নাগরিকত্ব বিলকে ঘিরে গড়ে ওঠা বিতর্কের প্রেক্ষিতে বাঙালি অধ্যুষিত বরাকে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে আগেই নেমেছে বরাক কংগ্রেস। এ বার সক্রিয় হয়ে উঠলেন বরাকের বিজেপি নেতৃত্বও।
কার্যত নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলকে ঘিরে দ্বিধাবিভক্ত রাজনৈতিক মহল। অসম প্রদেশ কংগ্রেস এই বিলের বিরোধিতায় নেমেছে। প্রাক্তন কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ বিলের বিরোধিতায় সরব। বিল নিয়ে আসুর চরম হুঁশিয়ারির পরে রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বও কার্যত নীরব। একদা অসমীয়া-অস্মিতার ধারক
সর্বানন্দ সোনোয়াল এখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি নাগরিকত্ব বিল সংক্রান্ত যৌথ সংসদীয় কমিটিকে অসমে এসে রাজ্যের মনোভাব সঠিক অনুধাবন করার জন্য প্রকাশ্যেই অনুরোধ করেছেন।
এই পরিস্থিতিতে বরাক কংগ্রেস রাজ্য নেতৃত্বের গৃহীত মনোভাবের ঠিক ১৮০ ডিগ্রি বিপরীতে দাঁড়িয়ে। বরাকে নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে তিনটি জেলার কংগ্রেস নেতৃত্ব এ ব্যাপারে নিজেদের ভূমিকা স্পষ্ট করতে একটি বৈঠকও ডেকেছেন। এই সার্বিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বরাকের মানুষের অনুকূলে নিজেদের ভূমিকাও স্পষ্ট করা বরাক বিজেপির পক্ষেও জরুরি হয়ে উঠেছিল।
আজ কার্যত সেই লক্ষ্যেই সাংবাদিক বৈঠক ডেকে আসু ও কংগ্রেসকে আক্রমণ করল বরাক বিজেপি নেতৃত্ব। বিজেপির রাজ্য সাধারণ সম্পাদক তথা বরাকের গুরুত্বপূর্ণ বিজেপি নেতা রাজদীপ রায় বলেন, আসু-সহ কিছু সংগঠন অসমীয়া-বাঙালির মধ্যে অশান্তি কায়েমে তৎপর হয়ে উঠেছে। অসমীয়া জাতীয়তাবাদের নামে বরাক-ব্রহ্মপুত্র বিভেদ তৈরি করতে চাইছে। আশির দিনগুলি স্মরণ করিয়ে রাজদীপবাবু বলেন, ওই আন্দোলনের ফলে অসম ৩০-৪০ বছর পিছিয়ে পড়েছে। এখন উন্নয়নের ছোঁয়া পেতেই শুরু হয়ে গিয়েছে ষড়যন্ত্র।
বরাক বিজেপির এই নেতার সাফ কথা, ‘‘উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব নিয়ে আমাদের কোনও লুকোচুরি নেই। এ নিয়ে জনসঙ্ঘের সময় যে কথা বলা হয়েছিল, আজও আমরা সেই একই কথা বলছি। সে জন্য আমাদের কোনও তাড়াহুড়োও নেই। গত বছরের সেপ্টেম্বরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নাগরিকত্ব আইনে কী ধরনের সংশোধন আসছে, তা জানিয়ে দেওয়া হয়। এ বার বিজেপি সরকার বিল এনেছে।’’ তাঁর দাবি, বিজেপির শরণার্থী সংক্রান্ত অবস্থান জেনেই অসমের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষ তাঁদের ক্ষমতায় বসিয়েছেন।
অসম চুক্তি লঙ্ঘনের কথা বলে আসু নেতারা বিতর্ক উস্কে দিতে চাইছেন বলে তিনি অভিযোগ করেন। রাজদীপবাবু বলেন, ‘‘অসম চুক্তি ত্রিপাক্ষিক একটি সমঝোতা মাত্র। কেন্দ্র-রাজ্যও এর পক্ষ। বিভিন্ন পক্ষে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতার শর্তে হেরফের করতেই পারে।’’ এ ছাড়া, অসম চুক্তিকে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে উল্লেখ করেন তিনি। জানান, তাঁরা নেহরু-লিয়াকত চুক্তি পূরণ করতে চলেছেন। ৭০ বছর ধরে নেহরুর দল এই আন্তর্জাতিক চুক্তিকে অবজ্ঞা করেছিল। ভূমিপুত্র বা স্থায়ী বাসিন্দার মনগড়া সংজ্ঞা চলছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। তাঁর দাবি, বরাকের বাঙালিরাও অসমের আদি বাসিন্দা। যুক্তি হিসেবে তিনি ১৯৫০ সালের এক আইনের ‘ল্যান্ড হোল্ডিং অব ইন্ডিজেনাস পার্সন’-য়ের দ্বাদশ সংযোজন পড়ে শোনান। তাঁর কথায়, অসমের ভূমিপুত্রের কোনও আইনি সংজ্ঞা আজও তৈরি হয়নি। ফলে ‘ইন্ডিজেনাস পার্সন’ সম্পর্কে
একমাত্র ওই জায়গাতেই সামান্য উল্লেখ রয়েছে।
কী উল্লেখ করা হয়েছে? রাজদীপ রায় পড়ে শোনান, ‘‘অসমিয়া ও পার্বত্য ভাষায় যাঁরা কথা বলেন, তাঁরাই এখানকার আদি বাসিন্দা। আর কাছাড় (তখন পুরো বরাক) জেলায় যাঁরা সেখানকার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন, তাঁরাও আদি বাসিন্দা।’’ ফলে অসমের ভূমিপুত্রের
কথা বলে বরাকের বাঙালিদের বাদ দেওয়া যায় না বলে জোর গলায় দাবি করেন তিনি।
শিলচরের সাংসদ সুস্মিতা দেবকে খোঁচা দিয়ে রাজদীপবাবুর মন্তব্য, ‘‘তিনি একজন আইনজীবী জেনেও বলছি তাঁর ভারতীয় সংবিধানটা ভাল করে পড়া দরকার। কোন দেশে কী ভাবে শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দিয়েছে, সে সবও তাঁর জানা প্রয়োজন।’’ প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈয়েরও সমালোচনা করেন রাজদীপ রায়। তিনি বলেন, ‘‘গগৈ দিনেরাতে এক এক রকমের বক্তব্য রাখছেন। ১৫ বছরের শাসনকালে এক ধরনের কথা বলেছেন। আর এখন বলছেন উল্টো।’’ তাঁর মন্ত্রিসভাই যে শরণার্থীদের নাগরিকত্ব প্রদানে রাজ্যের আপত্তি নেই বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সে কথাও তিনি স্মরণ করিয়ে দেন। তবে জোট-শরিক অসম গণ পরিষদের বিল বিরোধী মনোভাবের প্রসঙ্গটি রাজদীপবাবু এড়িয়েই গিয়েছেন। এড়িয়ে গিয়েছেন ‘অসমের মানুষের আবেগ’ সংক্রান্ত মুখ্যমন্ত্রী সোনোয়ালের বক্তব্যকেও।
বিজেপির কাছাড় জেলা কমিটির সম্পাদক নীহাররঞ্জন দাস অসম চুক্তির পর এ ভাবে নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন হতে পারে না বলে একাংশের বক্তব্যকে ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেন। তিনি জানান, সংশোধন করে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর নতুন সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হচ্ছে। ফলে অসম চুক্তির সঙ্গে বিরোধের জায়গা নেই। ধর্মীয় পরিচিতিতে নাগরিকত্বের কথা বলায় এটি আইনে পরিণত হলেও সুপ্রিম কোর্টে খারিজ হয়ে যেতে পারে, এই আশঙ্কাকেও তিনি অমূলক বলে জানান। তাঁর ব্যাখ্যা, গুজরাট ও রাজস্থানে পাকিস্তানের শরণার্থীদের আগেই নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে। সেখানে হিন্দু শব্দের স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে।
বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন, সম্মিলিত সংস্কৃতি মঞ্চ, নাগরিক অধিকার রক্ষা কমিটিও দিল্লিতে যৌথ সংসদীয় দলের সামনে শরণার্থীদের নাগরিকত্ব প্রদানের কথা বলেছেন। তবে ধর্মীয় পরিচিতির বিরোধিতা করেছেন তাঁরা। রাজদীপবাবুরা অবশ্য এ ব্যাপারেও তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানাতে চাননি। ‘তাঁরা কী বলেছেন জানি না’ বলে প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যান। শুধু ‘দেশভাগের বলি’ শব্দবন্ধ ব্যবহারে পরবর্তী সময়ে সমস্যা হতে পারে বলে উল্লেখ করে জানান, কখনও পাকিস্তান ভাঙলে তখন সঙ্কট বেড়ে যাবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy