Advertisement
২৬ মার্চ ২০২৩
kishore kumar

Kishore Kumar: আমি যতটা কিশোর-সঙ্গ করেছি তার এক কণাও পাননি কুমার শানু: কিশোর কণ্ঠী গৌতম ঘোষ

কী প্রচণ্ড খামখেয়ালি, আত্মমগ্ন এক শিল্পী। সারাক্ষণ নিজের মধ্যেই ডুবে থাকতেন।

কিশোর কণ্ঠী গৌতম ঘোষ

কিশোর কণ্ঠী গৌতম ঘোষ

গৌতম ঘোষ
গৌতম ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০২১ ১৫:১৯
Share: Save:

সবার দুর্গাপুজো হয়। আমার গুরু পুজো। ৪ অগস্ট কিশোর কুমারের জন্মদিন। প্রতি বছর আগের দিন বা তারও আগের দিন থেকে গুরুজির গান, স্মৃতিকথায় ডুব দিই। ফিরে যাই ১৯৭২ সালে। ওই বছর পাড়ার ফাংশনে মঞ্চে উঠে আমার প্রথম গান গাওয়া। দুই শিল্পীর আসা-যাওয়ার মাঝের ফাঁক ভরাতে। তার আগেও গান গাইতাম। কিন্তু সেটা বাড়িতে। মা-বাবা, আত্মীয়দের ফরমায়েশ মেনে। পাড়ার ক্লাবে বন্ধুদের অনুরোধেও গাইতে হত। ওরা টেবিল বাজিয়ে সঙ্গত করত। সে দিন আমি আচমকাই শিল্পী!

Advertisement

গান গেয়ে মঞ্চ থেকে নামার পরেই ঘিরে ধরেছিল পাড়ার বড়রা। প্রশ্ন, ‘‘এত ভাল গান করিস! নিয়মিত অনুষ্ঠান করিস না কেন?’’ পড়াশোনা তখনও শেষ হয়নি। তাই যখন ভাবছি কী করব, মা-বাবা বললেন গাইতে ভাল লাগলে সেটাই কর। আমি তখনও সব শিল্পীর গান গুনগুন করতাম। এ বার কোনও এক জনকে বাছতে হবে। আমি বেছে নিলাম কিশোর কুমারকে। কেন? অমন ভার্সেটাইল গলা। যেমন দরদ তেমনি অনুভূতি। যেন ক্যানভাসে ছবি আঁকছেন! শুনতে শুনতে মনে হল, কিশোর কুমার আমার ভবিষ্যত। ১৯৭৪ সালে আমি পাকাপাকি ‘কিশোর কণ্ঠী’। সেই সময় প্রথম ফাংশন করে উপার্জন করেছিলাম ১০ টাকা!

এ ভাবে ১০ বছর কাটার পর ১৯৮৪ সালে মনে হল যাঁর পরিচয়ে আমি পরিচিত, এক বার তাঁকে সামনাসামনি দেখব না? এই ভাবনা থেকেই চলে গেলাম মুম্বই। আমার গুরুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন মেহবুব স্টুডিয়োর রেকর্ডিস্ট অভিনন্দন ঠাকুর। গোটা কয়েক গান শোনালাম। শুনে একটাই কথা বললেন, ‘‘আমার গান গাও ক্ষতি নেই। কিন্তু আমার গান আমার মতো করে গেও না। নিজের মতো করে পরিবেশন কোরো। আমার ছায়া হয়ে থাকলে কোনও দিন বেশি দূর যেতে পারবে না।’’ কিশোর কুমারের কাছে আমার যাতায়াত শুরু তার পর থেকেই। ওঁর বাড়িতে যেতাম। যে যে স্টুডিয়োয় রেকর্ডিং করতেন সেখানে গিয়েছি। অনেকেই সে সময়ে বলতেন, কিশোর কুমারের বাড়িতে গৌতম ঘোষের অবাধ যাতায়াত। খুব ভুল কথা। খামখেয়ালি শিল্পীর বাড়িতে ওঁর অনুমতি ছাড়া কারওর অবাধ যাতায়াত ছিল না।

কিশোর কুমার

কিশোর কুমার

বুঝতে চাই বললেই কি বোঝা সম্ভব ওঁর মতো শিল্পীকে? গুরুজি সব সময় বলতেন, আমায় অনুসরণ কর। দেখো, আমি কী ভাবে গান গাই। গানে প্রাণ আনো। তার পর শ্রোতাদের শোনাও। এ দিকে আমার কী করুণ দশা! কী প্রচণ্ড খামখেয়ালি, আত্মমগ্ন এক শিল্পী। সারাক্ষণ নিজের মধ্যেই ডুবে থাকতেন। মন ভাল থাকলে এন্তার আড্ডা মারতেন। কখনও দেখেও চিনতে পারতেন না! একই সঙ্গে প্রচণ্ড ভালবাসার কাঙাল। সবাই তাঁকে ভালবাসবে সারাক্ষণ, চাইবে তাঁকে— এটাই ছিল তাঁর এক মাত্র ধ্যানজ্ঞান। একই ভাবে তিনি খুব শ্রদ্ধা করতেন তাঁর থেকে বয়সে বড় শিল্পীদের।

Advertisement

মহম্মদ রফির সঙ্গে কিশোর কুমারের আজীবন গলায় গলায় ভাব। এখানেও একটি মিথ্যে রটনা আছে। তখনকার দিনে মুম্বইয়ে গুঞ্জন ছড়িয়েছিল, দুই শিল্পী নাকি একে অন্যকে সহ্য করতে পারতেন না। আমি কিশোর কুমারের মুখে শুনেছি, ওঁর সুর করা অনেক গান রফি সাহাব হাসিমুখে গেয়েছেন। আবার এটাও ঘটেছে, কোনও ছবিতে রফি-কিশোর গাইছেন। গুরুজি সব সময় চেষ্টা করতেন, তাঁর গান যেন রফি সাহাবের থেকেও এক ধাপ বেশি ভাল হয়। সুস্থ প্রতিযোগিতা ছিল তাঁদের মধ্যে। বিদ্বেষ ছিল না।

মহম্মদ রফির মৃত্যুর খবর পেয়েই ছুটে গিয়েছিলেন কিশোর কুমার। প্রয়াত শিল্পীর দেহ মাটিতে শোয়ানো। তাঁর মাথার কাছে গালে হাত দিয়ে বসে গুরুজি। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন শিল্পীর মুখের দিকে। যেন বজ্রাহত। পরস্পরের মধ্যে আত্মিক টান না থাকলে এই দুঃখবোধ, শূন্যতা আসে কখনও?

কিশোর কুমার

কিশোর কুমার

গানে কী করে প্রাণ ঢালতেন কিশোর কুমার? মেহবুব স্টুডিয়োয় ‘মি. ইন্ডিয়া’-র গান রেকর্ডিং হচ্ছে। নায়ক-নায়িকা অনিল কপূর, শ্রীদেবী। আমিও সেখানে গিয়েছি। ‘কাটে নহি কাটতে ইয়ে দিন ইয়ে রাত’ গাইতে গাইতে যেই ‘লো আজ ম্যায় কহতা হুঁ’ লাইনটি এল গুরুজি হাত দু’টো উপরে তুলে উদাত্ত কণ্ঠে গাইলেন। কেন? গানের ভাব অনুযায়ী সারা পৃথিবীকে তিনি তাঁর মনের কথা জানাচ্ছেন। তাই গলা ছেড়ে সেই অংশ গেয়েই ভীষণ নরম করে বললেন, ‘আই লাভ ইউ’ অংশটুকু। কারণ, নিজের ভালবাসার কথা একান্ত ব্যক্তিগত। সেটা গলা ছেড়ে জানায় না কেউ! এ ভাবেই গানের প্রতিটি লাইনের মানে বুঝে তাতে নাটকীয়তা এনে গাইতেন কিশোর কুমার। তাঁর গানও জীবন্ত হয়ে উঠত।

আরও একটি ব্যাপার করতেন। একটি ফোন নম্বর নানা ভাবে আওড়াতেন মাইকের সামনে। কখনও রেগে, কখনও আদুরে ভঙ্গিমায়, কখনও মিনতি জানিয়ে, কখনও রোম্যান্টিক ভাবে। কার নম্বর? কেউ জানে না। বলতে বলতেই হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠতেন, ‘বাত্তি জ্বলা দো’। সঙ্গে সঙ্গে লাল আলো জ্বলে উঠত। রেকর্ডিং শুরু। এক টেকে গোটা গান গেয়ে ঝড়ের বেগে স্টুডিয়ো থেকে বেরিয়ে গেলেন কিশোর কুমার। কেমন গাইলেন? কোনও ত্রুটি আছে কি? ফিরেও দেখতেন না। নিজের গান দ্বিতীয় বার বাজিয়ে শুনতেনই না!

অনেকেই বলেন, আমি যতটা কিশোর-সঙ্গ করেছি তার এক কণাও পাননি কুমার শানু। তবু ওঁর আজ বিশ্বজোড়া খ্যাতি। আমি কোথায়! এই নিয়ে আমার কোনও আফসোস নেই। এটাও শুনি, আমার সময় কিশোর কুমার ছিলেন বলেই মুম্বই বা কলকাতায় নিজেকে প্রমাণ করতে পারিনি। আরে, আমি তো নিজেকে মুম্বইয়ে কোনও দিন প্রতিষ্ঠিত করতেই চাইনি! বারেবারে ছুটে ছুটে যেতাম গুরুজির টানে।ওঁকে দেখতে, বুঝতে, অনুসরণ করতে।

তাছাড়া, শানুর মধ্যে যে প্রতিভা আছে, সেটা সবার নেই। কিশোর কুমারের ছেলে অমিত কুমারেরই নেই! অমিতও তো কম গান গাননি। কিন্তু শানুর মতো বিশ্বজয় করতে পারলেন? শানুর ভাগ্যে সর্বজনীন হওয়া ছিল। পরিশ্রম করে, প্রতিভা আর ভাগ্যের জোরে সেটাই পেয়েছে সে। আমার দৌড় ধর্মতলা পর্যন্ত। তবু তো ‘গুরু’ আমায় টালিগঞ্জে ওঁর মূর্তির পাদদেশ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছেন। প্রতি বছর ৪ অগস্ট এলেই যেখানে আমার ডাক পড়ে!

(লেখক পেশায় গায়ক, ‘কিশোর কণ্ঠী’ হিসেবে জনপ্রিয়)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.