Advertisement
০৭ মে ২০২৪

রাজনৈতিক চমকের স্বার্থেই কি জিইয়ে রাখা হয় উদ্বাস্তু সঙ্কট

আসলে কিছু কিছু সমস্যা জিইয়ে রাখাটাই রাজনীতি। যে কোনও রাজনৈতিক দলই নিজেদের ভোটের কথা ভেবে এক-একটা সামাজিক বিষয় নিয়ে এগোয় এক-এক ভাবে। আমার ধারণা, অসমের ক্ষেত্রেও তেমনই ঘটেছে। অভিবাসনকে এক অর্থে সমস্যা মনে করলেও, সেটাই বহু সময়ে হয়ে উঠেছে ভোট বাড়ানোর চাবিকাঠি।

আশ্রয়ের খোঁজে: পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গের পথে উদ্বাস্তুরা। ১৯৪৯ সালে। ফাইল চিত্র

আশ্রয়ের খোঁজে: পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গের পথে উদ্বাস্তুরা। ১৯৪৯ সালে। ফাইল চিত্র

সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় (গবেষক ও প্রাবন্ধিক)
শেষ আপডেট: ০৩ অগস্ট ২০১৮ ০২:৩৬
Share: Save:

পশ্চিমবঙ্গেও উদ্বাস্তুদের নিয়ে সঙ্কট নতুন নয়। দেশভাগের আগে-পরে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এবং তার পরে টানা এত বছর সীমান্ত পেরনো এখানে কার্যত নিয়ম হয়ে গিয়েছে। আজও নিশ্চয় বেশ কয়েক জন ইতিমধ্যে বেনাপোল, পেট্রাপোল সীমান্ত পেরিয়েছেন। এটা বন্ধ হওয়া খুবই জরুরি। কারণ, এর জেরে স্থানীয় অর্থনীতির উপরে খুব চাপ পড়ে। তার দিকে নজর নেই কারও। ১৯৮০-র দশকে যখন এই সমস্যা চরমে, তখনও বাম সরকার এ কথা মানতে চায়নি প্রথমে। এ দিকে নজর দেয়নি তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারও। পরে নজর পড়লেও, ব্যবস্থা তেমন কিছুই হল না।

আসলে কিছু কিছু সমস্যা জিইয়ে রাখাটাই রাজনীতি। যে কোনও রাজনৈতিক দলই নিজেদের ভোটের কথা ভেবে এক-একটা সামাজিক বিষয় নিয়ে এগোয় এক-এক ভাবে। আমার ধারণা, অসমের ক্ষেত্রেও তেমনই ঘটেছে। অভিবাসনকে এক অর্থে সমস্যা মনে করলেও, সেটাই বহু সময়ে হয়ে উঠেছে ভোট বাড়ানোর চাবিকাঠি। ঠিক যেমনটা ইদানীং কলকাতায় হয় হকার-উচ্ছেদ নিয়ে। এই হকারদের কখনও প্রচারের কাজে লাগায় রাজনৈতিক দল, আবার কখনও সেই হকারদেরই ব্যবসায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে, তাঁদের উচ্ছেদ করে বাকি নাগরিকদের বিশ্বাস অর্জন করতে চাওয়া হয়। আর হকারদেরও কিছু প্রমাণ করার নেই। ক্ষমতা যখন যেমন বলবে, তেমন ভাবেই চলতে হয় এই ভাসমান জনগোষ্ঠীকে। উদ্বাস্তু সঙ্কটও তেমনই।

যেমন এ বারের অসমের ঘটনায় এক জায়গায় শুনলাম যমজ ভাই-বোনের মধ্যে এক জনের নাম আছে ভোটার তালিকায়, আর অন্য জনের নাম নেই। এর পরে কি আর সত্যিই অন্য জনকে ভোট দিতে দেওয়া হবে না? হবে নিশ্চয়। কিন্তু কিছু দিন সঙ্কটটা কাটতে সময় লাগবে, যাতে এক দল মানুষ তত দিন ভয়ে থাকেন। ভয় বাড়লে যে আনুগত্য বাড়ার একটা সম্ভাবনা থাকে। যে কোনও সরকার তো সেটাই চায়। কারও দুর্বল জায়গাটা খুঁজে, সেটাকে ব্যবহার করা। যাতে বেশি দিন ক্ষমতা ধরে রাখা যায়। এ ক্ষেত্রেও বোধ হয়, ভাবনাটা তেমন। সেই জন্যই তো অসমে পরদিন থেকে ভ্রম সংশোধনের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে বলে আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। ভোটের আগে কেউই যে অপ্রিয় হতে চায় না। যেমন পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তু সঙ্কট নিয়ে কখনও অপ্রিয় হতে চায়নি কোনও সরকারই। তাই সেই সমস্যার কখনও কোনও স্থায়ী
সমাধানও হয়নি।

সমস্যাটা সত্যিই শুধু অসমের নয়। বিভিন্ন রাজ্যেই রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয় ও ত্রিপুরা তার মধ্যে অন্যতম। তবে অসমে এ নিয়ে আলোড়ন বহুদিনের। কে সেখানকার মানুষ এবং কে নন, তা বুঝে নেওয়া নেহাতই সমকালীন সঙ্কট নয়। কারণ, বাইরে থেকে এসে অসমে বসবাস করার নিদর্শন দেশভাগের অনেক আগে থেকে রয়েছে। স্থানীয়দের মধ্যে তা নিয়ে অনিশ্চয়তাও অনেক দিনের। ফলে টানা অভিবাসন বন্ধ হওয়া জরুরি। তবে তার মানে কখনওই এই নয় যে হঠাৎ এক দিন কাউকে জানানো হবে, তাঁর নাগরিকত্ব বৈধ নয়। তার পরে তিনি কী করবেন? কোথায় যাবেন? যদি বা বলা হল যে তিনি আদতে বাংলাদেশের নাগরিক, তবেই কি সেই দেশ তাঁকে ফিরিয়ে নেবে? এ রকম কোনও আন্তর্জাতিক আইন আছে বলে তো জানা নেই। তবে এই সমস্যার সমাধান কী? এই যে বারবার সার্ক (এস এ এ আর সি) দেশগুলির বৈঠক হয়, কখনও তো শুনি না এ নিয়ে কোনও আলোচনা হচ্ছে বলে। হলেও কোনও স্থায়ী সমাধানের ভাবনা তো কখনও দেখা যায়নি।

১৯৭১ সালের জুন থেকে নভেম্বরের মধ্যে কত জন অভিবাসী এসেছেন, তা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের পুনর্বাসন বিভাগের প্রতিনিধি পি.এন. লুথরা একটি বই প্রকাশ
করেছিলেন ১৯৭৫ সালে। সেখানে স্পষ্ট দেখানো হয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গে ৭৫ লক্ষ এবং উত্তর পূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্য মিলিয়ে আরও ২০ লক্ষ মানুষ সীমান্ত পার করে ঢুকেছেন ওই সময়ে। গোটা জনসংখ্যাটা তবে ১ কোটির কাছাকাছি। মুক্তিযুদ্ধের পরে এই ১ কোটি মানুষ কি ফিরে গিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে? এ প্রশ্নের উত্তর কোনও রিপোর্টে প্রকাশ করা হয়েছে বলে তো শুনিনি। নিশ্চয় এঁরা সকলে চলে যাননি। বরং আরও অনেকে এসেছেন এ দেশের বিভিন্ন রাজ্যে। যাঁদের হিসেবও নেই সরকারের খাতায়। নিরন্তর অভিবাসন তো এ ভাবেই চলছে। এক দিন এঁদের কাউকে কাউকে হঠাৎ বলা হবে, ‘তোমরা বৈধ নও,
তোমরা চলে যাও’। এটা হয় নাকি? এটা তো অদ্ভুত! কোনও রাষ্ট্র-রাজনীতি এ ভাবে চলতে পারে কি? কিন্তু এ ভাবেই বুঝি চলে!

(অনুলিখন: সুচন্দ্রা ঘটক)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Assam NRC Refugee Bangladesh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE