ছোটদের নাটক ‘কোগ্রামে কেলেঙ্কারি’ নাটকের একটি দৃশ্য। —নিজস্ব চিত্র
মাত্র ১০ দিনেই বাজিমাত। এমনটা সম্ভব কিনা তা জানতেন না খোদ উদ্যোক্তারাও। কিন্তু কাজে নেমে তাঁরাই দেখলেন, অধ্যাবসায় আর হার না মানা মানসিকতা নিয়ে কাজে নামলে সবই সম্ভব। আর তার জন্যই মাত্র ১০ দিনের কর্মশালা থেকে ফি বছর উঠে আসছে এক ঝাঁক খুদে অভিনেতা-অভিনেত্রী। যাদের সবাই স্কুল পড়ুয়া। গত ১১ বছর ধরে কল্যাণী কলামণ্ডলম রামধনু নাট্যমেলার ‘শো স্টপার’ সেই খুদেরাই।
উদ্যোক্তারা জানালেন, ১১ বছরে পা দেওয়া এই নাট্যমেলার অন্যতম উদ্দেশ্যই হল নতুনদের সুযোগ দেওয়া। তাই নামজাদাদের পাশাপাশি প্রতিবারই এখানে সুযোগ পায় মঞ্চের খোঁজ করা কোনও না কোনও আনকোরা নাট্যদল।
কল্যাণী কলামণ্ডলম নাট্যদল এ বার ২০ বছরে পা দিল। গত ১১ বছর ধরে তারাই আয়োজন করছে রামধনু নাট্যমেলার। এক সময়ের শিল্প শহর হিসেবে পরিচিতি পাওয়া কল্যাণী কিন্তু বার বার নাটকের সমঝদার হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করেছে।
কল্যাণীর আর এক নাটকের দল কল্যাণী নাট্য চর্চাকেন্দ্রও গত ২০ বছর ধরে শহরে নাট্যৎসবের আয়োজন করে আসছে। নাটকের উৎসবের জন্য মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে টিকিট কেনেন। নাট্যচর্চা কেন্দ্রের উৎসবে এ বার টিকিট বিক্রির শুরুর দিনেই চার লক্ষ টাকার টিকিট বিক্রি হয়েছিল। কল্যাণীর মতো একটি মফস্সল শহরের কাছে যা বিস্ময়ের বিষয়। নাট্যপ্রেমীরা কল্যাণী কলামণ্ডলমের নাট্যমেলাকেও সমান ভাবে উৎসাহ যুগিয়ে আসছেন।
উদ্যোক্তাদের অন্যতম কলামণ্ডলমের পরিচালক, পেশায় রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক বিভাগের শিক্ষক শান্তনু দাস বললেন, ‘‘সত্যি বলতে কী, এখানকার দর্শকেরাই এমন পথে হাঁটবার সাহস জুগিয়েছেন।’’
শান্তনুবাবু জানান, নাট্যমেলার শুরুর সময়ই ঠিক হয়েছিল, তাঁরা অন্য ধরনের কিছু করতে চান। আলোচনায় ঠিক করেন বড়দের সিরিয়াস নাটক নিয়ে তো সর্বত্রই নাট্য উৎসব হয়। কিন্তু আনকোরারা সেখানে সুযোগ পায় না। আনকোরা মানে যদি একেবারে নতুন হয়, তা হলে কেমন হয়? এই প্রশ্ন উঠতেই আর দিশা খুঁজে পেতে অসুবিধা হয়নি তাঁদের।
ঠিক হয় বিভিন্ন স্কুলের শিশু ও কিশোরদের কর্মশালায় প্রশিক্ষণ ও মহলা দিয়ে তাদের দিয়েই হবে নতুন প্রযোজনা। শুরুর দিকে একটু অসুবিধা যে হয়নি তা নয়। কিন্তু ধীরে ধীরে প্রচুর পড়ুয়া যোগ দিয়েছে কর্মশালায়। আর এখন এটা একটা ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি বছরই শহরের বিভিন্ন স্কুলে প্রচার করা হয়। চতুর্থ শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রদেরই কর্মশালায় নেওয়া হয়।
এ বছর নাট্যমেলা শুরু হয়েছিল ১২ জানুয়ারি। ওপেনিং শো ছিল বাংলাদেশের নাটকের দল ঢাকা নাট্যম রেপার্টরির প্রযোজনা ‘দমের মাদার’। ধর্ম নিয়ে ব্যবসা ফেঁদে লোক ঠকানোই ছিল এই নাটকের বিষয়। এখানে দর্শকদের উৎসাহ দেখে ওপারের নাটকের দলটি রীতিমতো উৎসাহিত। চেনা নামজাদা নাটকের দলের পাশাপাশি এ বারও নতুন দল হিসেবে সুযোগ পেয়েছে বেহালা ব্রাত্যজন। তাঁদের ‘বিচিত্রা অনুষ্ঠান’ নাটকটি একাবারেই নতুন। কলামণ্ডলমের নিজেদের প্রযোজনাতে চেনা মুখের সঙ্গে সঙ্গে নতুনের জয়গান।
উদ্যোক্তারা জানান, এত রঙের সমাহার, তাই নাম রামধনু নাট্যমেলা। এ বছর থেকে চালু হয়েছে কলামণ্ডলম সম্মাননা। এ বার নাট্যকার সমীর দাশগুপ্তকে এই সম্মান দেওয়া হয়।
প্রতিবারের মতো এ বারও শো স্টপার কচিকাঁচেদের দল। বরাবরের মতো কলামণ্ডলম এবার বড়দের নাটক ‘মলুয়া সুন্দরীর পালা’ সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে। ময়মনসিংহ গীতিকার কাহিনী অবলম্বনে মলুয়া সুন্দরী পালা। পাশাপাশি ছোটদেরও পালাকে সমানভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন কলামণ্ডলমের শিল্পীরা। কর্মশালায় তালিম দেন কলামণ্ডলমের তাঁরাই।
আয়োজকরা জানান, এই উদ্যোগের কথা এখন শহরের সব স্কুলই জেনে গিয়েছে। তার ফলে পড়ুয়ারাও এই বিষয়ে কমবেশি ওয়াকিবহাল। তবুও তাঁরা প্রতি বছর শহরের সব স্কুলেই কর্মশালার কথা জানিয়ে দিই। প্রথম দিকে সে ভাবে সাড়া না পেলেও এখন তাঁদের কাছে ভুরি ভুরি আবেদনপত্র জমা পড়ে। সেখান থেকেই তাঁরা খানিক ঝালিয়ে নিয়ে নতুনদের বেছে নেন। তারপর চলে কর্মশালা। কোন নাটক হবে, তা আগেই ঠিক করা থাকে। দিন দশেক ধরে চলে কর্মশালা। তবে তার পরও মহলা দিতে হয়। কোনও দিন মঞ্চে পা দেয়নি এমন শিশুরা যে রকম অভিনয় করে, তা চমকে দেওয়ার মতোই। আসলে ওদের উৎসাহ এত বেশি থাকে যে, তাতেই সব উতরে যায়।
এ বারের কর্মশালা থেকে মোট ৩২ জন কচিকাঁচাকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। তাদের দিয়েই এ বারের প্রযোজনা ‘কোগ্রামে কেলেংকারি’। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মুখোপাধ্যায়ের গল্পের নাট্যরূপ। নাটকের গল্প কিছুটা এ রকম—কোগ্রামে ভূতেদের মড়ক লেগেছে। মানুষ মরে যেমন ভূত হয়, তেমনই ভূত মরলে তবেই ফের মানুষ হিসেবে জন্ম হয়। আগে কলেরা, ওলাওঠা, প্লেগে হাজারে হাজারে মানুষ মরত। ফলে কোগ্রামে ভূতেদের সংসার রীতিমতো ফুলে ফেঁপে উঠত। গাঁ উজার হয়ে যাওয়া সে সব রোগ বিদেয় নিলেও, মানুষ মরার তেমন বিরাম ছিল না। রোগে, জ্বরে সামান্য ভুগলেই অক্কা। কিন্তু তাতে বাদ সেধেছেন কোগ্রামের এক কোবরেজ। সেই কবরেজের ওষুধ খেয়ে আর মানুষ তেমন মরছে না। কিন্তু মড়কে ভূতেরা টপাটপ মরছে। ফলে সেই কোবরেজকে জব্দ করতে ভূতেদের নানা কাণ্ড কারখানা নিয়ে নাটক ‘কোগ্রামে কেলেংকারি’। এমনই মজার বিষয় নিয়ে নাটক জমিয়ে দিল স্কুল পড়ুয়া বৃষ্টি ভট্টাচার্য, অভিপ্রীতি সাহা, দেবপ্রতিম জানা, উজান ভট্টাচার্যরা। উদ্যোক্তারা জানান, আশার কথা, একটি অভিনয়েই এদের নাটক শেষ হয় না। প্রতিবারই বিভিন্ন জায়গা থেকে অভিনয়ের ডাক আসে। উদ্দেশ্য আরও সফল এই কারণে, এদের মধ্যে থেকে উঠে আসছে ভালো অভিনেতা-অভিনেত্রী।
ছোটদের নাটক দেখতে এসেছিলেন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী প্রদীপ সরকার। তিনি জানান, তিনি ছোটদের নাটকের ফ্যান হয়ে গিয়েছি। তিনি নাটকের পোকা। শহরের কোনও নাট্য উৎসবই বাদ দেন না। কিন্তু বয়সের জন্য এখন আর সব নাটক দেখতে পারেন না। ফলে এখন বেছে বেছে নাটক দেখতে আসেন।
কিন্তু, ছোটদের নাটক কিছুতেই বাদ দেন না। এটা ফি তাঁর অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘স্কুল ব্যাগের ভারে সারা বছর যাঁদের পিঠ ঝুঁকে থাকে, মঞ্চে তাদের পিঠটান করে অভিনয় করতে দেখলে বড় ভাল লাগে। আসলে এদের শৈশব তো ছিনতাই হয়ে যাচ্ছে। তারই মধ্যে এটা একটা খোলা হাওয়ার মতো। ’’
তাই, উদ্যোক্তাদেরও এর জন্য ধন্যবাদ দিতে ভোলেন না তিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy