শিলচরের শ্মশানঘাট শহিদবেদিতে ভাষাশহিদ বীরেন্দ্র সূত্রধরের স্ত্রী ধনকুমারীদেবী। মঙ্গলবার স্বপন রায়ের তোলা ছবি।
‘ডাকে ওই একাদশ শহিদরা ভাই’ — সকাল থেকে সবার মুখে মুখে এক গান। আট থেকে আশির নারী-পুরুষ তাতে গলা মেলাচ্ছেন। আওয়াজ উঠল— ‘মাতৃভাষা জিন্দাবাদ। বাংলাভাষা জিন্দাবাদ।’
এমনই ছবি আজ দেখা গেল গোটা বরাক উপত্যকায়।
১৯৬১ সালের ১৯ মে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় শিলচর রেল স্টেশনে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন ১১ জন তরুণ-তরুণী। তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দিনটি বরাকে ভাষাশহিদ দিবস হিসেবে পালিত হয়। প্রতি বছরের মতো এ দিনও সকাল থেকে শুরু হয় শহিদদের উদ্দেশে শ্রদ্ধা-তর্পণ। তবে এ বার শুধু শহিদ স্মরণ নয়, নতুন সঙ্কটের কথাও বলেন সবাই।
জাতীয় নাগরিক পঞ্জী (এন আর সি), ভূমিপুত্র, অসমিয়া সংজ্ঞা নির্ধারণের কথা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন বিভিন্ন বক্তা। তাঁরা জানান, সে সবের মোকাবিলায় ১৯৬১ সালের আন্দোলন থেকেই শিক্ষা নিতে হবে।
সকাল সাড়ে ৬টায় শিলচর রেল স্টেশন চত্বরে শহিদ-স্মারকে পুষ্পার্ঘ্য দেন সাংসদ সুস্মিতা দেব, পুরপ্রধান নীহারেন্দ্র নারায়ণ ঠাকুর, বিধায়ক দিলীপকুমার পাল, সিপিএম নেতা দীপক ভট্টাচার্য, বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের কাছাড় জেলা সভাপতি তৈমুর রাজা চৌধুরী, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক মঞ্চের সভাপতি সুব্রত ভট্টাচার্য। সেখানে ভাষাশহিদ স্মরণ সমিতি তাদের পত্রিকা ‘বর্ণমালার রোদ্দুর’ প্রকাশ করে। তার উন্মোচনেও সুস্মিতাদেবী এবং নীহারবাবুর গলা এক সুরে বাঁধা ছিল। কংগ্রেস সাংসদ বলেন, ‘‘কয়েক দিনের মধ্যে ঘরে ঘরে এন আর সি ফর্ম পৌঁছে দেবে সরকার। নির্দিষ্ট সেবাকেন্দ্রে নথিপত্র সহ তা জমা দিতে হবে। সবাই যেন সচেতন থাকেন।’’ বিজেপি পুরপ্রধানের বক্তব্য, ‘‘সমস্যা জটিলতর হচ্ছে। অনেকে বুঝতে পারছেন না, কী হতে চলেছে।’’ তাঁর আহ্বান, ‘‘বোঝাবুঝি পরে হবে, কেউ ফর্ম জমা দেওয়ায় গাফিলতি করবেন না।’’
সকাল ৮টায় সবাই জড়ো হন শিলচর শ্মশানঘাটে। সেখানেই সে দিন পাশাপাশি ১১টি চিতা জ্বালিয়ে অন্ত্যেষ্টি করা হয়েছিল বীরেন্দ্র সূত্রধর, কানাইলাল নিয়োগী, কমলা ভট্টাচার্যদের। এ দিন ছোট-বড় মিছিলে অনেকে শ্মশানে গিয়ে তাঁদের স্মরণ করেন। কোনও মিছিল শ্মশানে ঢুকছে, কেউ বের হচ্ছে। স্কুল-কলেজও ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে আসে। রেডক্রস হসপিটাল সোসাইটির সেবিকারা সাদা পোশাকে শহর পরিক্রমা করে।
শুধু কী বঙ্গভাষী? বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি মহিলা সমিতি ব্যানার হাতে এগিয়ে যান শহিদবেদির দিকে। ডিমাসা, মণিপুরি, নেপালি, হিন্দিভাষী— সবাই সামিল ছিলেন শহিদ-তর্পণে।
‘নবারুণ’ সাংস্কৃতিক সংস্থা পথনাটিকা পরিবেশন করে। মূল বিষয়— বর্তমান সঙ্কট। একই ধরনের নাটক পরিবেশিত হয় গাঁধীবাগে। ভাষাশহিদদের চিতাভস্ম রয়েছে সেখানকার স্মৃতিসৌধে। ১৯ মে গুলি চালনার সময় ধরে ঠিক ২টো ৩৫ মিনিটে গাঁধীবাগের স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানান সবাই। শুধু ফুল দিয়ে নয়, যে যার মত করে শ্রদ্ধার্ঘ্য দিলেন। কবি-সাহিত্যিক-আবৃত্তিকাররা কবিতা পাঠ করছিলেন। চিত্রশিল্পীরা ছবি আঁকেন। কেউ নাচছেন, কেউ গাইছেন। এআইডিএসও-কমসোমল লাল পতাকা কাঁধে নিজস্ব কায়দায় লাল সেলাম জানায়। অনেকে আবার সদ্য প্রকাশিত সাময়িকী, পত্রিকার পাতায় চোখ বুলিয়ে সংগ্রামের দিনগুলিকে বুঝতে চেষ্টা করেন।
গাঁধীবাগের ঠিক সামনে সারা দিন অনুষ্ঠান করে বরাক উপত্যকা মাতৃভাষা সুরক্ষা সমিতি। তারা আবার এ বারের উনিশে-কে ভাষা আইন প্রয়োগের পঞ্চদশ বর্ষ হিসেবে পালন করে। সমিতির সম্পাদক সুনীল রায় জানান, ১৯৬০ সালে অসমে অসমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা করে আইন প্রণীত হয়। বরাক উপত্যকা সে দিন প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিল। একাদশ তরুণ-তরুণী প্রাণ দিয়ে লড়াইকে জোরদার করে যায়। অসমে ছুটে আসতে হয়েছিল তখনকার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীকে। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা সরকারি ভাষার স্বীকৃতি পায়। সেই আলোচনার সূত্রেই ১৯৬৬ সালে সংশোধিত হয় অসম ভাষা আইন। তাই এটি বাংলার স্বীকৃতি কার্যকরের ৫০ বছর।
বঙ্গভবনেও সকালে শহিদ দিবসের আয়োজন করে বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy