০২ মে ২০২৪
একুশের সেরা ২১

ধানসিড়িটির তীরে

 কোয়েল মিত্র মজুমদার
কোয়েল মিত্র মজুমদার
শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০০:০৪
Share: Save:

‘‘কী রে অনি, তুই এখানে দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে আয় না।’’ পুলকদা! এখনও সেই পাজামা-পাঞ্জাবি, উলোঝুলো চুল, আর গালে হালকা দাড়ি। জুলপির কয়েকটা সাদা চুল বলে দিচ্ছে যে মাঝখান দিয়ে কয়েকটা বছর চলে গিয়েছে। অনি অল্প হেসে আবার তাকায়, তরুণ সংঘ। ক্লাবঘরটা পাকা হয়েছে, সামনের মাঠে গোলপোস্ট বসেছে, আর এক দিকে স্থায়ী মণ্ডপ। দুর্গাপুজো বোধহয় ওখানেই হয়।

অনি ভেতরে ঢুকে আবার স্মৃতির টানে হারিয়ে যায়। সেই ক্যারাম বোর্ড, দেওয়ালে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, তবে আগের থেকে মলিন ফটোগুলো। নতুন সংযোজন একটা কালার টিভি। পুলকদা ছাড়া আর কাউকে ও চেনে না। তাই আড্ডা ঠিক জমল না। পুলকদার কাছেই খবর পেল বাবলু স্টেশনের দিকে দোকান দিয়েছে আর পটাই স্কুলমাস্টার। পুরনো আরও কয়েক জনের খবর নিয়ে অনি বেরিয়ে এল। পুলকদা ওকে ক্লাবের দরজা অবধি এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘‘কত দিন আছিস তুই? একুশে ফেব্রুয়ারি বড় করে অনুষ্ঠান করব। স্যরও আসবেন। তুই আসিস কিন্তু।’’

‘‘স্যর মানে অধীর স্যর?’’

‘‘উনি এখনও এই পাড়াতেই থাকেন।’’ অনির মন পড়ে নিয়েছে পুলকদা। ‘‘কোভিডে ব্রেন স্ট্রোক হয়েছিল, এখন অনেকটা সামলে নিয়েছেন। বর্ণাও আছে ওঁর সঙ্গে। জানিস তো ও এখন বাংলার টিচার।’’

না জিজ্ঞেস করতেই পুলকদা অনেক খবর দিল অনিকে। ও সোজা বাড়ি না ফিরে দত্ত পাড়া, রথতলা পেরিয়ে ঘাট অবধি ঘুরে এল। হয়তো নিজের সঙ্গে একটু একা থাকতে চাইছিল।

বেশ কয়েক বছর বাড়ি ছাড়া ও। ইঞ্জিনিয়ারিং করে চাকরি পেয়ে গেল ব্যাঙ্গালোরে, সেই থেকে ওখানেই। ছুটিছাটায় আসে, কিন্তু কোভিডের জন্য বছরখানেক আর আসা হয়নি। আর তাতেই মনে হচ্ছে ওর ছোটবেলার শহর যেন অনেকটা বদলে গিয়েছে। কেমন ডালপালা মেলে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছে। আর সেই সঙ্গে গিলে নিয়েছে ওর ফুটবল খেলার মাঠ, আমবাগান, জোনাকি-জ্বলা রাত। তাই অনি মাঝেমাঝে বেরিয়ে পড়ে ওর ছোটবেলার শহরটাকে খুঁজতে আর মুখোমুখি হয়ে যায় কত স্মৃতির। এই যেমন আজ পুলকদা অধীর স্যরের কথা বলে অনির ছোট হৃদয় পুকুরে অনেকগুলো ঢেউ তুলে দিল। রাতে ছাদে বসে ও ভাবছিল সেই কিশোরবেলার কথা। ক্লাস সেভেনে বাংলায় কম নম্বর পাওয়ার শাস্তি হিসেবে মা অধীর স্যরের টিউশন ক্লাসে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল।

রাগী আর কড়া বলে অধীর স্যরকে সবাই ভয় পেত। আর অনি তো এমনিতেই মুখচোরা তাই আরও গুটিয়ে থাকত ওঁর সামনে। কেমন করে যেন স্যর ওর ভেতরটা চিনে নিয়েছিলেন আর স্নেহ দিয়ে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। স্যরের হাত ধরেই অনির রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, মাইকেলকে চিনতে শেখা। স্যরের মেয়ে বর্ণমালা অনিদের থেকে একটু ছোট। শ্যামলা, রোগা আর উজ্জ্বল চোখে জগৎভরা বিস্ময়। এমনিতে চুপচাপ থাকত কিন্তু আবৃত্তি করত তুখোড়। ওর গলায় ‘কর্ণকুন্তীসংবাদ’ শুনে অনির গায়ে কাঁটা দিয়েছিল। ও যেন দেখতে পারছিল কুন্তীর অসহায় মুখ, আর কালিঢালা রাতের আড়ালে কর্ণের চাপা অভিমান। বর্ণমালাকে দেখেই অনির আবৃত্তি শেখার শখ জাগে আর স্যর হাসিমুখে ওর আবদার মিটিয়ে নানা ধরনের কবিতা ওকে পড়াতে শুরু করেন। অনি আস্তে আস্তে ভালবেসে ফেলল বাংলা ভাষাকে। আর একটু বড় হয়ে মনে মনে ঠিক করে ও স্যরের মতো বাংলা নিয়েই পড়াশোনা করবে। কিন্তু বাড়িতে সটান নাকচ হয়ে গেল এই স্বপ্ন। বাংলা পড়ে কী হবে? বড় জোর স্কুল টিচার বা ওই অধীর স্যরের মতো টিউশন টিচার। না না, সায়েন্স নিয়ে পড়ে ইঞ্জিনিয়ার হতে পারলে জীবনে সুখ-সমৃদ্ধির রাস্তা পাকা।

তাই ক্লাস টুয়েলভে স্যরের টিউশন ছাড়তে বাধ্য হল অনি। জয়েন্টের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। স্যর ক্লাসে মাঝেমাঝে একুশে ফেব্রুয়ারির সংগ্রামের কথা বলতেন। সবার উৎসাহে রাজি হয়েছিলেন ক্লাবে পালন করতে। বর্ণমালা, অনি আরও অনেককে নিয়ে একটা আবৃত্তি আর ছোট নাটক করার পরিকল্পনা করেছিলেন।। অনির বাংলা শেখার আগ্রহ দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন। বাংলা ক্লাসে শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে আলোচনা সিলেবাসের গণ্ডির বাইরে চলে যেত। কী যে ভাল লাগত অনির সেই দিনগুলো। নিজেকে ও যেন অন্য আলোয় চিনতে শিখছিল। প্রোগ্রামটা মোটামুটি হয়েছিল কিন্তু তার পর থেকে আর টাইমই পেত না স্যরের কাছে যাওয়ার। ক্লাস, বাড়িতে পড়ার চাপ, আর নানা জায়গায় পরীক্ষা দিয়ে যাওয়া। পেয়েও গেল দুর্গাপুরে চান্স। সেই থেকেই ও দূরে চলে গেল। সেই সঙ্গে ওর জীবন থেকে বিদায় নিল জীবনানন্দ, সুবোধ ঘোষ, আর শরদিন্দু।

যান্ত্রিক জীবনে অভ্যস্ত করে নিয়েছে নিজেকে অনি। কিছু নতুন বন্ধুও হয়েছে ওর। তাদের সঙ্গে মলে ঘুরে, সিনেমা দেখে কাটিয়ে দেয় ছুটির দিনগুলো। কিন্তু এ বারের লম্বা ছুটি ওকে অনেক কিছু ভাবার অবকাশ দিচ্ছে। নিজেকে অনেক স্বাধীন মনে হচ্ছে। আর স্মৃতির ঝাপটা মাঝেমাঝে বেসামাল করে দিচ্ছে ওকে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটা চৌখুপির মধ্যে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকার একঘেয়ে জীবন থেকে মুক্তি পেয়েছে ও।

তাই অনি ওর বসকে মেল করে ক’দিন অনলাইন অফিস করার অনুমতি চেয়ে নিল। ভাষা দিবসের অনুষ্ঠান আর দোল কাটিয়ে ফিরে যাবে ও। ফাংশনের আগের দিন ক্লাবের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময়ে অধীর স্যরকে দেখতে পেল। পুলকদার সঙ্গে কিছু জরুরি আলোচনা করতে এসেছিলেন। অনিকে দেখে প্রচণ্ড খুশি হয়ে এগিয়ে এলেন। একটু রোগা হয়ে গিয়েছেন, মুখে বলিরেখা কিন্তু এনার্জি এখনও আগের মতো। বুকে জড়িয়ে ধরে কত কথা বললেন। অনির সব খবর উনি জানেন, কত উন্নতি করেছে ও, তাতে খুব খুশি তা-ও জানালেন। অনির মনের দ্বিধা মুছে গেল। স্যর একটুও বদলাননি আর অনির ওপর ওঁর কোনও অভিমানও নেই।

পরের দিন তাড়াতাড়ি অনি পৌঁছে গেল ক্লাবে। কাগজের শিকলি দিয়ে, ফুলের মালা দিয়ে সুন্দর করে সাজানো মণ্ডপ। দেওয়ালে বড় বড় মনীষীদের ছবিতে মালা ঝুলছে। একটি শাড়ি পরা মেয়ে আলপনা দিচ্ছিল। বর্ণমালা— সেই রকম একহারা চেহারা, শুধু মুখে একটা আলতো লালিত্যের ছোঁয়া।

অনুষ্ঠান শুরু হল সভাপতির ভাষণ দিয়ে। তার পর সমবেত কণ্ঠে গান— ‘‘মোদের গর্ব মোদের আশা’’। যখন সবাই ‘‘আমি বাংলায় গান গাই’’ গেয়ে উঠল অনি নিজের অজান্তেই গলা মিলিয়ে দিল সবার সঙ্গে।

এর পর একটা ছোট অনুষ্ঠান— বাংলা ভাষা এবং আমাদের জীবনে তার প্রভাব নিয়ে। স্যর একটু করে পাঠ করছেন, আর বর্ণমালা এবং অন্য ছাত্র-ছাত্রীরা কবিতা, নাচ, গান দিয়ে প্রাণের ভাষাকে উদ্‌যাপন করছে।

যখন বর্ণমালা স্টেজে জীবনানন্দের ‘আবার আসিব ফিরে’ আবৃত্তি করছে, অনির ঠোঁট নড়ে উঠল। ও একটুও ভোলেনি! স্যর স্টেজ থেকে হাত নেড়ে ওকে ডেকে নিলেন। একটা মাইক ধরিয়ে দিলেন হাতে। অনিও কেমন স্বাভাবিক ভাবে বর্ণমালার সঙ্গে গলা মিলিয়ে পুরো কবিতাটা বলল। এক অদ্ভুত ভাল লাগায় ধুয়ে যাচ্ছে ওর ভেতরটা।

অনুষ্ঠান শেষে সবার সঙ্গে কথা হল, বর্ণমালা খুব খুশি এত দিন পর আবার এক সঙ্গে স্টেজে কবিতা পরিবেশন করে। অনি স্যরের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে নিজের মনেই প্রতিজ্ঞা করল যে এ বার ফিরে যাওয়ার সময়ে কবিতার বইগুলো নিয়ে যাবে। যে আলো আর আনন্দ আজ ওর ভেতরে ফুটে উঠেছে তাকে আর ও নিভে যেতে দেবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:

Share this article

CLOSE