Advertisement
২৭ জুলাই ২০২৪
Schizophrenia

মনগড়া বিশ্বাস, ‘হ্যালুসিনেশন’! প্রতিহিংসাতেও ভোগে রোগী, স্কিৎজোফ্রেনিয়া সারানো কি সম্ভব?

মনের এমন এক অবস্থা যেখানে রোগী সবসময়েই নিজের মনগড়া এক কাল্পনিক জগতে বাস করে। মস্তিষ্কে রাসায়নিক ভারসাম্যের তারতম্যের কারণেই এমন অসুখ হতে পারে।

Prediction and prevention of schizophrenia

মনের ভয়ঙ্কর অসুখ স্কিৎজোফ্রেনিয়া। ছবি: সংগৃহীত।

চৈতালী চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০২৪ ১৬:৫১
Share: Save:

ভয়টা কিছুতেই মন থেকে যাচ্ছে না। আড়াল থেকে কেউ যেন সবসময় ভয় দেখায়। চোখের সামনে বিচিত্র সব দৃশ্য। দৃষ্টিবিভ্রম। কল্পনায় ভেসে আসে কার যেন কণ্ঠস্বর। অবচেতনেও দেখা দিয়ে যায় কেউ। উত্যক্ত করে। আঘাত করতে আসে। সবসময়েই যেন কেউ আড়ালে আবডালে ষড়যন্ত্র করছে। কাছের মানুষগুলোকেও আর বিশ্বাস হয় না। মনের এই জটিল অবস্থার নাম স্কিৎজোফ্রেনিয়া। এমন এক অসুখ যার প্রকৃত কারণ আজও ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেননি মনোবিদেরা।

মনের যেসব জটিল ও বিচিত্র অসুখবিসুখ নিয়ে গবেষণা চলছে স্কিৎজোফ্রেনিয়া তার মধ্যে একটি। এই অসুখ নিয়ে যেমন স্বচ্ছ ধারণা নেই, তেমনই আর পাঁচজন মনোরোগীর সঙ্গে স্কিৎজোফ্রেনিয়ার রোগীকে আলাদা করাও অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন হয়ে যায়। ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ’-এর রিপোর্ট বলছে, প্রতি হাজার জন ভারতীয়ের মধ্যে তিন জন স্কিৎজোফ্রেনিয়ার শিকার।

কী এই রোগ?

ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ শর্মিলা সরকার বলছেন, “স্কিৎজোফ্রেনিয়াকে চিকিৎসার পরিভাষায় বলা হয় ‘মেজর মেন্টাল ডিসঅর্ডার’। মনের এমন এক অবস্থা যেখানে, রোগী সবসময়েই নিজের মনগড়া এক কাল্পনিক জগতে বাস করে। মস্তিষ্কে রাসায়নিক ভারসাম্যের তারতম্যের কারণেই এমন অসুখ হতে পারে।”

স্কিৎজোফ্রেনিয়ার রোগী কেমন আচরণ করে?

অশান্ত, উত্তেজিত অথবা এমনভাবে নিজেকে গুটিয়ে নেয় যে তার মনোজগতে কী চলছে, তা বোঝা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। রোগী কখন কী করবে, কেমন আচরণ করবে তার আঁচটুকুও পাওয়া যায় না। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ শর্মিলা বলছেন, “ক্লিনিকে এমন অনেক রোগী আসেন, যাঁরা বলেন যে তাঁর মা-ই নাকি তাঁর ক্ষতি করার চেষ্টা করছেন। অথবা নিজের মনেই বিড়বিড় করতে থাকেন সবসময়। এমন রোগীও আছেন যাঁরা সবসময়েই অজানা, অচেনা কারও কণ্ঠস্বর শুনতে পান। চোখের সামনে ভুল জিনিস দেখেন, অযথা আতঙ্কে ভোগেন।”

এই প্রসঙ্গে ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট চিকিৎসক অনিন্দিতা মুখোপাধ্যায় বলছেন, “ভ্রান্ত ধারণা ও দৃষ্টিবিভ্রম এই রোগের অন্যতম লক্ষণ।” মনোবিদ জানাচ্ছেন, একটি বধ্যমূল ধারণা রোগীর মাথায় গেঁথে যায়। তখন সে চোখের সামনেও ভুল দেখে এবং কানেও ভুল শুনতে শুরু করে। এই ভ্রান্ত ধারণাকে চিকিৎসার ভাষায় বলে ‘ডিলিউশন’ ও দৃষ্টিবিভ্রমকে বলে ‘হ্যালুসিনেশন’। হ্যালুসিনেশন হল কাল্পনিক কিছু দেখা বা শোনা। অডিটরি হ্যালুসিনেশন হলে, রোগীর মনে হবে বাইরে থেকে কোনও শব্দ বা কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে, যেগুলির কোনও বাহ্যিক উৎস নেই। এরও নানা রকম প্রকাশ হতে পারে। মনে হতে পারে, এক বা একাধিক মানুষ তাঁকে নিয়ে সারাক্ষণ কথা বলছে বা সমালোচনা করে চলেছে। অথবা সারাক্ষণ কেউ তার সঙ্গে কথা বলে চলেছে। এই রোগীর কথাবার্তাও অসংলগ্ন হয়।

কেন হয় এই রোগ?

মনোবিদেদের মতে, কোনও ওষুধ বা নেশার কারণে এই রোগ হয় না। তবে মানসিক চাপ বাড়লে, তার থেকে স্কিৎজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। এই রোগের কারণ জিনগত। পরিবারে কারও থাকলে তার থেকে রোগের উপসর্গ দেখা দিতে পারে। তা ছাড়া আক্রান্তের বেড়ে ওঠা, শৈশব বা জীবনের কোনও এক পর্যায়ে ঘটে যাওয়া কোনও বিশেষ ঘটনাও এর জন্য দায়ী হতে পারে।

Prediction and prevention of schizophrenia

ভ্রান্ত ধারণা ও দৃষ্টিবিভ্রম—স্কিৎজোফ্রেনিয়ার দুই লক্ষণ। ছবি: সংগৃহীত।

স্কিৎজোফ্রেনিয়ার প্রতিকার কি সম্ভব?

শর্মিলার কথায়, “স্কিৎজোফ্রেনিয়া পুরোপুরি সারানো সম্ভব হয় না অনেকক্ষেত্রে। তবে সঠিক সময় চিকিৎসা শুরু হলে এবং রোগী ঠিকমতো ওষুধপত্র খেলে এই রোগকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। এর জন্য জরুরি রোগীর পরিবার ও আশপাশের লোকজনের সচেতনতা।

রোগী বিকৃত আচরণ শুরু করলেই তার উপযুক্ত চিকিৎসা, মনোবিদদের পরামর্শ মেনে চলা –এগুলোই মূলত ঠেকানোর উপায়। তবে আধুনিক যুগের ব্যস্ততা, বদলে যাওয়া সম্পর্কের সমীকরণ, অনিচ্ছার ইঁদুরদৌড় এগুলোও নানা মানসিক বিকার ডেকে আনে। পরিবার পরিজনের অবহেলা, কটূবাক্য এই রোগকে তার চরম সীমায় নিয়ে যায়। তাই মনোবিদ অনিন্দিতা ও শর্মিলা জানাচ্ছেন, কোনও সময়েই রোগীর সঙ্গে খারাপ আচরণ করা চলবে না। ঠান্ডা মাথায় তাকে বোঝাতে হবে। সমাজের সঙ্গে মেলামেশা করতে দিতে হবে। ধরুন, বিয়েবাড়ি যাচ্ছেন। তখন তাকেও সঙ্গে নিয়ে যান। বাড়িতে লোকজন এলে তাকে লুকিয়ে রাখবেন না, সকলের সামনে নিয়ে আসুন, কথাবার্তা বলতে দিন। এতে তার আত্মবিশ্বাস বাড়বে, মনের ভয় দূর হবে। গ্রামের দিকে এমন রোগীকে ‘ভূতে পেয়েছে’ মনে করে ওঝা, তান্ত্রিকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। এতে তার অবস্থা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। তাই শুধু ওষুধ নয়, শিক্ষা ও সচেতনতাও এই রোগ প্রতিরোধের অন্যতম উপায়।

স্কিৎজোফ্রেনিয়ার রোগী অনেকক্ষেত্রেই প্রতিহিংসায় ভোগে। অন্যকে আঘাত করা বা খুন করার ইচ্ছা জন্মায়। একে বলা হয় ‘প্যারানয়েড স্কিৎজোফ্রেনিয়া’। এমন রোগী নিজেরও ক্ষতি করতে পারে। তাই এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে, রোগীকে যত দ্রুত সম্ভব মনোবিদের কাছে নিয়ে যেতে হবে। সঠিক ওষুধ ও সাইকোথেরাপিতে রোগীর মানসিক স্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE