর্কে কুশল চক্রবর্তী তো সরাসরি বলেছিলেন, তিনি ওই পরিচালকের কাছ থেকে চরিত্র পাওয়ার বিনিময়ে কী ধরনের প্রস্তাব পান। এখন অবশ্য কুশল চক্রবর্তী বলবেন কি না জানি না। এক সময় মেকআপ রুমের আড্ডাই ছিল, সেই পরিচালক বাছাই করা অভিনেতাদের বলছেন, ‘‘তোদের আমার ছবিতে পর পর তিনটে চরিত্রে নায়কের চরিত্র দেব, তুই আমার সঙ্গে শো।” সব পুরুষ কি সব পুরুষের সঙ্গে শুয়ে পড়তে পারে?

আরও পড়ুন: গত এক মাসে আত্মঘাতী সুশান্তের আরও তিন ঘনিষ্ঠ, চাঞ্চল্যকর অভিযোগ রূপার

এখন নিশ্চয় প্রশ্ন উঠবে, যারা ছবিতে চরিত্র পায় তারা কি সবাই ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে পরিচালকের সঙ্গে শুয়ে পাচ্ছে? তা একেবারেই নয়। এই যে শ্রীলেখাদি বলল, তার পর ওকেও শুনতে হচ্ছে, ও কী কী করেছে। আমার বক্তব্য, শ্রীলেখাদি নামটা ইস্যু নয়। এখানে একের পর এক ঘটনাগুলো গুরুত্বপূর্ণ, যা বলে দেয় আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে প্রতি মুহূর্তে অমর্যাদা হয়। এখনও কিছু পরিচালক আছে পুরুষ অভিনেতাদের যাদের ‘এন্টারটেইন’ করতে হয়। কখনও সেক্সুয়ালি, কখনও বাজার করে, চাকরগিরি করে। এ ভাবে কেউ ‘মহান অভিনেতা’, ‘নবাগত অভিনেতা’ হয়ে আসছে। এই কাজের সঙ্গে দুর্ভাগ্যজনক ভাবে অভিনয় বা ক্রাফটের সম্পর্ক নেই। সবাই কি অভিনেতা আর পরিচালকের দক্ষ চাকর, এক সঙ্গে হতে পারে? ছবির ক্ষেত্রে এটা চলে।

ইন্ডাস্ট্রিতে নোংরামো করে সিনেমা তৈরি হয়... হবে। এটা স্বীকার করার সময় এসেছে এ বার। ছবি ফেসবুক থেকে নেওয়া।

দেবলীনাকেই পার্টিতে টলিউডের প্রথম সারির এক পরিচালক বলেছিলেন, “আচ্ছা, আমি যে তোকে আমার ছবিতে নেব তার বদলে তুই কী দিবি?” দেবলীনা যখন হাসতে হাসতে বলে, “কেন, আমি আমার ক্রাফট দেব!” ওই পরিচালক বলেন, “সে তো সবাই দেবে। আর কী দিবি?” এই প্রশ্নটা কিন্তু বার বার অভিনেত্রীদের কাছে আসে। আসছে। মুম্বইয়ে বেশ কিছু মডেল কোঅর্ডিনেটর আর কাস্টিং ডিরেক্টরের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, ওরা সোজাই ফোনে জানতে চায়, অভিনেতা কম্প্রোমাইজ করতে পারবেন কি না। মুম্বইতে অবশ্য ট্যালেন্ট আগে তার পর আসে কম্প্রোমাইজ। আর টলিউডে শোওয়া আর সম্পর্ক আগে, তার পর ট্যালেন্ট। আমাদের এখানেই শেষ নয়। তৈরি হয়েছে গোষ্ঠী! আমি কিন্তু পছন্দের কথা বলছি না। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে ছাড়াও তো সত্যজিৎ রায় ছবি করেছেন। এখানে বিষয়টা পছন্দ নয়, গোষ্ঠীতে আটকে। মানে আমার একটা গোষ্ঠী আছে। কোনও পার্টি বা বিয়েবাড়িতে তারা আমার সঙ্গে থাকবে, পেজ থ্রি-র ছবি তুলব আমরা একসঙ্গে। আমি যে পার্টিকে সাপোর্ট করব তারাও করবে। এই ভাবে নেক্সাস তৈরি হয়। দেখা যায়, টেলিভিশনের জনপ্রিয় অভিনেতা এই গোষ্ঠীতে পড়ে না। তাই তাকে সিনেমার প্রধান চরিত্রে দেখা যায় না। আমাদের মতো অভিনেতাও ইন্ডাস্ট্রির বাইরেই থেকে গিয়েছে। যাবেও… আমরা কিছুই বদলাতে পারব না।

তবে ইন্ডাস্ট্রিতে নোংরামো করে সিনেমা তৈরি হয়... হবে। এটা স্বীকার করার সময় এসেছে এ বার। আর সেই কারণেই আমাদের সিনেমা এত পিছিয়ে!

আরও পড়ুন: কাদম্বিনীর জীবনে নতুন পুরুষ! বদলে যাবে তাঁর জীবন?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Tathagata Mukherjee Celebrity Sexual Harrassment
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE