‘মাছের ঝোল’ ছবির একটি দৃশ্য। ছবি— সংগৃহীত।
মাছের ঝোল
কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপ ও পরিচালনা: প্রতীম ডি গুপ্ত
অভিনয়: ঋত্বিক চক্রবর্তী, মমতা শঙ্কর, পাওলি দাম, সৌরসেনী মৈত্র, সুমন্ত মুখোপাধ্যায়, কাইয়া ব্লুকসাজ্
কথায় আছে ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’। কিন্তু আজকালকার অনেক বাঙালিই মাছ খান না। খারাপ গন্ধ লাগে। রান্না করতেও অনেক ঝক্কি। মাছ ভাজ রে, আলু-বেগুন-ফুলকপি-সিম ইত্যাদি যে সব সব্জি দেওয়া হয় সেগুলোও ভাজ রে, ফোড়ন দাও রে, মশলা দাও রে, ভাল করে মশলা কষাও রে, তার পর আলতো হাতে তাতে ভাজা মাছ দিয়ে রান্না কর রে। তার পর কাঁটা বেছে খেতেও অনেকটা সময় লেগে যায়। এত সময় ব্যয়, এত খাটনি আজকাল নতুন জেনারেশনের অধিকাংশ মানুষের আর পোষায় না। তার থেকে চিকেন আর ডিম অনেক সহজ। টুক করে রেঁধে ফেললেই হল। প্রোটিনের ঘাটতিও মিটে যায়। এমন ব্যস্ত ও কিঞ্চিৎ ফাঁকিবাজ বাঙালিদের টেবিলে মাছের ঝোল সার্ভ করাটা অনেকটাই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। আর এই কাজটাই প্রতীম ডি গুপ্ত করেছেন তার ‘মাছের ঝোল’ ছবিতে। যদি খুব ভুল না করি তাহলে এই ছবিটি বাংলায় তৈরি প্রথম পূর্ণদৈর্ঘের ‘ফুড ফিল্ম’। ফুড ফিল্ম, অর্থাৎ যে ছবিতে রান্না, খাবার-দাবার এগুলো একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। বিদেশে বহু কাল থেকেই এই ধরনের ছবি হয়ে আসছে। হিন্দিতেও বেশ কিছু এই গোত্রের ছবি আমরা দেখেছি। ‘বাবর্চি’, ‘রামজি লন্ডনওয়ালে’, ‘চিনি কম’, ‘লাভ সাব দে চিকেন খুরানা’ ইত্যাদি। কিন্তু রহস্যজনক কারণে খাদ্য রসিক বাঙালি আজ পর্যন্ত বাংলা ভাষায় খাবার-দাবার নিয়ে কোনও ছবি দেখতে পায়নি। এর আগে ‘মাছ, মিষ্টি অ্যান্ড মোর’, ‘ডার্ক চকলেট’, ‘পোস্ত’ ইত্যাদি খাবারের নামে কিছু ছবি হয়েছে। কিন্তু সেগুলোর সাথে রান্নাবান্নার আর খাবারের কোনও সম্পর্ক ছিল না। ফলে এই ছবিটির স্বাদ একেবারে নতুন।
আরও পড়ুন, মুভি রিভিউ: অনেকটাই ছিপছিপে হতে পারত ‘টয়লেট: এক প্রেম কথা’
ছবিতে মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ঋত্বিক চক্রবর্তী। ছবিতে যার নাম দেবদত্ত সেন ওরফে দেব ডি। ছবিতে তিনি একজন সেফের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। যিনি বাবার অমতে তের বছর আগে ইঞ্জিনিয়ারিং-এর চাকরি ছেড়ে সেফ হওয়ার জন্য প্যারিসে চলে যান। এই তের বছর উনি আর কলকাতার বাড়িতে ফেরেননি। এখন প্যারিসের একজন নামকরা সেফ। ২-৩টে রেস্টোরেন্টের মালিক। এমত অবস্থায় মার (মমতা শংকর) অসুস্থতার খবর শুনে তিনি কলকাতায় ফেরেন। ফিরে জানতে পারেন, মায়ের ব্রেন টিউমার। অপারেশন করতে হবে। জীবন বিপন্ন। হাসপাতালে মা তাকে রিকোয়েস্ট করেন যে দেব যেন তাঁকে সেই মাছের ঝোলটা রেঁধে আরেকবার খাওয়ায়। কোন মাছের ঝোল? যেটা দেব অনেক ছোটবেলায়, মায়ের জ্বর হওয়ার সময়, আনাড়ি হাতে রেঁধে খাইয়েছিল। কিন্তু মুশকিলটা হল সময়ের ব্যবধানে সেই মাছের ঝোল রান্নাটা তো দেব এত দিনে ভুলে গিয়েছেন। অনেকটা মার শেষ ইচ্ছে পূরণের মত তিনি মাছের সেই মাছের ঝোলটা আরেকবার রান্না করার এক্সপেরিমেন্ট করতে থাকেন। যেই এক্সপেরিমেন্টে তাকে সাহায্য করেন একজন জুনিয়র সেফ মাতঙ্গিনী ওরফে ম্যাগি। ম্যাগির ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সৌরসেনী মিত্র। এ ছাড়া ঋত্বিকের প্রাক্তন স্ত্রীর ভূমিকায় আছেন পাওলি দাম, বাবার ভূমিকায় সুমন্ত মুখোপাধ্যায়। ফরাসি বান্ধবীর ভূমিকায় ফরাসি অভিনেত্রী কাইয়া ব্লুকসাজ্। ঋত্বিকের অভিনয় নিয়ে নতুন করে আর কিছু বলার নেই। তিনি যেই ছবিতেই অভিনয় করেন একেবারে সেই ছবির চরিত্র হয়ে ওঠেন। এ রকম ম্যানারিজম ছাড়া অভিনয় দেখাটা খুবই তৃপ্তিদায়ক। সেফদের যে সব বিভিন্ন ছোট ছোট বডি ল্যাংগুয়েজ থাকে, সেগুলোকে উনি খুব সুন্দরভাবে ছবিতে তুলে ধরেছেন। এ ছাড়া মায়ের চরিত্রে মমতা শংকর খুবই মায়াময় অভিনয় করেছেন। বাকি চরিত্ররাও যথাযথ। শুধুমাত্র দুখী স্ত্রীয়ের ভূমিকায় পাওলি দাম এক ধরণের আন্ডার অ্যাকটিং করার চেষ্টা করেছেন, যেটা আন্ডার অ্যাকটিং-এর বদলে নো অ্যাক্টিং হয়ে গেছে।
ছবির একটি দৃশ্যে মমতা শঙ্কর ও ঋত্বিক চক্রবর্তী। ছবি— সংগৃহীত।
আরও পড়ুন, মুভি রিভিউ: চেনা পথে ব্যাকগিয়ারেই রোমাঞ্চে ইতি
ছবিতে ক্যামেরার কাজ অসাধারণ। মাত্র ১০-১২ দিনের টাইট শিডিউলে এ রকম যত্নসহকারে শুট করাটা খুবই মুনশিয়ানার ব্যাপার। ডি ও পি শুভঙ্কর ভড়কে ধন্যবাদ না দিয়ে পারছি না। সম্পাদনায় শুভজিত সিংহ-র কাজও খুব ভাল। আর বিশেষ করে ছবির স্টাইলিং এর জন্য অনিরুদ্ধ চাকলাদারের প্রসংশা করতে হয়। “আমাকে পারলে দত্তক নিয়ে নাও” গানটি খুবই নস্টালজিক। নিস্টালজিয়া এই ছবির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। স্মৃতির শহর কলকাতা, বাঙালির ছোটবেলায় মা-ঠাকুমা আর মায়ের হাতের তৈরি মাছের ঝোলের স্মৃতিগুলো ছবির পরতে পরতে জড়িয়ে আছে। রান্নার প্রতি অসম্ভব প্যাশন আর ভাল লাগা না থাকলে এ রকম ছবি বানানো মুশকিল।
আরও পড়ুন, মুভি রিভিউ: ইন্দুর চোখে ইমার্জেন্সির স্বরূপ
তাহলে কি মাছের ঝোলের সবকিছুই ভাল? কোন কাঁটা নেই? তা আছে। কিন্তু কাঁটা বেছে তুলতুলে মাছ যখন মুখে তোলা হয় তখন সেই কাঁটার কথা মানুষ এক নিমেষেই ভুলে যায়। তাই আশা করি ইলিশের এই ভরা মরশুমে ‘মাছের ঝোল’-এর মত স্মার্ট ছবি দর্শকদের ভাল লাগবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy