Advertisement
১১ মে ২০২৪

সুপারিশে সঙ্কট সিগারেট-সতর্কতায়

ক্যানসারের মোকাবিলায় বিড়ি, সিগারেট-সহ তামাকসেবন ঠেকানোর প্রচার যথেষ্ট হচ্ছে না বলে চিকিৎসক থেকে আন্দোলনকারীদের অভিযোগ।তা সত্ত্বেও ধূমপানের কুফল বোঝাতে সিগারেটের প্যাকেটের ৮৫ শতাংশ জুড়ে ছবি রাখার প্রয়োজন নেই বলে জানিয়েছে লোকসভার একটি কমিটি।

সোমা মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০১৬ ০৪:১৭
Share: Save:

ক্যানসারের মোকাবিলায় বিড়ি, সিগারেট-সহ তামাকসেবন ঠেকানোর প্রচার যথেষ্ট হচ্ছে না বলে চিকিৎসক থেকে আন্দোলনকারীদের অভিযোগ।

তা সত্ত্বেও ধূমপানের কুফল বোঝাতে সিগারেটের প্যাকেটের ৮৫ শতাংশ জুড়ে ছবি রাখার প্রয়োজন নেই বলে জানিয়েছে লোকসভার একটি কমিটি। তারা চাইছে, বিপদ বোঝাতে সিগারেটের প্যাকেটে ছবি থাকলেও তা আকারে ছোট হোক।

সাংসদদের নিয়ে তৈরি কোনও কমিটি এমন সুপারিশ করায় প্রমাদ গুনছে চিকিৎসক শিবির। তাদের আশঙ্কা, এর ফলে ধূমপানের কুফল সম্পর্কে যতটুকু সচেতনতা তৈরি হয়েছিল, তা ফের তলানিতে গিয়ে ঠেকবে। বাড়বে ফুসফুস, মুখ ও গলার ক্যানসার। এই আশঙ্কার কথা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কয়েকশো চিকিৎসক লিখিত ভাবে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে। তাঁদের বক্তব্য, এমনিতেই তামাক শিল্পের লবি যথেষ্ট শক্তিশালী। এ বার জনপ্রতিনিধিরাও যদি সেই লবির পাশে দাঁড়ান, সেটা হবে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার সামিল।

চিকিৎসকদের যৌথ চিঠি গত শুক্রবারেই প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পৌঁছেছে। চিঠি গিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জে পি নাড্ডার কাছেও। স্বাস্থ্য মন্ত্রক সূত্রের খবর, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং বিভিন্ন চিকিৎসক সংগঠনের প্রতিনিধিরা কয়েক দিনের মধ্যেই এই নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসবেন।

তামাকের বিরুদ্ধে আরও সংহত, আরও বৃহৎ প্রচারের বদলে দেশের আইনসভার কমিটির এমন পরামর্শ কেন, সেই প্রশ্ন জোরদার হয়েছে। তার সুস্পষ্ট জবাব মিলছে না। তবে এর পিছনে তামাক-লবির হাত দেখছেন অনেকেই। প্রভাবশালী এক সাংসদের দিকে ইঙ্গিত করেছেন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের এক কর্তা। তিনি বলেন, ‘‘ওই কমিটিতে এমন এক জন সাংসদ রয়েছেন, যিনি নিজে বিশাল বিড়ি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। নানা ব্যক্তিগত স্বার্থের প্রশ্নও উঠছে। বৈঠকে সব দিকই বিবেচিত হবে।’’

স্বাস্থ্য মন্ত্রক সূত্রের খবর, বছর দেড়েক আগে সিগারেটের প্যাকেটের ৮৫ শতাংশ জুড়ে সতর্কতামূলক ছবি রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। নির্দিষ্ট সময় অন্তর সেই ছবির বিষয় পরিবর্তন করা হবে বলে তখন ঠিক হয়েছিল। কিন্তু প্যাকেটের গায়ে নিয়মরক্ষার সেই ছবি আকারে ক্রমশই ছোট হয়ে এসেছে।

কেন?

চিকিৎসকদের অভিযোগ, এর পিছনে আছে তামাক-রাজনীতি। আম-নাগরিকের জীবন বাজি রেখে চলছে বণিক-তোষণের রাজনীতি। তামাক-লবির চাপেই ক্রমশ পিছু হটেছে সরকার।

এবং তাতেই কার্যত সিলমোহর দেওয়ার সুপারিশ করেছে লোকসভার ‘কমিটি অন সাব-অর্ডিনেট লেজিসলেশন’। তারা বলছে, ৮৫ শতাংশ ছবি থাকাটা ‘বাড়াবাড়ি’। এতে সিগারেট-বিড়ির বহু বিক্রেতা রাতারাতি কাজ হারাবেন। সেই সঙ্গে বাজারে ঢুকে পড়বে নিম্ন মানের বেআইনি বিড়ি-সিগারেট।

লোকসভার ওই কমিটি আরও বলেছে, বড় আকারের ছবি থাকলে দিশি সিগারেটের চেয়ে বিদেশি সিগারেট বেশি নিরাপদ মনে করে অনেকেই সে-দিকে ঝুঁকবেন। ফলে সরকারের আয়ে টান পড়বে। বিড়ির প্যাকেটের ক্ষেত্রে দু’দিকের পরিবর্তে এক দিকে ৫০ শতাংশ জুড়ে ছবিই যথেষ্ট বলে মনে করে তারা।

তামাক-বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা এবং মুম্বইয়ের টাটা ক্যানসার হাসপাতালের চিকিৎসক পঙ্কজ চতুর্বেদী বলেন, ‘‘তামাকজাত জিনিস ব্যবহারে ভারত প্রথম সারিতে। অথচ এর বিপদ বোঝাতে সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে ছবি-সহ সতর্কীকরণ ব্যবস্থা চালু করার ক্ষেত্রে আমরা একেবারে ১৩৬ নম্বরে! এ বার সেই জায়গাটুকুও হয়তো থাকবে না। কেন্দ্রীয় সরকারের তামাক-নীতিটা অবিলম্বে স্পষ্ট হওয়া জরুরি।’’

সিগারেটের প্যাকেটে সতর্কীকরণের ছবির আয়তন কমিয়ে আনার প্রস্তাবের প্রতিবাদ করেছে চিকিৎসক সংগঠন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনও।

২০১৪ সালের অক্টোবরে প্রথম সিগারেটের প্যাকেটের দু’দিকে ৮৫ শতাংশ জুড়ে সতর্কতামূলক ছবি দেওয়ার প্রস্তাব ওঠে। সেই অনুযায়ী বিভিন্ন রাজ্যকে তা জানিয়েও দেওয়া হয়। তার পরেও অবশ্য প্রায় কোথাও সেই নিয়ম মানা হয়নি। এ বার খোদ সংসদীয় কমিটি সিগারেটের প্যাকেটে ছবির আয়তন ছোট করার সুপারিশ করায় প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে কি ধাপে ধাপে সামগ্রিক ভাবে ছবি দেওয়ার বিষয়টিই উঠে যেতে চলেছে?

সরাসরি জবাব মিলছে না। তবে ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যাঁরা অন্যতম সেনাপতি, সেই চিকিৎসকদের আশঙ্কা, সিগারেটের প্যাকেটে সতর্কতার ছবি ছোট হয়ে গেলে পুরো আন্দোলনই মার খাবে। ভারতে যত মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হন, তাঁদের ৪০ শতাংশের রোগের জন্য দায়ী তামাক। শুধু তামাকের কারণে প্রতি বছর ১০ লক্ষ ভারতীয়ের মৃত্যু হয়। পূর্বাঞ্চলে ক্যানসার-রোগীদের মধ্যে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশই মুখের ক্যানসারে আক্রান্ত। এ রাজ্যে তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় দু’‌কোটি। প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার ৩৬ শতাংশেরও বেশি। ‘‘এটা কোনও ব্যক্তির বিষয় নয়। এতে সামগ্রিক ভাবে দেশের স্বার্থ জড়িত। অশিক্ষিত মানুষ লেখা পড়তে পারেন না, তাঁরা অন্তত ছবি দেখে কিছুটা সতর্ক হবেন। কমবয়সিদের ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য,’’ বলেন বেঙ্গল অঙ্কোলজি ফাউন্ডেশনের সদস্য, ক্যানসার শল্যচিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায়। সেই ছবিতে কোপ পড়লে তামাক প্রতিরোধের উদ্যোগের মূলেই কুড়ুল মারা হবে, বলছেন গৌতমবাবুরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Lok Sabha cigarette pack carry warning committee
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE