আরজেডি প্রধান লালুপ্রসাদ শুক্রবার তাঁকে ফোন করেছিলেন বলে ‘খবর’। ফোনের তালিকায় শনিবার জুড়েছে আর এক নতুন নাম— কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। এরই মধ্যে বিহার বিজেপির সভাপতি সম্রাট চৌধুরী শনিবার সকালে পৌঁছে গিয়েছিলেন তাঁর বাড়িতে। দু’জনের মধ্যে বেশ কিছু ক্ষণ বৈঠকও হয়।
তিনি জিতনরাম মাঝিঁ। বিহারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা ‘হিন্দুস্তানি আওয়াম মোর্চা’ (হাম)-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। দলিত সমাজের একেবারে অন্ত্যজ মুষাহার জনগোষ্ঠীর এই নেতার সিদ্ধান্তের উপরেই বিহার বিধানসভায় ‘সম্ভাব্য পরবর্তী সরকারের’ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ অনেকাংশে নির্ভর করছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেরই পূর্বাভাস। একদা নীতীশের ঘনিষ্ঠ অনুগামী ছিলেন জিতন। কিন্তু গত এক দশক ধরেই দু’জনের সম্পর্ক ‘মধুর’।
আরও পড়ুন:
যদিও প্রকাশিত কয়েকটি খবরে দাবি, বৃহস্পতিবার লালু সমর্থনের বিনিময়ে জিতনের ছেলে সন্তোষ কুমার সুমনকে উপমুখ্যমন্ত্রিত্বের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তা খারিজ করে দেন। যদিও ‘হাম’-এর তরফে আনুষ্ঠানিক ভাবে এ বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। বিবৃতি দেওয়া হয়নি রাহুলের টেলিফোনের বিষয়টি নিয়েও। তবে বিহার বিজেপির একটি সূত্র জানাচ্ছে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের ‘দূত’ হয়ে যাওয়া সম্রাটকে সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বিহারের ‘মহাদলিত’ নেতা। তবে কংগ্রেসের ‘সূত্র’ উদ্ধৃত করে ‘ইন্ডিয়া টুডে’তে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, রাহুলের ‘দূত’ হিসাবে জিতনের সঙ্গে দেখা করতে পটনা যাচ্ছেন ছত্তীসগঢ়ের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বঘেল।
আরও পড়ুন:
গয়া জেলার বাসিন্দা জিতনের রাজনৈতিক জীবন শুরু সত্তরের দশকের শেষ পর্বে। ১৯৮০ সালে কংগ্রেস প্রার্থী হিসাবে বিধানসভা ভোটে জিতেই মন্ত্রী হয়েছিলেন তিনি। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত কংগ্রেসে থাকলেও সে বছর বিধানসভা ভোটে হারার পরে জনতা দলে যোগ দিয়েছিলেন। এর পরে দেড় দশক বিহার রাজনীতিতে ‘লালুপ্রসাদের অনুগামী’ বলে পরিচিতি ছিল তাঁর। লালু জনতা দল ছেড়ে ১৯৯৭ সালে আরজেডি গড়ার সময় তাঁর অন্যতম সহযোগী ছিলেন জিতন।
আরও পড়ুন:
লালুর সঙ্গে মতবিরোধের জেরে ২০০৫ সালে নীতীশের জেডিইউতে যোগ দিয়ে বিধানসভা ভোটে জিতে মন্ত্রী হয়েছিলেন জিতন। আর কিছু দিনের মধ্যেই হয়ে উঠেছিলেন ‘নীতীশের ডান হাত’। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে বিজেপি নরেন্দ্র মোদীর নাম প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসাবে ঘোষণা করার পর এনডিএ জোট থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল নীতীশের দল জেডিইউ। ২০১৪-এর লোকসভা ভোটে একলা লড়ে বিহারে ভরাডুবির পরে মুখ্যমন্ত্রিত্ব থেকে ইস্তফা দেন নীতীশ। মুখ্যমন্ত্রী করেন তাঁর অনুগামী দলিত নেতা জিতনকে।
আরও পড়ুন:
কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দু’জনের সম্পর্কের অবনতি হয়। জিতনরামকে সরিয়ে (যে ঘটনাকে মঙ্গলবার জিতন ‘আট বছর আগের অপমান’ বলেছেন) ফের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন নীতীশ। আর জিতন জেডিইউ ছেড়ে নতুন দল ‘হাম’ গড়ে বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ-তে শামিল হন। ২০১৫-র বিধানসভা ভোটে তিনি বিজেপির সমর্থনে বিধায়ক হলেও ‘হাম’-এর অন্য কোনও প্রার্থী জিততে পারেননি। অন্য দিকে, আরজেডি-কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গড়ে ফের মুখ্যমন্ত্রী হন নীতীশ।
আরও পড়ুন:
২০১৭ সালে নীতীশ আরজেডি-কংগ্রেসকে ছেড়ে বিজেপির হাত ধরার পরে এনডিএ জোটের অন্দরে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছিলেন জিতন। নীতীশ তাঁকে মন্ত্রী করেননি। এর পরে ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের আগে কংগ্রেস, আরজেডি, রাষ্ট্রীয় লোক সমতা পার্টি (আরএসএলপি)-র মহাগঠবন্ধনে শামিল হন তিনি। কিন্তু মহাজোটের শরিক হিসেবে তিনটি আসনে লড়ে একটিতেও ‘হাম’ জিততে পারেনি। জিতনরাম নিজেও গয়া লোকসভা কেন্দ্রে হেরে গিয়েছিলেন।
এর পর ২০২০-র বিহার বিধানসভা ভোটের আগে এনডিএতে ফিরে যান জিতন। তাঁর দল ৭টি আসনে লড়ে ৪টিতে জয়ী হয়। মন্ত্রী হন তাঁর ছেলে সুমন। ২০২২ সালের অগস্টে নীতীশের দল এনডিএ ছেড়ে আরজেডি-কংগ্রেস-বামেদের ‘মহাগঠবন্ধন’-এ শামিল হওয়ার সময় জিতনও তাঁর সঙ্গী হয়েছিলেন। কিন্তু নীতীশের সঙ্গে ফের সংঘাতের কারণে গত জুনে ‘মহাগঠবন্ধন’ ছেড়ে বিজেপির সহযোগী হন তিনি। যদিও গত এক বছরে তেমন কোনও রাজনৈতিক ‘সক্রিয়তা’ দেখা যায়নি তাঁর।
আরও পড়ুন:
এই পরিস্থিতিতে নীতীশের জোটবদলের জল্পনা দানা বাঁধতেই বিহার রাজনীতিতে হঠাৎ আলোচনায় চলে এসেছে জিতনের নাম। আর তার নেপথ্যে রয়েছে পরিষদীয় পাটিগণিত। বিহার বিধানসভার অঙ্ক বলছে, লালু-রাহুলের প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হলে বিহার বিধানসভায় বিজেপি-জেডিইউ জোটকে বাদ দিয়েই সরকার গড়ার কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারে ‘মহাগঠবন্ধন’। ২৪৩ আসনের বিহার বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজন ১২২ বিধায়কের সমর্থন। আরজেডির রয়েছে ৭৯ জন বিধায়ক। এ ছাড়া, কংগ্রেসের ১৯, সিপিআইএমএল লিবারেশনের ১২, সিপিএমের ২, সিপিআইয়ের ২ এবং ১ নির্দল বিধায়ক রয়েছেন বিজেপি বিরোধী মহাজোটে। অর্থাৎ, ১১৫ বিধায়কের সমর্থন পেতে পারেন লালুরা।
এ ছাড়া হায়দরাবাদের সাংসদ আসাদউদ্দিন ওয়েইসির ‘অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন’ (মিম)-এর এক জন বিধায়কও প্রয়োজনে ‘মহাগঠবন্ধন’কে সমর্থন করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে জিতনের চার বিধায়ককে পাশে পেলে ১২০-তে পৌঁছে যাবে বিজেপি বিরোধী জোট। লালুদের প্রয়োজন হবে আর মাত্র দুই বিধায়কের সমর্থন। অন্য দিকে, দ্বিতীয় বৃহত্তম দল বিজেপির বিধায়ক সংখ্যা ৭৮। নীতীশের ৪৫। অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ব্যবধান এক সুতোর, ১২৩। তা ছাড়া, এমন টানাপড়েনের পরিস্থিতিতে অনেক ক্ষেত্রেই বিধানসভার স্পিকারের ভূমিকা ‘নির্ণায়ক’ হয়ে ওঠে। স্পিকার পদে রয়েছেন লালুর ঘনিষ্ঠ অনুগামী আরজেডি নেতা অওধবিহারি চৌধুরী। ফলে শিবির বদলালেও খুব স্বস্তিতে থাকতে পারবেন না নীতীশ। তাই কি জিতনকে ‘পাখির চোখ’ করেছেন লালু-রাহুলেরা?