Advertisement
০৩ মে ২০২৪

ঋতুকে ভালবাসলে প্লিজ কাউকে ‘লেডিস’ বলে বিদ্রুপ করবেন না

দেখতে দেখতে মৃত্যুর এক বছর হয়ে যাচ্ছে আগামী শুক্রবার! অথচ ঋতুপর্ণ ঘোষ সম্পকের্র্ হেঁয়ালি, অমীমাংসিত জিজ্ঞাসা আর কুয়াশার আস্তরণ যেন কাটার নয়। আনন্দplus-এর জন্য কলম ধরলেন প্রয়াত পরিচালকের নিকটআত্মীয়। ভাসুর-য়ের স্মৃতিচারণ এ ভাবে দেখতে চান না দীপান্বিতা ঘোষ মুখোপাধ্যায়। তিনি যে বহু বছরের ঘনিষ্ঠ বন্ধুও...যে বয়সে দু’টো মুঠোয় কেশর চেপে ধরে সিংহের পিঠে সওয়ার হয়ে মানুষ ফিনিক্স পাখির ডিম আনতে যেতে পারে, কোনও নিদাঘবেলায় চাঁদের কণা খুঁজে পেতে পারে, অ্যাসফল্টের রাস্তায় বৃষ্টিস্নান করে ময়ূরপেখম মেলতে পারে, ঋতুর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল সেই অমোঘ অষ্টাদশে।

শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০১৪ ০০:২১
Share: Save:

যে বয়সে দু’টো মুঠোয় কেশর চেপে ধরে সিংহের পিঠে সওয়ার হয়ে মানুষ ফিনিক্স পাখির ডিম আনতে যেতে পারে, কোনও নিদাঘবেলায় চাঁদের কণা খুঁজে পেতে পারে, অ্যাসফল্টের রাস্তায় বৃষ্টিস্নান করে ময়ূরপেখম মেলতে পারে, ঋতুর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল সেই অমোঘ অষ্টাদশে।

আমাদের কারও বাবা চাকরি করতেন হিন্দুস্থান লিভারে। কারও বাবা রেলে। কারও মা স্কুলে পড়াতেন। কেউবা ঘরবৌ। শুনলাম ঋতুর বাবা চাকরি করলেও সঙ্গে নাকি ডকুমেন্টারি ফিল্মও বানান। আর মা নাকি ছবি আঁকেন। ও-ও সিনেমা বানাবে। তবে বাবা-মায়ের চাপে ইকনমিক্স পড়তে আসতে হয়েছে।

“সাহিত্য পড়ে তো আর চাকরি পাওয়া যাবে না।”

“তা মাসিমা-মেসোমশাই দু’জনেই শিল্পী মানুষ। ওঁরা চান না তুই ডিরেক্টর হোস? এ তো আমাদের বাবা-মা নন, যে কালের নিয়মের বাইরে যেতেই পারবেন না,” চিরকাল আমাদের কমন বন্ধু মীনাক্ষী সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করত।

“আরে, তাই জন্যই তো চায় না। শিল্প করে পেট ভরে না, এ তো আমার বাবা জীবন দিয়ে বুঝেছে।”

ধীরে ধীরে জানতে পারলাম, ঋতুর একজন বয়ফ্রেন্ড আছে। ইকনমিক্সের ছাত্র হলেও সেই সময়ে ও গোটা কয়েক ইংরেজি পড়ানোর টিউশনি করত। তবে সুবোধ বালকের মতো পুরো টাকাটাই মায়ের হাতে তুলে দিত। বয়সে বেশ বড় বয়ফ্রেন্ডটি একটি মেয়ের প্রেমে জখম হয়ে ঋতুর ডানায় আশ্রয় নিয়েছিল। তাই হতাশা কাটাতে হামেশাই কিছু কিছু টাকাপয়সার প্রয়োজন হত! মাঝেমধ্যেই আমার আর আমাদের আর এক বন্ধু মীনাক্ষীর কাছ থেকে ধার করত। রক্ষণশীল পরিবারের শক্তপোক্ত কাঠামোর ফাঁক দিয়ে খুব বেশি টাকাপয়সা মীনাক্ষীর কাছেও আসত না।

তাই বোঝা যাচ্ছিল, এমন করে খুব বেশি দিন চলবে না।

ওই বয়সের ছেলেমেয়ের তুলনায় ওর দু’টো বৈশিষ্ট্য আমাকে এক রকম মুগ্ধই করেছিল বলা যায়।

প্রখর বাস্তববাদ আর দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর ক্ষমতা।

বাস্তবতার নিরিখটা অবশ্য ওর ব্যক্তিগত এবং সমাধান নিজের জন্য স্বস্তিকর হওয়াটা জরুরি ছিল। খবরের কাগজ দেখে এক কেরল সমাজ বের করল যারা কলকাতায় দাক্ষিণাত্য শ্রমিক শ্রেণির উন্নতিকল্পে সপ্তাহে দু’দিন করে কথ্য ইংরেজির ক্লাস করে। মাসে তিনশো টাকাও ও রোজগার করত। তার পুরোটাই উত্‌সর্গ হত আঘাত জর্জরিত হতাশ্বাস হদয়ে প্রেমের জোয়ার আনতে।

ঋতু ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন দেখত রেখা হবে

টাকার অঙ্কটা কিন্তু সময়ের নিরিখে ঈর্ষণীয় বলা যায়। সেই সময় পরিবারসুদ্ধু বাইরের ঘরে ঘেঁষাঘেঁষি বসে এক সঙ্গে রেপের খবর শোনা বা এলজিবিটির প্রকাশ্য সমাবেশ দেখার চলন ছিল না। ছেলের বয়ফ্রেন্ড ব্যাপারটা অশোভন বলে মনে করা হত। আজও মনে পড়ে এমনতর তথ্যের অভিঘাতে বিচলিত হইনি।

ও যে একটা মানুষকে ভালবাসতে চায় তার আকুতিটা এত সত্যি, এত আন্তরিক, এত মূলে প্রোথিত ছিল যে তা অস্বীকার করবার মতো কোনও জোর আমার কাছে ছিল না। টাকা দেওয়া নেওয়ার ব্যাপারে তিলমাত্র সংশয় যদি বা মীনাক্ষীর ছিল, ঋতুর অকাট্য যুক্তির ফুত্‌কারে তা উড়ে গিয়েছিল। টাকা কী হবে বল যদি আমি ওর চোখে জল দেখি। গণসঙ্গীত, সাহিত্য, ছায়াছবি, প্রেম, অন্য প্রেম, প্রত্যাখ্যান, জীবনবোধের মূল্যায়ন ইউনিভার্সিটির দিনগুলো কেটেছিল ঝোড়ো হাওয়ার মতো।

তার পর হাঁটি হাঁটি পা পা, জীবনের রাস্তায় হাঁটতে শেখা, হোঁচট খাওয়া, উঠে দাঁড়ানোর জন্য কখনও বাড়ানো হাত আছে, কখনও নেই।

কে কোথায় ছিটকে গেলাম কফি হাউস, অ্যামেনিটি সেন্টার বা লবির কোনও আড্ডাই আর রইল না। কলকাতার বাইরে চলে গেলাম আমি। কিন্তু ওর সঙ্গে যোগাযোগটা রয়েই গেল। মোবাইল আমাদের দ্রুত যোগাযোগের সহায় হয়েছে।

তবে পত্রসাহিত্য থেকে বঞ্চিত করেছে তা নিশ্চিত। লম্বা লম্বা চিঠি দেওয়া-নেওয়া হত আমাদের। অনেক সময় ওর বিশেষ বন্ধু বদলের কথা থাকত, থাকত ইউফোরিয়া, থাকত ভগ্নহৃদয়, না-বলা কথা, বঞ্চনা আর প্রত্যাখ্যানের প্রবাহ। থাকত অসম্ভবকে সম্ভব করার নিশ্চিত প্রতিজ্ঞা। ‘তোমার অভিসারে যাব অগম পাড়ে,

চলিতে পথে পথে বাজুক ব্যথা পায়ে...’। এমনি করেই সে অনেক দিন ভেসে গেল।

পরবর্তী পর্যায়ের তথ্যটা বোধহয় খুব বেশি লোকের অজানা নয়। ‘হিরের আংটি’তেই সামান্য যা হোঁচট খেয়েছিল, তার পর শুধুই উড়ান। ওর জন্য সাফল্যের পথটা ছিল অবন্ধুর অভ্যুদয়ের। দ্বিতীয় ছবি থেকে প্রায় টানা জাতীয় পুরস্কার, আনন্দলোকের সম্মাননীয় সম্পাদকের পদ, খ্যাতির শীর্ষে থাকা মুম্বই তারকাদের কলকাতায় নিয়ে এসে কাজ করানো, ‘এবং ঋতুপর্ণ’ হয়ে ওঠার পথটা ছিল অতি প্রশস্ত। একটু ঝুল বড় পাঞ্জাবি, গায়ে হলুদ মাখা বা এক হাতে সুযোগ পেলেই গাদাখানেক আংটি পরা এ প্রবণতা ওর ছাত্রাবস্থাতেই ছিল। এ বার সঙ্গে যোগ হল, ছোট বড় মেজ সেজ, নানা মাপের ফিল্মস্টার প্রেমিকপ্রবরের দল। আত্মবিশ্বাস আর অহংকারের মধ্যে যে সূক্ষ্ম রেখাটা রয়েছে, সাধারণ থেকে সেলিব্রিটি হওয়ার নিরবচ্ছিন্ন পথে তা যে মানুষ কখন পেরিয়ে যায়, তা সে নিজেও জানে না।

ঋতু ব্যতিক্রম ছিল না, বা ছিল। তেমন পছন্দের নয় কেউ দেখা করতে এলে বা ফোন করলে বাড়িতে থেকেও বলে দেওয়া বাড়িতে নেই, যাব বলে না যাওয়া, কথা দিয়ে কথা না রাখা, আত্মীয়স্বজনের বিয়ে-পৈতেতে তুলনামূলক ভাবে কম উপস্থিত থাকা ইত্যাদি অনুষঙ্গ দ্রুত দেখা গেল।

যে জায়গায় ব্যতিক্রম ছিল, সেটা হল ও জানত মানুষ ঋতুর সত্যি অর্থে প্রেমিক পাওয়ার সাধ্য হয়তো হবে না। হবে অর্থে-সামর্থ্যে বলীয়ান নির্দেশক ঋতুপর্ণ ঘোষের।

তাই এক দিকে আত্মবিশ্বাস যেমন বেড়েছে, অন্য দিকে কমেছে। চাপানউতরের মধ্যে অল্পবয়সি কোমল মনকে আগল দিতে বৃহত্তর সাফল্যের কথা, যা দিয়ে কোনও পুরুষসঙ্গীকে বাঁধতে পারবে ভাবতে ভাবতে প্রতিদিন ক্লান্তিতে ঘুমাতে গিয়েছে।

তার পর তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে, তিরপূরণির ঘাট পেরিয়ে একদিন কূল মিলল ওর। ছোটবেলা থেকে ঋতু স্বপ্ন দেখত রেখা হবে। ডিভা। পেল ‘আর একটি প্রেমের গল্প’তে মুখ্য ভূমিকা এ বার বুঝি স্বপ্ন সত্যি হয়! তার বেশ কয়েক বছর আগে মা চলে গিয়েছে। বাবা এক রকম বাহ্যজ্ঞানরহিত বলা যায়। আমার শাশুড়ি কোনও দিনই ঠিক বাঙালি মায়েদের ধরনে পুত্রগরবে গরবিনী ছিলেন না। নিজের মতো করে বাস্তববাদী হওয়ার ধরনটা ওর মায়ের কাছ থেকেই পাওয়া। আমার শ্বশুর ছিলেন প্রতিভাবান শিল্পী, কনফর্মিস্ট বা স্ট্রিক্ট মরালিস্ট গোছের। অনেক দিন পর্যন্ত বিশ্বাস করতেন আশেপাশের বন্ধুরাই ঋতুকে বিগড়ে দিয়েছে। বিয়ে দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে...

(আগামী সংখ্যায় শেষ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

rituparna ghosh dipanwita ghosh mukhopadhay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE