Advertisement
E-Paper

সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিদের ‘যক্ষপুরী’ বহরমপুরে

অভিনেতারা ‘যক্ষপুরী’ নাটকের চরিত্রদের মতোই নামগোত্র খোয়ানো এক একটি সংখ্যামাত্র। বহরমপুর রবীন্দ্রসদনে তাঁরাই ‘যক্ষপুরী’ মঞ্চস্থ করল। শম্ভূ মিত্রের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ‘বহরমপুর রেপার্টরি থিয়েটার’ আয়োজিত পাঁচদিনের নাট্যোত্‌সবের সমাপ্তি সন্ধ্যায় ওই নাটক মঞ্চস্থ হয়। যোগ দেন বহরমপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারের ২৬ জন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি।

অনল আবেদিন

শেষ আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০১৫ ০১:০৩
মঞ্চে যক্ষপুরী। গৌতম প্রামাণিকের তোলা ছবি।

মঞ্চে যক্ষপুরী। গৌতম প্রামাণিকের তোলা ছবি।

অভিনেতারা ‘যক্ষপুরী’ নাটকের চরিত্রদের মতোই নামগোত্র খোয়ানো এক একটি সংখ্যামাত্র। বহরমপুর রবীন্দ্রসদনে তাঁরাই ‘যক্ষপুরী’ মঞ্চস্থ করল। শম্ভূ মিত্রের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ‘বহরমপুর রেপার্টরি থিয়েটার’ আয়োজিত পাঁচদিনের নাট্যোত্‌সবের সমাপ্তি সন্ধ্যায় ওই নাটক মঞ্চস্থ হয়। যোগ দেন বহরমপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারের ২৬ জন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি।

নাটক শেষে কুশীলবদের সর্ম্বধনা দিতে গিয়ে রবীন্দ্রসাহিত্যের গবেষক অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মৃণাল চক্রবর্তী বলেন, “মন্ত্রমুগ্ধের মতো যা দেখলাম তা কর্ষণজীবীদের অভিনীত নাটক। এ নাটক কষর্ণজীবী ও আকর্ষণজীবীদের দ্বন্দ্ব। জোড়াসাঁকোতে রক্তকরবীর প্রথম অভিনয়ের সময় রবান্দ্রনাথ নিজেই কথটা বলেছেন।”

‘বহরমপুর রেপার্টরি থিয়েটার’-এর কর্ণধার, পরিচালক প্রদীপ ভট্টাচার্য রবীন্দ্রনাটককে কেবল জেলখানায় নিয়ে যাননি, প্রচলিত জেলবিধি ভেঙে মহিলা ও পুরষদের একসঙ্গে নিয়ে দিনের পর দিন মহড়াও দিয়েছেন। তাঁদের দলে রয়েছেন যে পাঁচজন মহিলা, তাঁদের চারজনই বাইরের জগতে ছিলেন পর্দানশিন। ‘যক্ষপুরী’ তাঁদের মুক্তি দিয়েছে। কলকাতা, দিল্লি, শান্তিনিকেতন, বালুরঘাট-সহ নানা শহরে মঞ্চস্থ হয়েছে ‘যক্ষপুরী’। টিকিট বিক্রির টাকায় কয়েদিদের জন্য কল্যাণ তহবিল গড়া হয়েছে।

স্বল্পশিক্ষিত কয়েদিদের মুখে রবীন্দ্রনাটকের পরিশীলিত ভাষা জোর করে ঠেসে দিতে চাননি, জানান পরিচালক। কয়েদিদের অভ্যস্ত আঞ্চলিক ভাষা ও বাচনভঙ্গীই নাটকে রেখেছেন। ফলে নাটকের নন্দিনী ‘কোনও কথা’-র বদলে উচ্চারণ করেন ‘কুনু কুথা’, স্বামী ফাগুলালকে চন্দ্রা সতর্ক করে, “ইহকাল পরকাল দুডিই খুয়াতে বসিচো।’ তাতে রসভঙ্গ হয়নি। প্রদীপবাবু বলেন, “কয়েদিদের মুখের ভাষা পাল্টাতে চাইনি। চেয়েছিলাম তাঁদের মনের ভাষা বদলাতে। তার ফলেই তাঁদের দিয়ে তাদেরই জীবনের নাটক মঞ্চায়ন সম্ভব হয়েছে।”

বিশু পাগলাকে যখন যক্ষপুরীর সর্দার ডাকে ‘এই ৬৯-এর ম!’ বা ফাগুলালকে পুরোহিত ডাকে, ‘এই ৪৭-এর ক!’ তখন কয়েদিরা নাটক থেকে পৌঁছে যায় জীবনে। এক দিকে ফেলে আসা স্বাভাবিক জীবন, অন্যদিকে পাঁচিলবন্দি জেলজীবন দুয়ের টানাপড়েনই যক্ষপুরী। কয়েক দশক আগে ‘রক্তকরবী’ মঞ্চস্থ করে বাংলা নাট্যআন্দোলনে ইতিহাস গড়েছিল প্রয়াত শম্ভূ মিত্রের ‘বহুরূপী’। প্রদীপবাবুর দাবি, তিনিও নাটকের ইতিহাসে নিজের মতো করে আঁচড় কেটেছেন। তিনিই প্রথম কারাবন্দিদের দিয়ে জেলের বাইরে নাটক মঞ্চস্থ করেন। ২০০৭ সালের ১৭ মে কলকাতার রবীন্দ্রসদনে বহরমপুরের কয়েদিরা অভিনয় করেন ‘তাসের দেশ’। এরপর ‘তোতা কাহিনি’, ‘যক্ষপুরী’, সব ক’টি নাটকই জেলের বাইরে নানা শহরে, নানা মঞ্চে মঞ্চস্থ হয়েছে। “তামাম বিশ্বে কয়েদিদের দিয়ে জেলের বাইরে এর আগে নাটক মঞ্চস্থ করার কোনও নজির নেই,” দাবি প্রদীপবাবুর।

রবীন্দ্রনাথ রক্তকরবীর প্রথম নাম রেখেছিলেন ‘যক্ষপুরী’। বহরমপুর রেপার্টরি থিয়েটার ওই নামই গ্রহণ করে। নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র নন্দিনীর অভিনয় করেছেন তিন মহিলা মালদহের হালেমা বিবি, জলঙ্গির রুনা বিবি ও অন্য এক কয়েদি। তিন ‘নন্দিনী’র মধ্যে একজন আবার পাঁচটি খুনের অপরাধে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত। বিশু পাগলের ভূমিকায় বীরভূমের বুদ্ধদেব মেটের অভিনয়ে দশর্কের চোখে জল এনেছে। তাঁর গানে উদ্বেল হয়েছে দর্শক। গত বছর শম্ভূ মিত্রের জন্মশতবর্ষের প্রাক্কালে কলকাতায় আকাদেমিতে বহুরূপী নাট্যোত্‌সব হয়। সেখানে গত বছরের ২ মে ‘যক্ষপুরী’ মঞ্চস্থ হয়। তবে প্রথম মঞ্চায়ন বহরমপুর রবীন্দ্রসদনে, ২০১৩ সালের ১০ মে।

প্রদীপ বলেন, “স্বল্পশিক্ষিত কয়েদিদের দিয়ে রবীন্দ্রনাথের নাটক মঞ্চস্থ করার ভূত ঘাড়ে চাপে ২০০৬ সালে। কারা দফতরের আইজি বংশীধর শর্র্মার প্রস্তাবে।” দীর্ঘ মহড়ার পর জেলের অভ্যন্তরে ২০০৬ সালের ২৬ নভেম্বর প্রথম মঞ্চস্থ হয় ‘তাসের দেশ।’ বাইরে প্রথম অভিনীত হয় কলকাতার রবীন্দ্রসদনে, ২০০৭ সালের ১৭ মে।

নাটকের পাশাপাশি প্রদীপবাবুর পরিচালনায় ‘জেলবন্দিদের নাটক’ নামে একটি তথ্যচিত্রও তৈরি হয়েছে। বহরমপুর রবীন্দ্রসদনে গত রবিবার যক্ষপুরী মঞ্চায়নের পাশাপাশি ৩৫ মিনিটের তথ্যচিত্রটিও দেখানো হয়। প্রদীপ ভট্টাচার্য জানান, তাসের দেশের টিকিট বিক্রি থেকে দেওয়া ১ লক্ষ টাকায় ২০০৭ সালে কয়েদিদের জন্য কল্যাণ তহবিল গড়ে দেয় কারা দফতর। সাত বছরে সেই তবহিলে জমেছে প্রায় ৭২ লক্ষ টাকা। সেই টাকা থেকে জেলবন্দিদের পরিবারের সদস্যদের লেখাপড়া, বিয়ে ও চিকিত্‌সার মতো আপত্‌কালীন প্রয়োজন মেটানো হয়।

প্রদীপবাবুদের কর্মকাণ্ড মনে করিয়ে দেয় বহরমপুরের সংস্কৃতির উত্তরাধিকার। এই শহরেই ১৮৯৯ সালে মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী বাংলার প্রথম নাট্য বিদ্যালয় খোলেন। অবৈতনিক ওই প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল, ‘দ্য কাশিমবাজার স্কুল অব ড্রামা।’ নাট্যশিক্ষা এখন ঘুরিয়ে দিচ্ছে কারাবন্দিদের জীবনের মোড়।

jakhapuri convicted prisoner drama anal abedin berhampur
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy