Advertisement
১১ মে ২০২৪
আনন্দplus এক্সক্লুসিভ

ছোটদের ছবি

নায়কের উচ্চতা সাড়ে তিন ফুট। নায়িকা তিন ফুটের। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়-এর পরের ছবি এই ছোট মানুষদের নিয়ে। খবর দিচ্ছেন ইন্দ্রনীল রায়।নায়কের উচ্চতা সাড়ে তিন ফুট। নায়িকা তিন ফুটের। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়-এর পরের ছবি এই ছোট মানুষদের নিয়ে। খবর দিচ্ছেন ইন্দ্রনীল রায়।

 তাঁর নতুন ছবির নায়ক-নায়িকার সঙ্গে পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়  ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।

তাঁর নতুন ছবির নায়ক-নায়িকার সঙ্গে পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।

শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০১৪ ২১:৪২
Share: Save:

আগের ছবি ‘খাদ’য়ে টালিগঞ্জের ১৬জন নামী অভিনেতা-অভিনেত্রীকে নিয়ে শ্যুটিং করেছিলেন সিকিমে।

তার আগের ছবি ‘অপুর পাঁচালি’তে ছিল পরমব্রত-পার্নোদের মতো চেনা নাম।

তার পর? তার পর আবার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে চমকে দিচ্ছেন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর পরবর্তী ছবিতে কোনও ‘বড়’ নাম নেই। নেই কোনও ‘বড়’ অভিনেতা।

পুরো ছবিতে নায়ক, নায়িকা, পার্শ্বচরিত্র, জুনিয়র আর্টিস্ট সবাই বামন। ডোয়ার্ফ। গড়ে উচ্চতা সাড়ে তিন ফুট। এ বার এই বামনদের নিয়েই গল্প বুনেছেন পরিচালক। নামটাও গল্পের সঙ্গে তাল রেখে দেওয়া হয়েছে, ‘ছোটদের ছবি’। প্রযোজনা করছে শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মস্।

টেলিফিল্ম থেকে ছায়াছবি, প্রতি ফিল্মের বিষয়বস্তুতে নতুনত্বের ছোঁয়া আনার জন্য কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা আলাদা স্থান রয়েছে টলিউডে।

এ বার যেন আরও বড় রিস্ক নিচ্ছেন তিনি। এই রকম একটা রিস্কি ‘ছোটখাটো’ ছবি বানানোর পিছনে প্রথম ভাবনাটা কী ছিল পরিচালকের?

“ভাবনা তো সেই এক। ওরাও মানুষ। তাই ওদের গল্প আমাকে বলতে হবে,” হাসতে হাসতে বলেন কৌশিক।

আর কবে লেখা শুরু করলেন এই ছবিটা?

“লিখতে আমার প্রায় দেড় বছর লেগেছে। ওদের নিয়ে একটা ছবি লেখা চাপের, কারণ ওদের জীবনটা ভীষণ অনাড়ম্বর। ওই অনাড়ম্বর জীবনটা যাতে বেশি মেলোড্রামাটিক আর ক্লিশে না হয়ে যায়, সেটাই আমার কাছে সব চেয়ে চ্যালেঞ্জিং ছিল,” অকপটে বললেন পরিচালক।

কথা বলতে বলতেই বোঝা যায়, বামনদের জীবনের আচারআচরণ, তাদের কথা বলার ভঙ্গি সব ব্যাপারেই বেশ ডিটেলে স্টাডি করে রেখেছেন আনন্দplus বায়োস্কোপে বাজিমাতের বিজয়ী পরিচালক।

“আমার কাছে যেটা ইন্টারেস্টিং তা হল, ওদের মধ্যে কেউ বন্দ্যোপাধ্যায়, কেউ মুখোপাধ্যায়, কেউ রায়... কেউ হিন্দু কেউ মুসলমান। কিন্তু আশ্চর্যের, যে ওরাও নিজেদের পরিচয় প্রায় ভুলেই গিয়েছে। আজকের সমাজে ওরা ফিজিক্যাল মাইনরিটি। আমরা ওদের ‘বামন’ বলি। ওরা নিজেরা নিজেদের ‘নাটা’ বলে। ওদের কি এটা ছাড়া আর কোনও পরিচয় হতে পারে না? ওদের দুঃখ-কষ্ট আমাদের থেকে অনেক বেশি। এই মানুষগুলোর জীবনের দর্শনটাই এমন হয়ে গিয়েছে, দে ক্যানট থিঙ্ক বিগ। এই ছোট ছোট জায়গাগুলো ধরার জন্যই ছবিটা করছি,” বলছেন তিনি।

তাঁর কাছ থেকেই জানা গেল, এই ছবিতে যিনি নায়কের চরিত্রে অভিনয় করবেন, তাঁর নাম দুলাল সরকার। থাকেন হাওড়াতে। আর নায়িকা হচ্ছেন বারুইপুর নিবাসী উমা রায়।

এঁদের কাউকে আনা হচ্ছে আরামবাগ থেকে। কাউকে বারুইপুর থেকে। কেউ আসছে অসম থেকে। তো কেউ ঝাড়গ্রাম থেকে।

এবং ছবির জন্য প্রচুর বই-পত্রও ঘেঁটেছেন নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের এই প্রাক্তন ছাত্র।

“কিছু পড়াশোনা করেছি, কিন্তু সে রকম কিছু নয়,” বিনয়ের স্বরেই বলেন তিনি। “কিছু রেফারেন্স ওয়ার্ক করেছি। যেমন জানতে পেরেছি কোনও বিয়ে হোক, কী শ্রাদ্ধ, প্রথম যে সংস্কৃত মন্ত্রটা পড়া হয় তা বামন অবতারের মন্ত্র। পৃথিবী তৈরির সময় প্রথম মানুষ বরাহ অবতার। সেখান থেকে সভ্যতার বিবর্তনে ওদের শুধুই অ্যাবিউজ শুনতে হয় আমাদের পৃথিবীতে। ওদের মধ্যে প্রেম হয়, বিয়ে হয়, বাচ্চা হয়। কিন্তু কী আশ্চর্য, ওই বিবাহিত দম্পতি যখন রাস্তায় হাঁটে দু’জনকেই আলাদা আলাদা ভাবে টিটকিরি শুনতে হয়। এত অ্যাবিউজের মধ্যেও ওই দম্পতি নিজেদের মধ্যে ভালবাসা, রোম্যান্স, একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাটা টিকিয়ে রাখে কী করে? এটা আমার কাছে ফ্যাসিনেটিং একটা জগৎ,” বলেন চুর্ণী গঙ্গোপাধ্যায়ের বেটার-হাফ।

কিন্তু আজকের এই স্টার সর্বস্ব ইন্ডাস্ট্রিতে যেখানে নতুন অভিনেতা-অভিনেত্রীকে নেওয়াটাই ঝুঁকি হিসেবে গণ্য করা হয়, সেখানে সব অভিনেতা-অভিনেত্রী বামন তো হাই রিস্ক জোন। কী মনে করছেন ছবির প্রযোজক শ্রীকান্ত মোহতা?

“রিস্ক কেন বলছেন! এটাই তো ছবির ইউএসপি। একটা সম্পূর্ণ ছবি হচ্ছে যেখানে নায়ক-নায়িকা সবাই শুধু নতুন নয়, তারা বামন। এর থেকে আলাদা আর কিছু হতে পারে কি? আর কৌশিকদার যে দর্শক আছে, তাঁরা কৌশিকদার থেকে এমন চিন্তাধারার ছবিই এক্সপেক্ট করে। আর ‘আপ্প্ু রাজা’তে কমল হাসন ছাড়া এদের নিয়ে ছবির কোনও রেফারেন্স নেই। তাই সব দিক থেকে ‘ছোটদের ছবি’ সম্প্রতিক কালের সব চেয়ে ইউনিক ছবি,” বলছেন শ্রীকান্ত।

এই ছবির সিনেমাটোগ্রাফার সৌমিক হালদার। শোনা যাচ্ছে যেহেতু সবার উচ্চতা ছোট, তাই পুরো ছবিটা এই ‘ছোট মানুষ’দের পয়েন্ট অব ভিউ থেকেই শ্যুটিং করা হবে।

“আমরা নর্ম্যাল যে শ্যুটিং করি, সে রকম শ্যুটিং তো করতেই পারব না। আজ ফ্লোরে গেলে তো অভিনেতাদের সঙ্গে আই কনট্যাক্ট হয়। এখানে তো দাঁড়িয়ে থাকলে আই কনট্যাক্ট হবে না। তাই নর্ম্যাল শ্যুটও করা যাবে না। ওদের লেভেলে নামাতে হবে ক্যামেরা। সৌমিকও সে রকম ভাবছে। আর তা ছাড়া সৌমিক ক্যাননের একটা নতুন ছোট ক্যামেরাতে শ্যুট করবে বলে ঠিক করেছে। অন্য ছবিতে ব্যবহৃত বড় ক্যামেরা ওই ছোটখাটো মানুষদের ভয় পাইয়ে দিতে পারে,” বলছেন ‘শব্দ’য়ের পরিচালক।

ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করছেন ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত এবং আর্ট ডিরেকশনের দায়িত্বে রয়েছেন তন্ময় চক্রবর্তী কিন্তু এ রকম আনকোরা অভিনেতাদের দিয়ে অভিনয়টা করাবেন কী করে? ওদের কারওরই তো অভিনয়ের কোনও ব্যাকগ্রাউন্ড নেই!

“আমরা সাধারণ উচ্চতার দুর্বল অভিনেতাদের সঙ্গেও তো কাজ করি, তাই না? আমি ওদের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি ওরা অসম্ভব ইন্টেলিজেন্ট। ছোটবেলা থেকে অ্যাবিউজড্ হতে হতে, সেটা কমব্যাট করতে করতে একটা ন্যাচারাল রিফ্লেক্স তৈরি হয়ে গিয়েছে ওদের। সেটা ওদের অভিনয়ে কাজে আসবে। তা ছাড়া একটা ওয়ার্কশপও করছি ওদের সঙ্গে। সেখানে অ্যাক্টিংয়ের যেটুকু জড়তা থাকে, সেটা কেটে যাবে বলে আমার ধারণা,” বলেন ‘অপুর পাঁচালি’-র পরিচালক।

‘ছোটদের ছবি’র শ্যুটিং শুরু ৭ মে থেকে। যেহেতু অভিনেতা-অভিনেত্রীরা নতুন এবং সিনেমাজগতের সঙ্গে তাদের কোনও সম্পর্ক নেই, তাই ৪০-৫০ জনের ইউনিট না করে খুব ছোট ইউনিটে কাজ করা হবে এই ছবিতে, বলছেন প্রযোজক।

“আমরা বড় ইউনিট করছি না কারণ ৪০-৫০ জন লম্বা মানুষ সেটে দৌড়োদৌড়ি করছে, চেঁচামেচি করছে, এটা ওই মানুষগুলোকে ভয় পাইয়ে দিতে পারে। আজ অবধি ওদের সিনেমায় ব্যবহার করা হয়েছে জোকার হিসেবে, যে কলার খোসায় পা হড়কে পিছলে যাবে। কিন্তু এখানে তো ওদের নিয়েই পুরো একটা সিনেমা হচ্ছে। তাই ওদের কমফর্ট দেওয়াটাই আমাদের প্রধান কাজ,” বলছেন শ্রীকান্ত।

এবং ওদের কমফর্টেবল করার জন্য সিনেমার বড় লাইটও ব্যবহার করা হচ্ছে না ছবিতে। ছবিটার বেশির ভাগ শ্যুটিংটাই হবে ন্যাচারাল লাইটে।

সব শেষে এই ছবিটি নিয়ে বোধহয় শেষ কথাটা বলছেন স্বয়ং পরিচালকই।

“আমি একটাই জিনিসের গ্যারান্টি দিতে পারি। এই ছবিটার পর ওদের দেখেই হেসে ফেলতে আমাদের একটু হলেও অসুবিধে হবে। যেমন ‘আর একটি প্রেমের গল্প’র পর আমাদের ‘গে’ দেখলেই টিটকিরি মারতে অসুবিধে হত। আর শেষে বলি, আমরা অনেকেই তো সোশ্যাল ওয়ার্ক করি। আমার কাছে এই ছবিটা সিনেমার সোশ্যাল ওয়ার্ক। আর ‘ছোটলোক’ শব্দটার মধ্যে যে কত দুঃখ আছে, কত কান্না আছে, এই মানুষগুলোর জীবন দেখলে তা বুঝতে পারবেন,” বলেন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

indranil rai kaushik gangopadhay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE