তাঁর বিরুদ্ধে ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে অভিযোগের তালিকা। ক্ষোভ জমা হচ্ছে বিদেশ মন্ত্রক, প্রতিরক্ষা মন্ত্রক এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে। ফলে আসন টলমল জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের।
ডোভালের বিরুদ্ধে অভিযোগ বহু। নিরাপত্তা সংস্থাগুলির মধ্যে সমন্বয়হীনতা। সীমান্তে অতিরিক্ত আক্রমণাত্মক হতে গিয়ে ঘরের নিরাপত্তায় ফাঁক। বৃহত্তর কূটনীতির প্রয়োজনে যে অভিযান গোপন রাখা উচিত ছিল, তা নিয়ে বুক বাজাতে গিয়ে পরিস্থিতি আরও ঘোরালো করে তোলা। চিন এবং পাকিস্তান— দুই পড়শির সঙ্গে সংঘাতে গিয়ে নাস্তানাবুদ হওয়া। কাশ্মীর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া। সূত্রের খবর, এই সব কারণে বিদেশ মন্ত্রক, প্রতিরক্ষা মন্ত্রক এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অসন্তোষ এতটাই বেড়েছে যে তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি উঠছে। ‘প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ’— এই রক্ষাকবচ অবশ্য এখনও রয়েছে প্রাক্তন এই গোয়েন্দা প্রধানের। তবে সাউথ ব্লক মনে করছে, ঘরোয়া ক্ষোভ এতটাই বেশি যে, এই রক্ষাকবচ সত্ত্বেও বেশি দিন বহাল থাকবেন না ডোভাল।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এক সদস্যের কথায়, ‘‘প্রতিটি বৈঠকে রুটিন করে নিরাপত্তা এজেন্সির কর্তারা আমাদের ব্রিফ করতেন। সে সব উঠে গিয়েছে। কোন এজেন্সি কী করছে, কেউ জানে না।’’ নিরাপত্তা ক্ষেত্রে বহু বিষয়েই সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহকে বাইরে রেখে! মন্ত্রকের এক কর্তার আক্ষেপ, ‘‘চিদম্বরম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকার সময় প্রতিদিন সকালে তাঁকে আইবি, র, সেনাকর্তারা ফোন করতেন। পরিস্থিতি সম্পর্কে জানাতেন। এখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানতে চেয়েও অন্ধকারে থাকেন।’’
ডোভালকে নিয়ে অস্বস্তিতে বিদেশসচিব এস জয়শঙ্করও। তাঁর ঘনিষ্ঠ এক আমলার কথায়, ‘‘উরি হামলার জবাবে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করা হয়েছিল। কিন্তু তার পরেও ডজন খানেক জঙ্গি হামলা হয়েছে। প্রায় ৩০ জন সাধারণ মানুষ মারা গিয়েছেন। কী লাভ হল সার্জিক্যাল স্ট্রাইকে!’’
ডোভালের ভূমিকা নিয়ে শঙ্কায় প্রাক্তন কূটনীতিকরাও। ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তির অন্যতম রূপকার রণেন সেনের কথায়, ‘‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক আগেও হয়েছে। কিন্তু তাকে প্রচারের বাইরেই রাখা হয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তার কারণেই এটা করা হয়।’’ একই সঙ্গে চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর নিয়ে ডোভাল যে ভাবে মারমুখী ভূমিকা নিয়েছেন, তাকেও ‘কূটনৈতিক ছেলেমানুষি’ বলে মনে করছেন রণেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘চিন ও পাকিস্তান যদি যোগাযোগ বাড়াতে চায়, তা হলে তৃতীয় রাষ্ট্র হিসাবে এত উচ্চগ্রামে বাধা দেওয়ার প্রয়োজন দেখি না। পরমাণু সরবরাহকারী গোষ্ঠী (এনএসজি)-তে অন্তর্ভুক্তির জন্য আমাদের বরং উচিত ছিল নিঃশব্দে চিনের সঙ্গে কৌশলগত যোগাযোগ গড়ে তোলা। সেটা করা হয়নি।’’
বিদেশ মন্ত্রকের এক কর্তার দাবি, বেজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্কের সূক্ষ্ম দিকগুলি ডোভাল বোঝেন না। আবার জয়শঙ্করকেও হাত খুলে কাজ করতে দিতে রাজি নন। ফলে সমস্যা বাড়ছে। প্রাক্তন বিদেশসচিব কানওয়াল সিব্বলের কথায়, ‘‘কাশ্মীরের সঙ্গে বাকি ভূখণ্ডের আবেগ এবং আস্থাজনিত দূরত্ব বাড়ছেই। পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে কাশ্মীরিরা বাইরে থেকে সমর্থন পাওয়ায়। এটা ভারতের ব্যর্থতা।’’ তবে আর এক প্রাক্তন বিদেশসচিব জি পার্থসারথি অবশ্য ডোভালের পাশে থাকছেন। তাঁর কথায়, ‘‘পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সামরিক অভিযান এবং কূটনীতি দু’টোই একসঙ্গে দরকার। ডোভাল সেটাই করছেন।’’
তবে সরকারের সংখ্যাগুরু অংশের মনোভাব অন্য। বছরের গোড়ায় পঠানকোটে হামলার ঘটনা থেকেই সরকারের ভিতরে ডোভালের বিরুদ্ধে উষ্মা জমা হতে শুরু করে। ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন সেনাকর্তারাও। পঠানকোট বায়ুসেনা ঘাঁটিতে জঙ্গি হামলা মোকাবিলায় সে সময় সেনাপ্রধান দলবীর সিংহ সুহাগের কাছে মাত্র ৫০ জন সেনা চেয়েছিলেন ডোভাল। পাশাপাশি ১৫০ জন এনএসজি কম্যান্ডোকেও পাঠিয়ে দেন। ফলে অভিযানের নেতৃত্ব কার হাতে থাকবে, তা নিয়ে সেনা-এনএসজি ও বায়ুসেনার কম্যান্ডো ‘গরুড়’ বাহিনীর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ও চাপানউতোর দেখা দিয়েছিল। ভারতে জঙ্গি অভিযানের ক্ষেত্রে এত বড় মাপের সমন্বয়হীনতা খুব কমই হয়েছে বলে দাবি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের।
আবার হিজবুল নেতা বুরহান ওয়ানির মৃত্যু নিয়ে যখন কাশ্মীর উত্তাল, ডোভাল বুক ঠুকে বলেছিলেন, ৭২ ঘণ্টার মধ্যে পরিস্থিতি শান্ত করে দেবেন। বলেছিলেন, ‘‘সমস্যা থাকলে তার সমাধানও রয়েছে।’’ কিন্তু উত্তাল হয়ে ওঠে উপত্যকা। ৫ মাস কার্ফু রাখতে হয় কাশ্মীরে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy