মাশুল গুনল ‘পিউপা’। ছবির একটি দৃশ্য।
চলচ্চিত্র উৎসবের প্রথম দিন। সন্ধে তখন ৬টা। হঠাৎ করে রবীন্দ্র সদনের পর্দা কালো করে ছবির মাঝপথে বন্ধ হয়ে গেল ছবির প্রোজেকশন। ছবির ডিরেক্টর, কাস্ট অ্যান্ড ক্রিউরা অসহায় ভাবে ছুটে বেড়াচ্ছেন হলের মধ্যে। কিন্তু উৎসব কর্তৃপক্ষের কারুর দেখা নেই। যা হোক তা হোক করে মিনিট ১৫ পরে শুরু হল ছবি। কিন্তু আধ ঘণ্টা পর আবার সেই একই জিনিস। এবার ধৈর্যের বাধ ভাঙল সকলের। ছবির পরিচালক-সহ বাকিরা সবাই ফেটে পরলেন রাগে। সাংবাদিকদের কাছে উগরে দিলেন নিজেদের ক্ষোভ। তিতি বিরক্ত হয়ে গালাগালি শুর করল দর্শকরা। কিন্তু ফেস্টিভ্যাল কর্তৃপক্ষের কারও দেখা নেই। ছবির নাম ‘পিউপা’। ইন্দ্রাশিস আচার্য পরিচালিত এই ছবিটি এ বারের ফেস্টিভ্যালের ইন্ডিয়ান ল্যাংগুয়েজ কম্পিটিশন বিভাগে শিবরাত্রির সলতের মত টিকে থাকা একমাত্র বাংলা ছবি। কিছু ক্ষণ আগেই নিজের মাটিতে নিজের ঘরের দর্শকের সামনে ছবিটা দেখাতে পেরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন ছবির সাথে যুক্ত শিল্পীরা। আমাদেরও গর্ব হচ্ছিল। কিন্তু এক ঘন্টার মধ্যেই পরিস্থিতি হয়ে উঠল লজ্জাজনক। দেশি-বিদেশি দর্শক, ডেলিগেট, গেস্ট, জুরি মেম্বার সকলের সামনে প্রথম দিনই মুখ পুড়ল ফেস্টিভ্যাল কর্তৃপক্ষের। তারপর যদিও বেশ কিছুক্ষণ পরে ছবিটা আবার শুরু হয়। কিন্তু ততক্ষণে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গিয়েছে। তার কেটে গেছে ছবির আবহের। অর্ধেক দর্শক হল থেকে বেরিয়ে গিয়েছেন। জুরি বোর্ডের মেম্বাররা চলে গিয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য- ‘এ ভাবে ছবি দেখা যায় না’। সত্যিই এ ভাবে ছবি দেখা যায় না। ফেস্টিভ্যালের ছবি তো আর মেগা সিরিয়াল নয় যে রান্না করতে করতে, ঘরের বিভিন্ন কাজ করতে যে হোক সে হোক করে দেখে ফেললেই হল। সিরিয়াস ছবি দেখার জন্য একটা বিশেষ ধরনের মুডের প্রয়োজন হয়। এ রকম পরিস্থিতিতে কোনও ভাবেই সেই মুড আসা সম্ভব নয়।
ছবির প্রদর্শনী বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বাইরে বেরিয়ে এসেছেন দর্শকরা। ছবি— মেঘদূত রুদ্র।
ফেস্টিভ্যাল মানে শুধু তাক লাগানো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান নয়। নয় শুধু তারকা সমাগম। ফেস্টিভ্যাল মানে ঝাঁ চকচকে গ্ল্যামারাস পরিবেশ নয়। ভাল ফেস্টিভ্যালের প্রাণ ভোমরা লুকিয়ে থাকে একমাত্র তার সিনেমায়। ছবিই ফেস্টিভ্যালের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। বাকি সব কিছু ঠিক রেখে ছবির সাথে এমন বিমাতৃ-সুলভ আচরণ কখনই মেনে নেওয়া যায় না। নন্দনের প্রোজেকশন নিয়ে কিছু বলার নেই। বিশ্বমানের ব্যবস্থা। কিন্তু তার পাশেই রবীন্দ্র সদনের অবস্থা খুবই করুণ। সদনের এই সমস্যা কিন্তু নতুন নয়। প্রতি বারই কিছু না কিছু সমস্যা এখানে লেগেই থাকে। এখানে ছবির প্রোজেকশন বরাবরই খুব নিম্নমানের। অনেকে বলবেন যে এটা তো নাটকের হল। এ রকম একটু আধটু তো হতেই পারে। তা নাটকের হলে ছবি দেখানোর দরকারটাই বা কী। আর যখন দেখানো হচ্ছে তখন তার ব্যবস্থাপনার কেন উন্নতি করা হবে না। দিনের শেষে এই প্রশ্নগুলো কিন্তু থেকেই যায়। একটা শহর তথা রাজ্যের সাংস্কৃতিক বিকাশে চলচ্চিত্র উৎসব একটি অন্যতম স্তম্ভ। সেখানে এই ধরনের আনপ্রফেশনাল অ্যাপ্রোচ রাজ্যের মুখ খুব একটা উজ্জ্বল করে না।
আরও পড়ুন, হেমন্তের শীতশীতে হাওয়ায় শুরুতেই জমজমাট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল
আরও পড়ুন, রবিবার ফেস্টিভ্যালে কোন কোন ছবি মিস করবেন না
আমরা হামেশাই দুঃখ করি বাংলায় আগের মত ভাল ছবি আর হয় না। কিন্তু ভাল ছবি হওয়াটা কোন ম্যাজিকাল প্রসেস নয়। ভাল ডিরেক্টররা আকাশ থেকে পড়েন না। ভাল ছবি, ভাল ডিরেক্টর পাওয়াটা এক ধরণের দীর্ঘমেয়াদী চেষ্টার ফসল। এবং এটা সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। তারা নার্চার না করলে পর পর ভাল ছবি হওয়া সম্ভব নয়। দেশে, বিদেশে পুরস্কার পাওয়ার মতো ছবি তৈরি তো কোনও ভাবেই হওয়া সম্ভব নয়। এমত পরিস্থিতিতে ইন্দ্রাশিসের মত গুটিকতক পরিচালক চেষ্টা করছেন একক প্রচেষ্টায় কষ্ট করে ভাল ছবি করার। বাজারের কাছে নতি স্বীকার না করে নিজের মত করে সৎ ছবি বানানোর। সেখানে নিজের শহরে, নিজের মাটিতে, নিজেদের উৎসবে তাঁদের এই অসহায় মুখগুলি বাংলা সিনেমার খুব একটা গৌরবময় অধ্যায় নয়। আর এ রকম চলতে থাকলে টিমটিম করে টিকে থাকা, গলে যাওয়া পচে যাওয়া, বাংলা সিনেমা অচিরেই চির গভীর অন্ধকারে তলিয়ে যাবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy