গ্রাফিক্স: শৌভিক দেবনাথ।
দীর্ঘ অপেক্ষার পরে হোটেলে ঢুকলেন তিনি। পরনে সাদা পাঞ্জাবি। উপরে গেরুয়া হাফ জ্যাকেট। গলায় উত্তরীয়, তাতে দলীয় ব্যাজ ঝুলছে। ঈষৎ ক্লান্ত চেহারা।
‘চা খেয়েছেন?’ প্রশ্ন ছুড়েই বললেন, ‘‘একের পর এক মিটিং, জনসভা...।’’ কাঁচা-পাকা চুলে আঙুল চালিয়ে সোফায় পা মুড়ে বসেন সুনীল দেওধর।
আদপে মহারাষ্ট্রের মানুষ, অধুনা ত্রিপুরার ভারপ্রাপ্ত বিজেপি নেতা। ভারপ্রাপ্ত হওয়ার পরে সামনে এসেছেন তিনি। তার আগে তাঁকে বলা হত বিজেপি-র ‘ব্যাকরুম বয়েজ’-দের মধ্যে পয়লা সারিতে।
আরও পড়ুন
সন্ত্রাসের স্মৃতি, দারিদ্রের যুদ্ধ আর সাগিনা মাহাতো
ত্রিপুরার নির্বাচনী রণভূমে আসার অনেক আগে থেকেই সুনীল দেওধরের নামটা জানা ছিল। শোনা ছিল তাঁর কর্মকাণ্ডের কথাও। বিজেপি শেষমেশ আগরতলার আস্তাবল মাঠে তাদের বিজয় সমাবেশ করতে পারবে কি না ভবিষ্যৎই তার উত্তর দেবে। কিন্তু মানিক সরকারের রাজ্যে ঢুকে তাঁদের ক্যাডারভিত্তিক দলের মোকাবিলার জন্য যে যে পন্থা বিজেপি নিয়েছে, তা কপালে ভাঁজ ফেলেছে সিপিএমের কর্মী-সমর্থকদের। এবং এর বেশির ভাগ যাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত তিনি নিজে একটু লাজুক হেসে আনন্দবাজার ডিজিটালকে বললেন, ‘‘সিপিএমকে হারাতে গেলে বুথ জিততে হবে। আমি সেই চেষ্টাই করছি।’’
সেটা কী রকম?
সুনীল দেওধর জানাচ্ছেন, ত্রিপুরায় মূলত দু’ধরনের টিম তৈরি করা হয়েছে। অধিকাংশ টিমই সরাসরি ভোটের কাজ করছে। আর একটা টিম সরাসরি ভোটের কাজে না থেকে— প্রথম দলের, অর্থাত্ ভোটের কাজে নামা দলীয় কর্মীদের জন্য কাজ করছে।
দ্বিতীয় ধরনের টিমটার কথা আগে বলা যাক। বিজেপি ত্রিপুরার ভোটে নিয়োগ করেছে ৮৫ জন ‘বিস্তারক’-কে। এর মধ্যে ৬০ জন বিস্তারক আছেন রাজ্যের ৬০টি বিধানসভা কেন্দ্রের জন্য। বাকি ২৫ জনকে কাজে লাগানো হয়েছে বিভিন্ন চা বাগান ও অন্যান্য কাজে।
আরও পড়ুন
প্রচারে গেরুয়া ঝড়, প্রদীপ আগলাতে মরিয়া মানিক
এই বিস্তারকদের কাজটা ঠিক কী?
এঁরা কোনও দলীয় বিক্ষোভ কর্মসূচি বা সরাসরি ভোটারদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন না বা প্রকাশ্যে কোনও কাজকর্ম করবেন না। তাঁদের কাজ মূলত দলের অভ্যন্তরীণ বিক্ষোভ মেটানো, দলীয় বিবাদের নিষ্পত্তি করা এবং দলীয় মনোমালিন্য বা বিবাদ যাতে প্রকাশ্যে না আসে তা নিশ্চিত করা। এই বিস্তারকেরা প্রয়োজন মতো রিপোর্ট দেবেন দলীয় দফতরে। বিস্তারকরা বয়সে তরুণ। বড়জোর ২৫-২৬। এঁরা এসেছেন মূলত অসম, ঝাড়খণ্ড ও উত্তরপ্রদেশ থেকে।
ত্রিপুরায় বিজেপি এ বার নিয়োগ করেছে ‘পান্না প্রমুখ’দের। উত্তর-পূর্বের রাজ্যে এই প্রথম এঁদের নিয়োগ করা হল। এই ‘পান্না প্রমুখ’রা হলেন পাতার ভারপ্রাপ্ত। সহজ ভাবে বলতে গেলে, প্রতিটি বুথের ভোটার তালিকায় ১৭-১৮টি পাতা থাকে। প্রতিটি পাতায় ৬০ জন করে ভোটারের নাম আছে। প্রতিটি পাতার ভারপ্রাপ্তদের কাজ হল, প্রতি ১৫ দিনে অন্তত এক বার করে তাঁরা প্রতিটি ভোটারের কাছে যাবেন। তাঁদের মনের কথা শুনবেন। কোনও সাহায্যের দরকার হলে করবেন। বিজেপি নেতৃত্ব জানাচ্ছেন, কংগ্রেসের ভোটারদের পাশে পাওয়া তুলনায় সহজ, কিন্তু তাঁদের মূল লক্ষ্য সিপিএম এবং নিরপেক্ষ ভোটারদের পাশে পাওয়া। ‘পান্না প্রমুখ’দেরও সে ভাবেই নির্দেশ দেওয়া আছে।
আরও পড়ুন
‘নীতি থাকলে কি এমন জোট করত বিজেপি?’
আবার পাতার ভারপ্রাপ্তেরাও যাতে নিজেদের কাজের গুরুত্ব বুঝতে পারেন এবং নিজেদেরও গুরুত্বপূর্ণ বলে ভাবতে পারেন— তার জন্য প্রতি সপ্তাহে বিজেপি নেতৃত্বের কাছ থেকে তাঁদের কাছে টেলিফোন যায়।
ত্রিপুরায় বুথের সংখ্যা ৩,২৪০। প্রতি পাঁচটি বুথের জন্য বিজেপি নিয়োগ করেছে এক জন করে ‘শক্তিকেন্দ্র বিস্তারক’। দেওধর বলছেন, এঁদের কাজ হল পার্টির কর্মসূচি এবং অন্যান্য কাজকর্ম যাতে মসৃণ ভাবে চলে তা দেখা।
সুনীল দেওধর।—নিজস্ব চিত্র।
প্রত্যক্ষ জনসংযোগ বাড়াতে বিজেপি এ বার অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে আরও একটি পন্থা নিয়েছে। সুনীল দেওধরের বক্তব্য, দেশের মধ্যে এই প্রথম ত্রিপুরায় তা প্রয়োগ করা হল। পরে অন্যান্য রাজ্যেও তা করা হবে। বেশ কয়েক জন ক্যাডার বিজেপি নিয়োগ করেছে যাদের বলা হচ্ছে ‘ট্রেন সম্পারক’। এই কর্মীরা গত এক বছর ধরে আগরতলা স্টেশন থেকে বিভিন্ন দিকের ট্রেনে উঠছেন। যাত্রীদের গন্তব্যে যাচ্ছেন এবং ফিরছেনও। তাঁরা যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলছেন। তাঁদের ফোন নম্বর এবং যাঁদের মেল আইডি আছে, তা নিচ্ছেন। নেওয়া হচ্ছে তাঁদের ঠিকানা ও তাঁরা কোন বিধানসভা কেন্দ্র থেকে এসেছেন, সেই তথ্যও। তাঁদের কোনও সমস্যা আছে কি না জানছেন। সুনীলের কথায়: ‘‘ট্রেন এমন এক জায়গা, যেখানে যাত্রীরা মন খুলে সহযাত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। ট্রেনে সিপিএমের ভয় নেই যাত্রীদের। আমাদের কর্মীরা নরেন্দ্র মোদীর ছবি দেওয়া টি শার্ট পরে ট্রেনের কামরায় ব্রসিওর বিলি করছে। এই ভাবে আমরা হোয়াটসঅ্যাপে প্রায় ৪০ হাজার মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে পেরেছি। তাঁদের নিয়মিত ফোনও করা হয়।’’ কাজে নামানোর আগে এই বিজেপি কর্মীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
এর পাশাপাশি সুনীল আরও একটি কাজ করে গিয়েছেন। চিকিৎসার জন্য ত্রিপুরার প্রচুর মানুষ শিলচরে যান। তাঁর স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘মাই হোম ইন্ডিয়া’ শিলচর স্টেশনে তাঁদের জন্য সাহায্য বুথ খুলেছে। মাস ছ’য়েক ধরে চালানো হচ্ছে একশো শয্যার ‘স্বাস্থ্য সেবা সদন’। এই সেবা সদনে রোগী ও তাঁর আত্মীয়েরা দৈনিক মাথাপিছু একশো টাকার বিনিময়ে থাকা-খাওয়ার সুযোগ পান। এ পর্যন্ত তাঁরা দু’হাজারেরও বেশি মানুষকে এই পরিষেবা দিয়েছেন বলে সুনীলের বক্তব্য।
আরও পড়ুন
ত্রিপুরায় বিজেপি-র এই উত্থান কী ভাবে?
এই বিধানসভা নির্বাচনে জনসংযোগের যাবতীয় পন্থা ব্যবহার করছে বিজেপি। কারণ, বিজেপি জানে, ত্রিপুরায় সিপিএমের মতো ক্যাডারভিত্তিক সুশৃঙ্খল দলের সঙ্গে টক্কর দিতে গেলে বুথ পর্যন্ত পৌঁছতে হবে তাদের। তাতেও কি নিশ্চিত বিজেপি? নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহের অত্যন্ত আস্থাভাজন সুনীল দেওধর তাই বলছেন, ‘‘সিপিএম ভয়ঙ্কর। ওরা ফ্যানাটিক। মেয়ের বিয়ে দেওয়ার চাইতেও ওরা পার্টিকে গুরুত্ব দেয় বেশি। তাই একচুল ঢিলে দেওয়ারও প্রশ্ন নেই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy