ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল
ভোরের আগেই ঘুম ভাঙে এক কাজলভরা ক্লান্ত চোখের। আর সেই রাতের চোখে লেগে থাকে মাতাল স্বামীর অত্যাচারের চিহ্ন।
এই চোখের নাম নয়নচাঁপা।
শহরের রাস্তায় রাত নামলেও নয়নচাঁপার রাতজাগা মন তখন ভোরের অপেক্ষায়। বাবুদের বেডরুমের সকাল নামে তো নয়নের গরম চায়ের পেয়ালায়।
সন্তানের খিদে মেটানোর দায় বয়ে চলে নয়নচাঁপা। সেই দায়িত্ব পালন করতেই শহুরে ভদ্র বাড়ির ঠাকুরের সিংহাসনে ধূপ যেমন তাকেই জ্বালাতে হয়, তেমনই আবার বিপত্নীক, লোভী ‘বাবু’র বিকৃত যৌন আচরণও তাকে মেনে নিতে হয় বিনা প্রতিবাদে। দিনের শেষে ঘরে ফেরার রাত তার জন্য নিয়ে আসে লম্পট স্বামীর মানসিক, শারীরিক নির্যাতন। তবুও সে বাঁচে।
শেখর দাশের ‘নয়নচাঁপার দিনরাত্রি’ এক কঠিন বাস্তবের ছবি আমাদের সামনে তুলে ধরে। ছবিটা দেখতে দেখতে মনে হয় শুধুই কি নয়নচাঁপা? আমাদের বাড়ির দুপুরের ভাতের থালার গুছোনো পদ বা অলস বিকেলের আবদারের কফি যার হাতের উষ্ণতায় হাসি ছড়ায়, সে তো নয়নচাঁপার মতোই কেউ।
অথচ সেই সব নয়নচাঁপার খবর আমরা কেউ রাখি? রাখি না।
অকারণে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে গেলে সহজেই চুরি বা চরিত্রহীন বলে ভদ্রসমাজের আমরা তাকে এড়িয়ে চলি। মাতাল স্বামীর ভয়ানক পিটুনির পরেও সে কেমন একলা রাতের অন্ধকারে, ঝড়ের নেশায় নিজেকে ভাসিয়ে নিয়ে বেঁচে থাকে। ছবির এই দৃশ্যে রূপার অভিনয় দর্শকদের ছুঁয়ে যায়। মনে হয় যেন সন্তান আর নিজের জন্যই তার বেঁচে থাকার ইচ্ছে এত প্রবল।
শুধুই নয়নচাঁপা নয়, কলকাতার পথে নামা বহুরূপী, ট্রেনের বাউল গায়ক বা কোনও অন্ধ ভিখারি ছবিতে বারবার নানা ঘটনায় ফিরে ফিরে এসেছে। সাজানো ড্রইংরুমের ওয়াইন চুমুকের বাঙালির পরকীয়া প্রেমের বাইরে গিয়ে বহু দিন পর বাংলা ছবিতে এমন প্রান্তিক মানুষের জীবনছবি শেখর দাশের ক্যানভাসে ধরা পড়ল। এর জন্য তাঁর সাধুবাদ প্রাপ্য।
নয়নচাঁপার যন্ত্রণা, বাবুর বাড়ির পাওনা আদায় করতে যাওয়ার ঝাঁঝালো স্বর, ঝড়ের সঙ্গে একলা কথার রোম্যান্স, ভুলুর মায়ের আবেগ— একই চরিত্রের নানা স্তরের ওঠানামা, রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের দুরন্ত অভিনয় দর্শকদের মনে গেঁথে গিয়েছে। ভাল লেগেছে চান্দ্রেয়ী ঘোষের বাচনভঙ্গি, অভিনয়। ছবিতে দামিনী বসুর অভিনয় এতটাই স্বাভাবিক যে তাঁকে মালতী ছাড়া অন্য কিছু মনে হয় না। বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী, বরুণ চন্দ, অলকানন্দা রায়ের অনায়াস অভিনয় শিক্ষিত সমাজের অন্দরের ছবিটাকে চিনতে সাহায্য করেছে। দেবজ্যোতি বসুর পরিচালনায় ছবির সঙ্গীত যথাযথ। স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত ও শ্রীকান্ত আচার্যর দরদি কণ্ঠে ‘দয়া দিয়ে হবে গো’ গানটির দৃশ্যায়ন মন ছুঁয়ে যায়।
প্রান্তিক মানুষের জীবনের মধ্যে দিয়ে পরিচালক সমসাময়িক সমাজের ছবি তুলে ধরতে চেয়েছেন। ছবিতে এসেছে চিটফান্ড, মাওবাদী প্রসঙ্গ। চিটফান্ডের খপ্পরে পড়ে গ্রামের মানুষের সর্বস্বান্ত হওয়ার ঘটনা দশর্কদের নাড়া দেয়।
শঙ্খের সম্পাদনা চিত্রনাট্যের মেজাজকে ধরে রাখলেও ছবিটিকে কখনও কখনও ডকু-ফিচার বলে মনে হয়। আজকের সময়ের কথা যে ছবি বলে তা কেবলমাত্র নয়নচাঁপার লাঞ্ছনা আর নির্যাতনের শেডটাকেই কেন তুলে ধরবে? নয়নচাঁপা কি কেবলই স্বামীর অত্যাচার আর বাবুদের অশালীন ইঙ্গিত সহ্য করেই বাঁচবে? ঝড়ের সঙ্গে একলা থাকা দাপুটে নয়নচাঁপা তো কোথাও স্বামীর বিরুদ্ধে গিয়ে সন্তান পালনের মধ্যে দিয়ে একলা থাকার আনন্দকেও বেছে নিতে পারত। পরিচালক সেই ইঙ্গিত দিলে ছবিটি আরও জীবন্ত হত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy