Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে

তেইশে শ্রাবণ আজ। ভরপুর রবীন্দ্রনাথ! নেই শুধু কণিকা আর সুচিত্রা! রবীন্দ্রসঙ্গীতের সেরা দুই পুণ্যার্থীকে ব্যথায় স্মরণ করলেন তাঁদের ভ্রাতুষ্পুত্রীরা। শুনলেন সংযুক্তা বসু।শান্তিনিকেতনের অ্য্যান্ড্রুজ পল্লিতে পিসিমণি একটা দারুণ সুন্দর বাড়ি তৈরি করেছিল। বাড়ির বারান্দায় পিসিমণি একটা চেয়ার নিয়ে বসে থাকত চুপচাপ চোখ বন্ধ করে। বাড়ির নাম দিয়েছিল ‘আনন্দধারা’। সেই বাড়িতে পিসিমণি যে আনন্দধারা বইয়ে দিয়েছিল তার অভাব আজ টের পাই, শূন্য বাড়িটায় গেলে। সেখানে কত স্মৃতি। কিন্তু পিসিমণি আর নেই। জিজ্ঞেস করতাম তুমি চোখ বুজে কী কর? পিসিমণি বলত, “গুরুদেবকে (রবীন্দ্রনাথ) স্মরণ করি।”

শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়

শান্তিনিকেতনের অ্য্যান্ড্রুজ পল্লিতে পিসিমণি একটা দারুণ সুন্দর বাড়ি তৈরি করেছিল। বাড়ির বারান্দায় পিসিমণি একটা চেয়ার নিয়ে বসে থাকত চুপচাপ চোখ বন্ধ করে।

বাড়ির নাম দিয়েছিল ‘আনন্দধারা’। সেই বাড়িতে পিসিমণি যে আনন্দধারা বইয়ে দিয়েছিল তার অভাব আজ টের পাই, শূন্য বাড়িটায় গেলে। সেখানে কত স্মৃতি। কিন্তু পিসিমণি আর নেই। জিজ্ঞেস করতাম তুমি চোখ বুজে কী কর? পিসিমণি বলত, “গুরুদেবকে (রবীন্দ্রনাথ) স্মরণ করি।” বহু পুরুষ হয়তো পিসিমণির প্রতি অনুরক্ত হয়েছিল। কিন্তু পিসিমণির রাগ-অনুরাগ-ভক্তি সবটাই ছিল রবিঠাকুরকে ঘিরে।

‘চিরসখা হে ছেড়ো না’ গানটায় ‘ছেড়ো না’ কথাটা বলার মধ্যে যে কি অপার্থিব আর্তি লুকিয়ে আছে সেটা তো শ্রোতারা সকলেই উপলব্ধি করেন। কী সমর্পণ, কী নিবেদন ওই কথার মধ্যে! একটা মানুষের উপলব্ধি কোন জায়গায় পৌঁছলে এমন ভাবে গাওয়া সম্ভব।

এ হেন মানুষটা শান্তিনিকেতনের মাটি ছেড়ে কলকাতায় আসতে চায়নি কোনও দিন। পড়ন্ত এক বিকেলে পিসিমণি যখন চোখ বুজে বারান্দায় বসে আছে, পায়ের কাছে লেজ নাড়ছে তার কুকুর বিন্তি, আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম আচ্ছা, তুমি কলকাতায় বাড়ি করো না কেন?

কলকাতায় গিয়ে একদম থাকো না কেন? এত নিরিবিলি ভাল লাগে? সে বলেছিল, “আমি গুরুদেবকে এখানে বসে স্মরণ করতেই ভালবাসি। মনে করি এটাই আমার জায়গা।” তাঁর কাছে মাঝে মধ্যে কলকাতা আসাটা ছিল হয় অনুষ্ঠান করতে অথবা রেকর্ডিং করতে।

কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন মানে পুরোটাই রবীন্দ্রনাথ। ছেলেবেলায় পিসিমণি একদিন আম কুড়োতে গিয়েছিল উত্তরায়ণে। তখন গুনগুন করে গানও গাইছিল। সেই গান শুনে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ছাত্রী করে নেন আর নিজে গান শেখান। আমার দাদু ছিলেন বিশ্বভারতীর লাইব্রেরিয়ান। বই সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। সে দিন রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বলেছিলেন, “তোমার খুদে কন্যাটি তো ভাল গান গাইছে। আমি তার অনিমা নাম বদলে রাখলাম কণিকা।” এই সব গল্প পিসিমণি আমাদের কাছে বহুবার করেছে। এমন একজন আশ্রমকন্যা, যে আমার পরমাত্মীয়া ছিল, গুরুদেবের গানের সাধিকা ছিল, সুরের সাধিকা ছিলতা ভেবে নিজেকে ধন্য মনে করি। বাবা-মা ছাড়া আর কাউকে যদি সমস্ত চেতনা আর শরীর দিয়ে অনুভব করে থাকি সে হল পিসিমণি। সে যেন সত্যি ‘আনন্দ ধারা বহিছে ভুবনে’ গানটারই প্রতীক।

একবার পিসিমণি বিদেশে অনেক দিন থেকে দেশে ফিরে একটা কালো বাক্স সামনে এনে ধরল। তখন আমরা তিন বোনই বেশ ছোট। আমরা গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছি বাক্সের দিকে। পিসিমণি বাক্স খুলতেই সে কি কাণ্ড! বেজে উঠল পিয়ানো। আর বাক্সের ভেতর নেচে উঠল এক জোড়া সুন্দর দেখতে ছেলে আর মেয়ে। যেন রাজপুত্র, রাজকন্যা। আমরা অবাক হয়ে গেলাম। বেঁচে থাকলে এই বছর ১২ অক্টোবর পিসিমণির বয়স ৯০ হত। নিজের জন্মদিনে বাড়িতে এত মানুষ আসতেন দেখে আপ্লুত হয়ে যেত পিসিমণি। বরাবরই মৃদুভাষী। উচ্ছ্বাসের প্রকাশ ছিল খুব স্নিগ্ধ। যে বছর পিসিমণি দেশিকোত্তম পুরস্কার পেল, ভিড়ের মধ্যে প্রথমে যেতেই চায়নি পুরস্কার নিতে। তার পর অবশ্য গিয়েছিল। শান্তিনিকেতনের আম্রকুঞ্জ সেদিন ভিড়ে ভিড়ে ছয়লাপ।

সন্ধ্যাবেলায় পিসিমণির সঙ্গে দেখা করতে এলেন আর এক মৃদুভাষী সঙ্গীত সম্রাজ্ঞী। তিনিও একই দিনে দেশিকোত্তম পেয়েছেন। লতা মঙ্গেশকর। বাড়িতে আসার পর দুই সেরার সেরা গায়িকা মুখোমুখি চেয়ারে বসলেন। গল্প শুরু হল। গান নিয়ে কত কথা। আমার এবং আমার পরিবারের কাছে সেই মুহূর্তটা ছিল দারুণ আবেগময়। আবেগে আমার চোখে জল আসছিল। নানা কথার পর পিসিমণি অভ্যেসবশত কৌটো খুলে জর্দা মুখে পুড়তে গেল। হঠাৎ লতাজি বললেন, “দিদি আপনি আর জর্দা খাবেন না।” সেই বিকেলের স্মৃতি প্রায়ই ফিরে ফিরে আসে আমার কাছে। কত বড় গায়িকা এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে পিসিমণির সঙ্গে দেখা করতে! সে কি ভোলা যায়!

তবে ছোটবেলায় তো বুঝতাম না কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় নামের মহিমা যে কী! পিসিমণি মানে দারুণ ভাল গান গায় এমন এক আদরের মানুষ। বিদেশ থেকে ফেরার পর কী ভাবে প্লেনটা আকাশে উড়ে গেল সেই গল্প করত। বলত, “জানো তো নীচে তখন নীল সমুদ্র। আর মেঘের মধ্যে দিয়ে খুব আওয়াজ করে প্লেনটা যাচ্ছিল।” আমরা তিন বোন মুগ্ধ হয়ে সে গল্প শুনতাম বারবার। কখনও বা মনে পড়ে আমি জিজ্ঞেস করতাম, আচ্ছা প্লেন কি শুধু সমুদ্রের ওপর দিয়েই যায়? পিসিমণি যথাসাধ্য আমাদের কৌতূহল মেটানোর চেষ্টা করত।

মানুষটা বরাবরই শান্ত প্রকৃতির। সুচিত্রা মাসির মধ্যে যে সোচ্চার কথা বলার ব্যাপারটা ছিল, পিসিমণি ছিল ঠিক তার বিপরীত। কখনও বা এমনও হয়েছে, পিসিমণি সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না এমন কোনও ব্যাপারে সুচিত্রা মাসির কাছে পরামর্শ চাইত। তবে সেটা কখনও সখনও। দু’জনের গায়কি ছিল আলাদা। কিন্তু বন্ধুত্ব ছিল আশ্চর্য রকম। আজ তো ওঁদের দু’জনের গায়কিই গৃহীত হয় সব থেকে বেশি। পিসিমণি আর সুচিত্রামাসির মধ্যে নানা বিভেদ নিয়ে গল্পকথা রটনা হয়েছিল এক সময়। যেগুলো আসলে গসিপ ছাড়া কিছু নয়। বিখ্যাত হলে তাঁদের নিয়ে চর্চা হবেই। সেটাই হয়েছে আসলে। পিসিমণি সকলকেই আপন করে নিত। আমি তো ওই বাড়িতে দেবব্রত বিশ্বাসকেও আসতে দেখেছি।

শান্তিনিকেতনের খোলামেলা প্রকৃতির মাঝখানে গেলে আজও যেন তাঁকে দেখতে পাই মনে হয়। একটা ঘটনা মনে পড়ে। আমার ঠাকুমা (দাদি) যখন মারা গেলেন তখন পিসিমণি, স্মরণসভায় স্তোত্রপাঠ আর গান গাইবার জন্য বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র আর রামকুমার চট্টোপাধ্যায়কে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। ওঁরা যখন স্তোত্র পড়ছেন, গান গাইছেন দেখেছিলাম পিসিমণি ঘরের কোনায় বসে আছে। তার চোখে অঝোর ধারায় জল। ওই ভাবেই শেষ নমস্কার জানিয়েছিল তাঁর মাকে। আমাদের বাড়িতে প্রত্যেক বিকেলে ঠাকুমাকে দেখতে আসত পিসিমণি। রোজই তো দেখা হত আমাদের। পিসিমণি সব সময়ই বলত “আমি যখন থাকব না তখন বুঝবি! এখন তো আমার কাছে গানগুলো শিখে নিলে পারিস।”

সে ভাবে নিয়মিত গান শিখিনি পিসিমণির কাছে। পরে যখন সঙ্গীত ভবনে মাস্টার্স করছি তখন ওঁর কাছে ক্লাস করেছি। নিপুণ শিক্ষিকা ছিল। যতক্ষণ না ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে তাদের সেরাটা আদায় করতে পারত ধৈর্য ধরে শিখিয়ে যেত। বিশেষ করে টপ্পা অঙ্গের গানগুলো পিসিমণি দারুণ নিষ্ঠা নিয়ে শেখাত। কিছু দিন আগে ‘চতুষ্কোণ’ ছবির জন্য ‘চিরসখা হে’ গানটা গাইলাম। রেকর্ডিংয়ের সময় মনে হয়েছিল কেন পিসিমণির এই গানটা রেকর্ডে না শুনে ওঁর কাছ থেকে, ওঁর পায়ের ধারে বসে আরও নিপুণ ভাবে শিখে নিলাম না।

বড় আপসোস হয় আজকাল। পিসিমণি থাকতে ওঁর কাছ থেকে সঙ্গীতের আরও অনেক সম্পদ আহরণ করার ছিল।

নিজের অজ্ঞাতেই করিনি। আরও অনেক গভীর ভাবে জানা উচিত ছিল ওঁকে। কিন্তু ছেলেমানুষির বশে নিজেকে নিয়ে বিভোর থেকেছি।

যতটা জানার, যতটা চেনার, যতটা শেখার তা হয়নি।

স্মৃতিকথন: সোহিনী মুখোপাধ্যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

kanika bandopadhay sanjukta basu sohini mukhopadhay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE