Advertisement
E-Paper

সহজ কথা সহজে বলা

অভিনয়ে যে যাঁর জায়গায় দুর্দান্ত। ছিমছাম গল্প বলার ধরনে ধ্রুপদী ছোঁয়া। লিখছেন সংযুক্তা বসুকথাশিল্পীর সহজ কথাকে সহজ ভাবে বলাটাই সবচেয়ে কঠিন কাজ। বিশেষ করে তা নিয়ে যখন সিনেমা হয়। প্রশ্ন ওঠে কী ভাবে ট্রিটমেন্ট করলে সিনেম্যাটিক হবে, অথচ মূল গল্পের নির্যাসও পুরোটা থেকে যাবে। উপন্যাস নিয়ে ছবি করলে সেখানে চিত্র-পরিচালকের নানা ‘ইমপ্রোভাইজেশন’কে গ্রহণ করার একটা অভ্যস্ততা অনেক দিন ধরেই দর্শক মনে তৈরি হয়েছে। কিন্তু ছোট গল্পের ক্ষেত্রে ‘আনপ্রেডিকটেবল’ যে চমকটা থাকে সেটা ছবিতে এল কি এল না, তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হতে পারে।

শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০১৪ ০০:০৫
সত্যজিৎ রায়ের ‘দুই বন্ধু’: রজতাভ ও পীযূষ

সত্যজিৎ রায়ের ‘দুই বন্ধু’: রজতাভ ও পীযূষ

কথাশিল্পীর সহজ কথাকে সহজ ভাবে বলাটাই সবচেয়ে কঠিন কাজ। বিশেষ করে তা নিয়ে যখন সিনেমা হয়।

প্রশ্ন ওঠে কী ভাবে ট্রিটমেন্ট করলে সিনেম্যাটিক হবে, অথচ মূল গল্পের নির্যাসও পুরোটা থেকে যাবে। উপন্যাস নিয়ে ছবি করলে সেখানে চিত্র-পরিচালকের নানা ‘ইমপ্রোভাইজেশন’কে গ্রহণ করার একটা অভ্যস্ততা অনেক দিন ধরেই দর্শক মনে তৈরি হয়েছে। কিন্তু ছোট গল্পের ক্ষেত্রে ‘আনপ্রেডিকটেবল’ যে চমকটা থাকে সেটা ছবিতে এল কি এল না, তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হতে পারে।

সেই তর্কের মারপ্যাঁচ থেকে রেহাই পেয়ে গিয়েছে সন্দীপ রায়ের সাম্প্রতিকতম ছবি ‘চার’। কারণ তিনি নির্বাচিত ছোট গল্পগুলিকে যথাসাধ্য সহজ ভাবেই তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন মূল গল্পের সঙ্গে মিল রেখে। নিউ এজ ছবিতে যে ভাবে গল্পের বিন্যাস হয় সেই স্টাইলের ধারে কাছে যাননি সন্দীপ রায়। মূল গল্পের মধ্যে ঢোকাননি কোনও নতুন ভাবনাও। ফলে কাঠামোগত ভাবে মোটামুটি মূল লেখাগুলিরই অনুসারী হয়েছে চিত্রায়ণ।

এই সারল্যই ‘চার’য়ের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। প্রত্যেকটা গল্পই ছবির শেষে মানবিকতায় উত্তীর্ণ। মানুষের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ‘মানুষ’কে খুঁজে বের করে যে গন্তব্যে পরিচালক পৌঁছে দিতে চেয়েছেন, তার যাত্রা দর্শককে শান্ত মেজাজের একটি পূর্ণাঙ্গ ছবি উপহার দিয়েছে। যদিও সেখানে চারটি গল্পের অন্তর্নিহিত মনন চার রকম।


পরশুরামের ‘বটেশ্বরের অবদান’:
পরাণ ও শাশ্বত


শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পরীক্ষা’:
কোয়েল ও আবির

সেই জন্যই ভাল লেগে যায় প্রথম গল্প পরশুরামের লেখা ‘বটেশ্বরের অবদান’য়ের পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। যিনি পেশায় লেখক। এবং তাঁরই গল্পের সৃষ্ট চরিত্রের জীবনের নিয়তিকে বদলে দিতে স্কেচের মতো সংক্ষিপ্ত আঁচড়ে হাজির হন তিন চরিত্র। জঙ্গলের পথে পরাণকে অনুসরণ করে শুভ্রজিৎ দত্তের আবির্ভাব ও নাটকীয় কথোপকথন কিংবা ডাক্তারের ভূমিকায় শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের প্রায় হুমকি দিয়ে যাওয়া, কিংবা শ্রীলেখা মিত্রের অভিনেত্রী সেজে এসে পরাণের সৃষ্ট চরিত্রের পরিণতি বদল নিয়ে লাস্যময় খুনসুটিপ্রত্যেকটা দৃশ্যই যেন ছুঁয়ে ফেলে ছোট গল্পের অনিশ্চিত মেজাজকে। অসাধারণ অভিনয় করেছেন পরাণ। এই ছবি দেখতে গিয়ে মনে পড়ে গেল তাঁরই অভিনীত তারিণীখুড়োর কথা, মনে পড়ে গেল ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’র পুলক ঘোষালকে আবারও।

বহু বার পড়া সত্যজিৎ রায়ের ‘দুই বন্ধু’ গল্প আমাদের দারুণ ভাবে চেনা। এবং চলচ্চিত্র হয়ে ওঠার মূল্যেও অতুলনীয় হয়েছে পরিচালকের হাতে। কৈশোর-বিচ্ছিন্ন দুই বন্ধুর দেখা হওয়ার কথা ছিল পঁচিশ বছর বাদে। নির্ধারিত দিনে সেই নাটকীয় সাক্ষাতে দর্শক চমকে না উঠে পারবেন না। পঁচিশ বছরের বদলকে বেশ চমকপ্রদ ভাবে বিন্যস্ত করেছেন পরিচালক। রজতাভ দত্তের অভিনয় যেন তাঁর নিজেরই শিল্পীসত্তার সঙ্গে টক্কর দেয়। তাঁর পাশে নিরীহ-সরলপ্রাণ অন্য বন্ধুর চরিত্রে পীযূষ বা তাঁর স্ত্রী হিসেবে সুদীপ্তা চক্রবর্তী সংক্ষিপ্ত উপস্থিতিতেই দিয়েছেন তাঁদের ‘সাবডিউড’ অভিনয়ের মাস্ট্রার স্ট্রোক। তবে সত্যজিৎ রায়েরই লেখা ‘কাগতাড়ুয়া’ গল্পটি যেন কিছুতেই ঈপ্সিত চমকে পৌঁছোয় না। মনে হয় এই গল্পটি পড়ার পক্ষে যত ভাল, ছবি হওয়ার পক্ষে ততটা ঘটনাবহুল নয়। একেবারেই অপার্থিব অনুভূতির গল্প যেটার চিত্রনাট্য রচনা সহজ নয়। শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় ভাল অভিনয় করার চেষ্টা করলেও সিনেম্যাটিক নিক্তিতে এ গল্প অন্য গল্পগুলির আবেদনের চেয়ে খানিকটা পিছিয়ে।


সত্যজিৎ রায়ের ‘কাগতাড়ুয়া’: শাশ্বত

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পরীক্ষা’ অবলম্বনে শেষ গল্পটি অবশ্যই ভিন্ন স্বাদের। চল্লিশ দশকের ‘পিরিয়ড পিস’ কেমন হবে তা দেখার অধীর অপেক্ষা ছিল। আবীর আর কোয়েলকে দেখতেও বেশ সাবেকি মনে হয়। আবিরের সহজাত স্বচ্ছন্দ অভিনয় এখানেও একই রকম প্রাঞ্জল। কোয়েল ছবিতে নিজের অভিনয়ের ধারাকে ইতিবাচক ভাবে ভাঙার চেষ্টা করে পরিণত অভিনেত্রী হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তাঁর অভিব্যক্তির প্রতি বাঁক-ঝোঁকে অন্য ধারার ছবিতে মননশীল অভিনয় দিয়ে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস স্পষ্ট।

অনসম্বল কাস্টের ছবিতে শিল্পী নির্বাচনের ক্ষেত্রে পরিচালকের পছন্দকে তারিফ করতেই হয়। মানিক ভট্টাচার্যের শিল্প নির্দেশনায় ছবির আসবাব চয়ন, ঘরের রং, অন্যান্য প্রপস্-য়ে একটা গ্রে টোন ধরা থাকে। যার ফলে চরিত্রগুলি নিজস্ব রং নিয়ে উজ্বল আর ছিমছাম হয়ে বেরিয়ে আসে সিনেমাটোগ্রাফার শীর্ষ রায়ের মায়াবী আলোছায়ার খেলায়।

সারল্য আর সহজ কথা, সহজ ভাবে বলার সাফল্যই যে ‘চার’য়ের সব চেয়ে অলঙ্করণ এটা না মেনে নিয়ে উপায় নেই। আর ক্ল্যাসিকাল ভঙ্গিতে গল্প বলার মধ্যে একটা অভিজাত আবেদন তো থাকেই। সেই আবেদন ও রুচিবোধ দর্শককে স্পর্শ করারই কথা।

sanjukta basu dui bondhu bateshwarer abedan porikkha kaktaruya
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy