Advertisement
১১ মে ২০২৪

পুলিশ রুখলেন শাহিনবাগ-জননী

এলাকার অসংখ্য মানুষ, এমনকি বন্ধ দোকানের মালিকেরাও তাঁদের পাশে এসে দাঁড়ান।

মশাল জ্বেলে প্রতিরোধের শপথ। রবিবার শাহিনবাগে। নিজস্ব চিত্র

মশাল জ্বেলে প্রতিরোধের শপথ। রবিবার শাহিনবাগে। নিজস্ব চিত্র

সোমা মুখোপাধ্যায়
শাহিনবাগ শেষ আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০২০ ০৪:৫৫
Share: Save:

২৩ দিনের মাথায় শাহিনবাগের আন্দোলন ভাঙার চেষ্টা হল। আজ বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ পুলিশ এসে আন্দোলনকারীদের তৎক্ষণাৎ এলাকা খালি করতে চাপ দেয়। অভিযোগ, তাতে ‘কাজ’ না-হওয়ায় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ ফিরে এসে ব্যারিকেড ভেঙে ফেলে পুলিশ। সঙ্গে আবার উচ্ছেদের হুঁশিয়ারি। কিন্তু আন্দোলনকারীরা ছিলেন অবিচল। এলাকার অসংখ্য মানুষ, এমনকি বন্ধ দোকানের মালিকেরাও তাঁদের পাশে এসে দাঁড়ান। দোকান-মালিকদের একাংশ বলেন, ‘‘ব্যবসা বন্ধ থাকায় আমরা খুবই সমস্যায় পড়েছি, সে কথা ঠিক। কিন্তু এ ভাবে একটা আন্দোলন ভাঙতে দেব না।’’

আন্দোলনকারীদের তরফে সোনু ওয়ারসি রাতে বলেন, ‘‘মায়েরা বাচ্চাদের কোলে নিয়ে পুলিশের সামনে দাঁড়িয়েছেন। বলেছেন, এক পা-ও সরব না। এলাকার বাইরের মহিলারাও তাঁদের সন্তান কোলে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। আমরা তো গায়ের জোরে পুলিশ-প্রশাসনের সঙ্গে পারব না। মানুষের এই সম্মিলিত শক্তিই আমাদের একমাত্র জোর।’’

সেই সম্মিলিত শক্তির ছবিই দিনভর শাহিনবাগে।

শহরের অন্যতম ব্যস্ত রাস্তা তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে আটকে চলছে সিএএ-এনআরসির বিরুদ্ধে আন্দোলন। একাধিক মেট্রো স্টেশনের গেট আটকানো। খোলা যাচ্ছে না দোকান, শপিং মল। তবু কোনও পাল্টা প্রতিবাদ নেই। দোকান খোলানোর জন্য রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে জোর খাটানোর চেষ্টা নেই। বরং হাতে হাত রাখার আশ্বাস আছে।

এই আন্দোলনকে ঘিরে একটা পারস্পরিক বিশ্বাসের নজিরবিহীন ছবি তৈরি হয়েছে শাহিনবাগে। সব ঝাঁ-চকচকে শপিং মল এবং দোকানের সঙ্গে শাহিনবাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের এত দিন বড়সড় দূরত্ব ছিল, এখন সেই সব দোকানের মালিক-কর্মীরাই তাঁদের পরম বন্ধু। আন্দোলনকারীরাই গড়ে তুলেছেন স্বেচ্ছাসেবকের দল। তারাই ২৪ ঘণ্টা নজর রাখছে দোকানের ওপর। কলেজ পড়ুয়া রিয়াজ বললেন, ‘‘একটা দোকানের শাটারে আমরা পোস্টার লাগাতে দিইনি। বাইরের কোনও ভুলভাল লোক এখানে ঢুকে যাতে দোকান বা মলের সম্পত্তি নষ্ট না করে, সে দিকে কড়া নজর রাখা হচ্ছে।’’

দোকান-মালিকদের একটা অংশ খাবার জোগানের দায়িত্ব নিয়েছেন। প্যাকেটে ভরে কাজু, কিসমিস, আখরোট বিলি করতে দেখলাম এক বৃদ্ধকে। জানালেন, ‘‘ঠিকঠাক খায়, নাকি ভুখা থাকে জানি না তো! তাই খাওয়াতে এসেছি।’’ তিনি মহম্মদ পারভেজ। স্থানীয় দোকান-মালিক।

এক স্বেচ্ছাসেবক রিজওয়ান বলেন, ‘‘খাবারের জোগান কোথা থেকে হচ্ছে, সে প্রশ্ন তুলে মাঝেমধ্যেই আমাদের অস্বস্তিতে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে। যেমন, কংগ্রেসের তরফে বিরিয়ানি বিলি করা হচ্ছে বলে এক বার গুজব রটানোর চেষ্টা করেছিল বিজেপি। আমরা সঙ্গে সঙ্গে সেটা রুখে দিতে পেরেছি। আরে, যাঁরা ঘর সংসার ফেলে দিনের পর দিন এখানে পড়ে রয়েছেন, বিরিয়ানির টোপ দিয়ে তাঁদের কি কিনে নেওয়া যায়?’’

কথা বলতে বলতেই খেয়াল করলাম, দল বেঁধে হেঁটে আসছেন কয়েক জন। আন্দোলনকারীদের সামনে এসে দাঁড়াতেই তাঁরাও উঠে জড়িয়ে ধরলেন ওঁদের। হাতের ব্যাগ থেকে খাবার, ওষুধ, মশা তাড়ানোর ধূপ, ফিনাইল বেরোতে লাগল ঝটপট। আন্দোলনের অন্যতম মুখ আনসারি বেগম ওই দলের এক জনের হাত ধরে সামনে এনে বললেন, ‘‘এই যে, এখানে আমাদের জন্য অস্থায়ী শৌচাগারের ব্যবস্থা ইনি করেছেন। বলেছেন, আন্দোলন করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে তো চলবে না।’’

শাহিনবাগের আশপাশ তো বটেই, দিল্লির তথাকথিত অভিজাত আবাসনগুলি থেকেও বাসিন্দারা আসছেন। বাড়িয়ে দিচ্ছেন সাহায্যের হাত। ‘‘ওঁরা তো কেউ কেউ এখানে এসে বাচ্চাদের হোমওয়ার্ক পর্যন্ত দেখে দিচ্ছেন। বলছেন, আপনারা গোটা দেশের হয়ে লড়ছেন, আপনাদের সন্তানদের দায়িত্বটুকু আমাদের নিতে দিন’’, বললেন তনিশা খাতুন।

যাঁদের দেখিয়ে বললেন, কথা বলে জানলাম তাঁদের এক জন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। এক জন কর্পোরেট সংস্থার কর্তা। আর এক জন দিল্লির নামী বেসরকারি হাসপাতালের একটি বিভাগের প্রধান চিকিৎসক। যাঁকে সাধারণ সময়ে ফি দিয়ে দেখানোর কথাও কল্পনা করতে পারেন না এই এলাকার অধিকাংশ মানুষ।

হোক না সাময়িক। তবুও তো শ্রেণিবৈষম্য খানিকটা হলেও মুছিয়ে দিতে পেরেছে শাহিনবাগ। তাই দূরে বিধায়কের দফতরের সামনে দামি বিদেশি গাড়ি দাঁড় করিয়ে যখন বৃদ্ধ আনোয়ার হোসেন নিজের টুপি আর মাফলার খুলে জড়িয়ে দেন এক শিশুর মাথায়, আর অনুষ্কা চৌধুরী তিন বছরের হামিদাকে কোলে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তার কানে কানে বলেন, ‘‘ইয়ে পেয়ারি পেয়ারি আজাদি’’, তখন যেন শুধু নতুন ভারতের ইতিহাস নয়, এক রূপকথারও জন্ম হয় দিল্লির বুকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

CAA Shaheen Bagh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE