সকালের একটা ছোট্ট এসএমএস। ‘রবি দা আর নেই রে’। বদলে গেল দিনটা।
রবি ওঝাকে খুব মিস করতাম, এমন মিথ্যে কথা লিখতে পারছি না। কারণ রবিদা তো আমার সঙ্গেই থাকতেন। প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে। রবিদার ভাবনাগুলো তো আমি আমার মধ্যে বয়ে চলেছি রোজ। আমার সঙ্গে তো বেশ কয়েক বছর যোগাযোগও ছিল না। অসুস্থ ছিলেন দীর্ঘদিন। বম্বেতে থাকতেন। আমি আজ সকালে রবিদার চলে যাওয়ার খবর পেয়ে ফোন করেছিলাম। শুনলাম, কলকাতায় আর আনা হবে না। অবশ্য এনে তো কোনও লাভ নেই। মানুষটাই নেই, শুধু শরীর বয়ে নিয়ে আসার কি কোনও মানে আছে?
রবিদাকে নিয়ে কী লিখি বলুন তো? আমি রবিদাকে ভালবাসতাম। হ্যাঁ ভালবাসতাম। সংজ্ঞার অতীত একটা সম্পর্ক ছিল আমাদের। উনি বোধহয় আমার জন্ম-জন্মান্তরের গুরু। আমাকে সবটা দিয়ে শিখিয়েছেন। আমি বোধহয় মানুষটাকে কিছু দিতে পারিনি। হ্যাঁ ওঁর সিরিয়াল ‘এক আকাশের নীচে’ হিট হয়েছে ঠিকই। তবে আমাকে যা শিখিয়েছেন তা কোনও মূল্যেই ফেরত দেওয়া যায় না।
রবি ওঝার সেই ‘এক আকাশের নীচে’র পরিবার, যা বদলে দিয়েছিল বাংলা টেলিভিশন।
রবিদাকে যে ভালবাসি, সে সময়ও বলেছিলাম গর্ব করে, আজও বলি। তবে সে কথাটার অন্য ব্যখ্যা দেওয়া হয়েছিল। আমার সামনেই রবিদাকেও একই প্রশ্ন করা হয়। উত্তরে হেসেছিলেন মানুষটা। সেই হাসির অর্থ আজ বুঝি। অনেক বোকা ছিলাম তো তখন, ছোট ছিলাম। আচ্ছা, আমি তো আমার বাবাকেও ভালবাসি। সেটা নিয়ে কি কোনও গসিপ হয়? রবিদা আর আমার বাবা একই বয়সী। শ্রদ্ধা, সম্মান, ভালবাসা— যাই বলুন মানুষটা তো আমার বাবার মতোই।
বম্বেতে থাকতে রবিদার ইয়ারি রোডের বাড়িতে গিয়েছিলাম। আর শেষ দেখা…, ৫-৬ বছর আগে কলকাতায় এসেছিলেন, তখন। আমাকে আজীবন ‘পাখি’ বলে ডাকতেন। আমি এখনও অনেক জায়গায় গেলে লোকে ‘এক আকাশের নীচে’র চরিত্রের নামে ‘পাখি’ বলে ডাকে। এমনকী সাবুদি, বেণুদির কাছেও আমি পাখি। লোকে তখন বিশ্বাস করত আমি ক্লাস এইটের মেয়ে। কিন্তু আমি তখন কলেজে পড়ি। চৈতিদি আমার মা হয়েছিল ওখানে। সেটে কোনওদিন গ্লিসারিন লাগত না আমাদের। চৈতিদির চোখে জল মানে আমারও চোখে জল চলে আসত। এই ম্যাজিকটা সম্ভব হয়েছিল রবিদারই জন্য। এই জেনারশনের সবাই যে করে খাচ্ছে সেটা ওই মানুষটার জন্য। সিরিয়াল ইন্ডাস্ট্রি চলছে রবি ওঝার জন্য। জানি না, পরে অনেকে আমার সঙ্গে একমত নাও হতে পারেন। তবে আমি এমন ভাবেই ভাবি। বলা ভাল এটাই বিশ্বাস করি।
রবি ওঝা পরিচালিত ছবি ‘আবার আসব ফিরে’র একটি দৃশ্যে কণীনিকা।
মধ্যবিত্ত বাড়ির কণীনিকার কোনও দিন অভিনয় করা হত না রবি ওঝা না থাকলে। এটা ঠিক যে থিয়েটার করতাম। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা দিয়ে তো সিরিয়াল, সিনেমা করাটা মুশকিল। সেই পুচকি কণীকে অভিনেত্রী তৈরি করেছেন রবিদা। আমার থেকে বয়েসে ছোট অনেককে দেখতাম রবিদার সামনে বসে সিগারেট খাচ্ছে। আমি ভাবতেই পারতাম না এসব। রবিদা এলে উঠে দাঁড়াতাম সব সময়। শুধু তো পরিচালক ছিলেন না, ছিলেন এক বিরাট মাপের শিল্পী। যে ভাবে আমাকে সিন বোঝাতেন, সেটা বলে বা লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। অনুভব করার জিনিস। প্রথম যখন কলকাতায় এসেছিলেন, আমি শাড়ি পরে গিয়েছিলাম। রবিদার ছবি ‘আবার আসব ফিরে’র হাত ধরেই তো আমার রেগুলার শাড়ি পরতে শেখা।
জনপ্রিয় সিরিয়াল ‘এক আকাশের নীচে’র একটি দৃশ্য।
রবি ওঝা আমাকে কনফিডেন্ট হতে শিখিয়েছেন। বাবু আসে, বাবু যায়, পয়সা আসে, পয়সা যায়, গ্ল্যামার আসে, গ্ল্যামার যায়— কিন্তু কনফিডেন্স, নিজস্বতা থেকেই যায়। আবার বলি, শুনতে অন্যরকম লাগলেও, আমি এ ভাবেই কথা বলি।
আত্মা কী জানি না, তবে রবি ওঝার সঙ্গে আমার আত্মার সম্পর্ক।
আরও পড়ুন: প্রয়াত রবি ওঝা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy