‘থ্রি ইডিয়ট্স’ ছবির একটি দৃশ্য
মণি বাজপেয়ী, রাজ মদনগোপাল। প্রথম জন ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার, দ্বিতীয় জন মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার। ২০০২ সালে আমেরিকায় যখন দুজনের পরিচয় হয়, মণি তখন পিএইচডি-র ছাত্র। আর রাজ রোবোটিক্স নিয়ে এম ই করছেন। পরিচয় কবে গভীর বন্ধুত্বে গড়িয়েছিল, আজ তা কেউই মনে করতে পারেন না। দুই তরুণই মার্কিন মুলুকের লক্ষ টাকার লোভনীয় চাকরি ছেড়ে এখন ভারতে। লক্ষ্য একটাই, দেশের ময়লা দূর করা! ২০১৩ সালে দক্ষিণ ভারতে তাঁরা শুরু করেন ‘ব্যানিয়ান নেশন’। প্রাকৃতিক দূষণ কমিয়ে আধুনিক প্রযুক্তি এবং সামাজিক উদ্যোগের সাহায্যে ভারতের জমা নোংরা আবর্জনাকে রিসাইক্ল করে শক্তি উৎপাদন এবং জমি ভরাটই এই সংস্থার মূল উদ্দেশ্য। আমেরিকায় চাকরি করতে করতে মাঝে মধ্যেই দেশে ফিরতেন মণি। সে সময় দেশের বিভিন্ন শহর-নগর প্রান্তে জমা আবর্জনা দেখে বিরক্তই হতেন। ভাবতেন, এই অপচয় কি কোনও ভাবেই রোখা সম্ভব নয়! ‘একদম গ্রাসরুট থেকে ময়লা আবর্জনা সংগ্রহ করে, তা রিসাইক্ল করে এ দেশে একটা আধুনিক ‘ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট’ গড়ার স্বপ্ন থেকেই এই সংস্থার ভাবনা,’ বলছেন দুই বন্ধু। যে উদ্যোগ তাঁরা শুরু করেছেন, তার শাখাপ্রশাখা আজ দেশের বহু প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পৌঁছে গিয়েছে।
বিহারের এক চাষির ছেলে কৌশলেন্দ্র কুমার। ২০০৭-এর আইআইএম (আমদাবাদ) টপার। ২০০৮ সালের ‘এমটিভি ইয়ুথ আইকন’। সেই তরুণই কিনা বড় বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির লোভনীয় সব প্রস্তাব হেলায় দূরে ঠেলে এখন সবজি বেচছেন! ‘এমবিএ সবজিওয়ালা’ নামে খ্যাত এই তরুণের স্বপ্ন বিহারকে ভারতের ‘ভেজিটেব্ল হাব’-এ পরিণত করা। বলছেন, ‘ছোটবেলা থেকেই দেখতাম, চাষিদের পাশে কেউ নেই। চাষির ছেলে হওয়া সত্ত্বেও আমি অনেক দূর পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছি। তাই বিশেষ করে চাষিদের ছেলেমেয়েদের জন্য আমি কিছু করতে চেয়েছিলাম।’ প্রত্যন্ত অঞ্চলের চাষিদের যুক্ত করে বিশেষ ভাবে তৈরি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ভারবাহী গাড়িতে রাস্তায় রাস্তায় সবজি বিক্রির একটি মডেল তিনি চালু করেছেন। ফড়েদের আটকে চাষিদের হাতে ন্যায্য মূল্য পৌঁছে যাচ্ছে। ক্রেতারাও সুলভে সবজি কিনতে পারছেন। এই তরুণের স্বপ্ন, তাঁর এই মডেল এক দিন দেশের চিরাচরিত সবজি বিক্রির ব্যবস্থাকেই আমূল পালটে দেবে।
সিনেমায় নয়, বাস্তবের মাটিতেই ‘থ্রি ইডিয়ট্স’-এর ফুংসুখ ওয়াংড়ুর মতো শিশুদের একটি স্কুল খুলেছেন এক বাঙালি তরুণ। সিউড়ির ছেলে অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই স্কুল ‘লেভেলফিল্ড’-এর লক্ষ্য, ডিগ্রি অর্জনের বদলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যেন তাদের দেখা স্বপ্নগুলোকেই ফলো করে। আইআইটি (খড়গপুর) থেকে বি টেক, আইআইএম (আমদাবাদ) থেকে এমবিএ। একটি বেসরকারি রিসার্চ ফার্মের হাই-প্রোফাইল চাকরি ছেড়ে সিউড়ির কড়িধ্যা পঞ্চায়েতের শালবনি গ্রামে স্কুল খুলে অর্ঘ্য শিশু পড়ানোর প্রাতিষ্ঠানিক রূপকে ধাক্কা দেওয়ার কাজ শুরু করেছেন। অর্ঘ্যর ওই স্কুলে মূলত প্রত্যন্ত এলাকার পিছিয়ে পড়া অংশের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে। সেখানে আধুনিক শিক্ষা পরিকাঠামোর সঙ্গে আশ্রমিক পরিবেশের মিশেল। কিন্ডারগার্টেন থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত এই স্কুলের প্রতিটি ক্লাসে ল্যাপটপ, প্রজেক্টর। লাইব্রেরিতে বইয়ের সঙ্গে রাখা আছে অজস্র চলচ্চিত্র এবং শিক্ষা সংক্রান্ত তথ্যচিত্র। শিক্ষক নাগাড়ে বলে যাবেন, আর ছাত্রছাত্রীরা ঘাড় গুঁজে নোট নেবে— এই দৃশ্যের বদলে এই স্কুলে দেখা যায়: পড়ুয়া ও শিক্ষকদের মধ্যে আলোচনা, বিতর্ক, প্রয়োজনে সিনেমা আর তথ্যচিত্র দেখিয়ে, সাহিত্যের অংশ মিশিয়ে ক্লাস এগোচ্ছে। তথ্য মুখস্থ করার বদলে, ছেলেমেয়েরা নিজের মতো করে ভাবতে শিখুক, এটাই চান অর্ঘ্য।
বিদেশি মাইক্রো-ফিনান্স কোম্পানির চাকরি ছেড়ে এ দেশের আর এক মেধাবী ছাত্র সন্তোষ পারুলেকার তৈরি করেছেন ‘পিপল ট্রি ভেঞ্চার’। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বেকার যুবক-যুবতীদের বিনা পয়সায় ট্রেনিং দিয়ে নির্মাণ শিল্পে কাজ দেওয়াই এই সংস্থার মূল লক্ষ্য। ২০০৪ সালে শুরু, তার পর থেকে অন্ধ্র প্রদেশের সীমানা ছাড়িয়ে ‘পিপল ট্রি’ এখন উত্তর প্রদেশ, বিহার, রাজস্থান এবং মহারাষ্ট্রেও কাজ করছে। পাঁচ হাজারেরও বেশি মানুষকে কাজ দিয়েছে এই সংস্থা। সন্তোষ দেখেছিলেন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জীবিকা অর্জনের সুযোগ বৃদ্ধির বদলে মুনাফা লোটাই মাইক্রো-ফিনান্স কোম্পানিগুলির আসল উদ্দেশ্য। তাই গরু কেনার টাকা দিয়েই খালাস কোম্পানিগুলো নজর রাখে না, গরু কিনে পরিবারটি আদৌ স্বাবলম্বী হচ্ছে কি না। চাকরি ছেড়ে দুই বন্ধুকে জুটিয়ে তিনি তৈরি করলেন ‘পিপল ট্রি’। এখানে যাঁরা কাজ শিখতে আসেন, তাঁদের যেমন থাকা-খাওয়ারও ব্যবস্থা করা হয়, তেমনই থাকে মেডিক্লেমও। চাকরিতে ঢুকলে উপার্জনের পর কয়েক মাস অল্প কিছু টাকাই ‘পিপল ট্রি’কে দিতে হয়। প্রথম দু’বছর চার কোটি টাকা লোকসান হয়েছে, তবু ভেঙে পড়েনি এই সংস্থা বা তার রূপকার।
অর্চনা সারদনা। জম্মু ও কাশ্মীরের একটি রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে। দুই সন্তানের জননী এই দুঃসাহসীই হয়ে উঠেছেন ভারতের প্রথম মহিলা ‘বেস জাম্পার’। ৩৮ বছর বয়সে এই কীর্তি গড়ার সময় তাঁকে নিজের ঘর, বিয়ের গয়না আর গাড়ি অবধি মর্টগেজ রাখতে হয়েছিল। এমনিতে সাধারণ নাগরিকদের জন্য ভারতে বেস জাম্পিংয়ের মতো অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের কোনও পরিকাঠামো নেই। উৎসাহীদের বিদেশে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে নিজের এই প্যাশন টিকিয়ে রাখতে হয়। ২৪ বছর বয়সে এক নেভি অফিসারের সঙ্গে বিয়ের পরেই জীবনটা বদলে যায় বি এসসি গ্র্যাজুয়েট, ইন্টিরিয়র ডিজাইনিং-এ ডিপ্লোমা থাকা অর্চনার। মধুচন্দ্রিমায় দার্জিলিং এসে অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস-পাগল স্বামী তাঁকে মাউন্টেনিয়ারিং-এর একটি কোর্সে ভর্তি করে দেন। পরে নিয়ে যান উত্তরাঞ্চলের একটি দুর্গম ট্রেকে। সে-ই শুরু। এর পর থেকে রান্নাবাটি ছেড়ে এ মেয়ের নেশাই হয়ে উঠল নানা ঝুঁকির খেলায় যোগ দেওয়া। তারই সূত্রে ২০০৭ সালে স্কাই ডাইভিং শিখতে অর্চনা একাই ক্যালিফর্নিয়া পাড়ি দেন। এক মাসে ৫১ বার ঝাঁপ দিয়ে ‘বি’ লাইসেন্সও পেয়ে যান। এর পরে দীর্ঘ কয়েক সপ্তাহের ট্রেনিংয়ের পরে অর্চনা তাঁর প্রথম বেস জাম্প করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উটাহারে একটি ৪০০ ফুট উঁচু ব্রিজ থেকে। বর্তমানে ‘উডল্যান্ড’ সংস্থার অ্যাম্বাসাডর অর্চনা ৩৩৫টি স্কাই-ডাইভ, একাধিক বেস জাম্প করে বহু কীর্তি গড়ে ফেলেছেন। মালয়েশিয়ায় বেস জাম্প করে উড়িয়েছেন তেরঙ্গাও।
ভূপালের ছেলে বিনায়ক লোহানি আইআইটি থেকে বি টেক করার পরে ইনফোসিস-এ বড় চাকরিতে যোগ দেন। কিন্তু এক বছরের মাথায় চাকরি ছেড়ে ম্যানেজমেন্ট পড়তে ভর্তি হন আইআইএম-এ (কলকাতা)। সেখান থেকে পাশ করে, ২০০৩ সালে কলকাতার একটি ছোট্ট ভাড়াঘরে মাত্র তিনজন শিশুকে নিয়ে গড়ে তোলেন ‘পরিবার’। ঠিক করেন, অনাথ, পথশিশু আর আদিবাসী এলাকার দুঃস্থ ছেলেমেয়েরাই সেই পরিবারের ঘর আলো করবে। ওই শিশুদের দিতে হবে সুরক্ষিত জীবন। গত দশ বছরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সুনামের সঙ্গে কাজ করছে বিনায়কের সংস্থা। কলকাতার অদূরে জমি কিনে বিনায়ক সংস্থার নিজস্ব পরিকাঠামোও গড়ে তুলেছেন। এখন প্রায় সাড়ে ন’শো শিশু ওই পরিবারের অংশ। ২০১১ সালে কেন্দ্র সরকার বিনায়কের এই ‘পরিবারে’র হাতেই তুলে দিয়েছে ‘ন্যাশনাল চাইল্ড ওয়েলফেয়ার অ্যাওয়ার্ড’। এক সময় সমাজের মূলস্রোত থেকে ছিটকে পড়া এই ছেলেমেয়েরাই এখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করছে। কেউ কেউ আবার ‘পরিবার’-এর কাজেই যুক্ত হচ্ছে।
যে সমাজে ধর্ষণের জন্য মেয়েদেরই দায়ী করা হয়, সেখানে প্রনীতা বাসুলুদের মতো ধন্যিমেয়েদের ভীষণ প্রয়োজন। এই তরুণী এখন আমেরিকার মিশিগানে পড়াশোনা করছে। নিজের পড়ার মাঝেই পিয়ানো আর তাইকোন্ডোর ক্লাস নেয়। সেই টাকার কিছুটা দেয় স্থানীয় একটি শিশুদের স্কুলে। বাকিটা বাঁচিয়ে রাখে নিজের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘বিল্ড আওয়ার ফিউচার’-এর জন্য। যে সংস্থার লক্ষ্যই মেয়েদের আত্মনির্ভর করা। এই মেয়েই বিভিন্ন শহরে গিয়ে শিশু ও মহিলাদের তাইকোন্ডোর প্রশিক্ষণ দিয়ে আত্মরক্ষার উপায় বাতলায়। আবার একই বিষয়ে সেমিনারে গরম বক্তৃতা দিয়ে মেয়েদের সংগঠিতও করে!
মণি, কৌশলেন্দ্র, অর্চনাদের এ দেশ এখন ধীরে ধীরে চিনছে। এঁদের প্রথাছেঁড়া চিন্তা আমাদের স্বাধীনতাকে আরও উজ্জ্বল করছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy