Advertisement
১০ মে ২০২৪

সময়ের দাবি মেনে সমন্বয়ের বার্তা

ছবিটা দেখার পর নিজেদের চারপাশে বিজলিবালার মতো মানুষদের অভাব বোধ হবে। অথচ এই তো ক’দিন আগেও তাঁরা ছিলেন। ছিল সেই ইস্পাতকঠিন মূল্যবোধও। পলকে পরকে আপন করে নেওয়া, অকাতরে আশ্রয় বিলানো স্নেহের প্রতিমূর্তি।

ছবির দৃশ্য

ছবির দৃশ্য

সায়নী ঘটক
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০১৯ ০১:২৮
Share: Save:

বিজলিবালারা হারিয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে তাদের সংস্কার, আচার, মূল্যবোধ সবই। কিছু ক্ষেত্রে তা যেমন মানবিকতার পথে অন্তরায়, তেমনই কোনও কোনও ক্ষেত্রে সেগুলোই আমাদের বেঁধে রাখে। মতি নন্দীর উপন্যাস ‘বিজলিবালার মুক্তি’র আধারে গৌতম হালদারের ছবি ‘নির্বাণ’-এর প্রদর্শন ছিল কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। বেশ কিছু বছরের পুরনো উত্তর কলকাতায় নিয়ে গেল ছবির ফ্রেমগুলো। অলিগলি খুব চেনা, কাছের। এবং পাল্টে যাওয়া সময়ের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে ভীষণ প্রাসঙ্গিক।

ছবিটা দেখার পর নিজেদের চারপাশে বিজলিবালার মতো মানুষদের অভাব বোধ হবে। অথচ এই তো ক’দিন আগেও তাঁরা ছিলেন। ছিল সেই ইস্পাতকঠিন মূল্যবোধও। পলকে পরকে আপন করে নেওয়া, অকাতরে আশ্রয় বিলানো স্নেহের প্রতিমূর্তি। সযত্ন লালিত বিশ্বাস আর আচার-বিচারের পাহাড় ডিঙিয়ে বড় হয়ে ওঠে মানবিক মুখ। ছবিতে বিজলিবালার চরিত্রে রাখী গুলজ়ার ছাড়া আর কাউকে ভাবা কঠিন। চরিত্রটা যেন তাঁর জন্যই লেখা। আর তা হয়েও উঠেছেন তিনি।

পরিচালক গৌতম জানালেন, প্রবীণ অভিনেত্রীকে রাজি করাতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল তাঁকে। ‘‘প্রায় বছর সাতেক অপেক্ষা করেছিলাম। শেষ পর্যন্ত প্রস্তাবটা যে দিন দিয়েছিলাম, সে দিনই ওঁর নাতির জন্ম হয়।’’ গল্পেও বিজলিবালার এক নাতি রয়েছে। রক্তের সম্পর্কের চেয়েও তা দামি। কাহিনির শেষে বৃদ্ধার পরম আরাধ্য নারায়ণ শিলা নিয়ে খেলা করে সেই শিশু আর মোক্ষের পথ খুঁজে পায় বিজলিবালা— এ দৃশ্য হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া। অভীক মুখোপাধ্যায়ের ক্যামেরা কলকাতার আনাচ-কানাচে যে ভাবে ঘুরেছে, তা বহু পরিচিত হলেও আরাম দেয় চোখকে। ময়দানে ভোরের কুয়াশা, পায়রাদের জমায়েত, তারে টাঙানো ক্লিপে জলবিন্দুকে খুব আপনার লাগে। নেপথ্যে রাশিদ খান এবং রূপঙ্করের কণ্ঠ ভাল লাগার ঝিম ধরায়।

এ ছবিতে বিজলিবালার উপস্থিতি সবচেয়ে জোরালো। আর পার্শ্বচরিত্র হিসেবে যেন পুরো উত্তর কলকাতাই জীবন্ত হয়ে উঠেছে। বিদিতা বাগ-সমদর্শী দত্তের জুটি ‘ইচ্ছে’ ছবির পরে আরও একবার ‘ফ্রেশ’ লাগে। যদিও সমদর্শীর আড়ষ্ট অভিনয় কোথাও কোথাও চোখে লাগে। চৈতী ঘোষালকে আরও একটু পাওয়া গেলে ভাল লাগত। গল্পে বিজলিবালার ছায়াসঙ্গী পদ্ম। বাস্তবেও রাখী গুলজ়ারের তেমনই এক ছায়াসঙ্গী আছেন। প্রবীণ অভিনেত্রীর কথায়, ‘‘শুটিংয়ের সময় পদ্মকে দেখলেই আমার সুনীতার কথা মনে পড়ত। সারা দিন কাজকর্ম সেরে আমার কাছে এসে বসত গল্প শুনতে।’’ গল্প কম হয়নি ‘নির্বাণ’-এর সেটেও। পরিচালক জানালেন, প্রত্যেক দিন শুটিং শেষে বিকেলে মুড়ি-তেলেভাজা খেতে খেতে রাখীকে ঘিরে বসে পড়ত গোটা ইউনিট, স্রেফ গল্প শুনবে বলে। আসলে আড্ডা জিনিসটা তো উত্তর কলকাতার রন্ধ্রে মেশানো। ছবিতেও এসেছে রোয়াকে আড্ডা, পড়শির দরদী মুখ, সকলে মিলে রথের রশিতে টান। সব মিলিয়ে যেন এক পারফেক্ট হারমনি।

ধর্ম বা জাতপাত নিয়ে যখন নতুন করে কথা বলার দরকার হয়ে পড়েছে, সেই সময়ে আরও বেঁধে বেঁধে থাকার জন্যই প্রয়োজন বিজলিবালাদের। ফেস্টিভ্যালের চত্বর পেরিয়ে আমজনতার কাছে পৌঁছনো জরুরি ‘নির্বাণ’-এর মতো ছবি। হাসি হোক কিংবা হাসিনা বানো, কারও নাম-পদবি যেন মুখের হাসি মুছে দিতে না পারে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Nirban Mati Nandi Goutam Halder
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE