শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুরোধে এক বিশেষ চা চক্রের আয়োজন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার। আগামী কাল চতুর্থ বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণের পর সংবিধান মেনে এই চা চক্রের আয়োজক রাজ্যপাল নিজেই।
কিন্তু এ বার নীতীশের শপথগ্রহণ আর নিছক কোনও রাজ্যের এক মুখ্যমন্ত্রীর শপথগ্রহণ নয়। আর তাই চা চক্রটাও নিছক রাজভবনের চা চক্র নয়। অনুষ্ঠানটি সাংবিধানিক হলেও আগামিকালের ঘটনা নরেন্দ্র মোদীর দিল্লির মসনদের বিরুদ্ধে এক সর্বভারতীয় রাজনীতির মঞ্চ গঠনের প্রস্তুতি। তাই অতিথি তালিকায় রাহুল গাঁধী যেমন রয়েছেন, তেমনই আছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। এনসিপি নেতা শরদ পওয়ার যেমন আছেন, তেমন আছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবাল। ফলে আগামিকাল পাটলিপুত্র নগরীতে যেন বীজবপণ হতে চলেছে পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনের রণকৌশলের। দিল্লির রাজনীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণার ব্যাপারে বাংলা আর বিহার চিরকালই আঁতুরঘর। লোহিয়া থেকে জয়প্রকাশ নারায়ণ, সুভাষ বসু থেকে চারু মজুমদার— বাংলা, বিহার বিক্ষুব্ধ রাজনীতির পরীক্ষাগার। সম্ভবত সেই কারণেই নীতীশ কুমার অতিথি তালিকাতেও সব চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন যে মুখ্যমন্ত্রীকে তাঁর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর অতিথি তালিকায় রাহুল গাঁধীর পাশাপাশি রয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম। তালিকার অনেক পিছনে আছেন তরুণ গগৈ বা অন্য মুখ্যমন্ত্রীরা।
নীতীশ কুমার এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘মমতা তো শুধু মুখ্যমন্ত্রী নন। তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুধু বাংলায় নয়, গোটা দেশে তিনি এক জনপ্রিয় নেত্রী।’’ আবার মমতাও বলেছেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে ব্যক্তিগত ভাবে কিছুই বলার নেই। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের প্রশ্নে রাজ্যের প্রতি যে অবিচার বা বঞ্চনা, তার প্রতিবাদে মুখর হওয়াটা রাজ্যের মানুষের স্বার্থেই করা প্রয়োজন। আর সেই কারণেই মুখ্যমন্ত্রীদের সম্মেলন ডাকার দাবি জানিয়েছি।’’ এর আগেও মমতা দিল্লি এসে অরবিন্দ কেজরীবালের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক নিয়ে সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। নীতীশ কুমার নিজে আসতে না পারলেও চিঠি দিয়ে সমর্থন জানিয়েছিলেন।
প্রকাশ্যে না বললেও এটা স্পষ্ট যে নীতীশ কুমারও চাইছেন, তাঁর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানটিকে মূলধন করে একটা নতুন ফ্রন্ট গঠনের চেষ্টার দিকে সকলে মিলে এগোক। স্বভাবতই জে়ডি ইউ নেতারা নীতীশ কুমারকে প্রধানমন্ত্রী পদে দেখতে চান। লালু ও নীতীশের মধ্যে অভ্যন্তরীণ সূক্ষ ল়ড়াই থাকলেও, লালু নিজে জানেন, পশুখাদ্য কেলেঙ্কারির জন্য তাঁর প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হওয়া কার্যত অসম্ভব। শরদ যাদব প্রস্তাব করেছেন, এই বিরোধী নেতারা সবাই মিলে একটা যৌথ কর্মসূচি গ্রহণ করুন। আপাতত এই কর্মসূচিটিকে সংসদের কাজকর্মের মধ্যেও সীমাবদ্ধ রাখা যায়। সংসদের বিভিন্ন ঘটনাবলীতে অ-বিজেপি দলগুলি কী ভাবে কাজ করবে তার একটা নির্দেশিকা তৈরির চেষ্টা করতে চাইছেন নীতীশ কুমার এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুলায়ম সিংহ যাদব বিহার নির্বাচনে নীতীশ-লালুর জোট সঙ্গী না হলেও এ বার তিনিও ভুল শুধরে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে এই মঞ্চে সামিল হতে চাইছেন। আর এই কারণেই মুলায়ম দু’দিন আগে মমতাকে ফোন করেছিলেন। মোদী বিরোধী রাজনীতির সলতে পাকানোর কাজটা দ্রুত এগোচ্ছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী না এলেও তিনি আগামিকাল বেঙ্কাইয়া নায়ডু এবং রাজীবপ্রতাপ রুডিকে পটনায় যেতে বলেছেন। যদিও নীতীশ কুমারের সরকারের পক্ষ থেকে যে অতিথি তালিকা দেওয়া হয়েছে তাতে এই দু’জনের নাম নেই। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিত, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী দেবেগৌড়া আছেন, কিন্তু বিজেপি-র নেতাদের নাম নেই। এর থেকে খুব স্পষ্ট, নীতীশের রাজনৈতিক অভিমুখটা কী?
গতকালই পীযূষ গোয়েল বিহারের জন্য উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে তাঁরা বিহার বিরোধী নন। প্রধানমন্ত্রী নিজে আসার কথা ভাবলেও বিহারের উত্তাল রাজনীতির কথা ভেবে তাঁর দল তাঁকে পটনা সফরের কৌশল থেকে নিরস্ত করে। নীতীশের প্রিয় মিত্র সুশীল মোদীর নামও অতিথি তালিকায় নেই। অরুণ জেটলিও নেই। নেই পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রীও। অথচ সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরি জোটসঙ্গী না হলেও, কাল থাকছেন। অর্থাৎ, মমতা এবং সীতা দু’জনেই এক মঞ্চে সামিল হচ্ছেন। সেই একই মঞ্চে আবার রাহুল গাঁধীও থাকছেন। ১৯৯৮ সালে বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহের নেতৃত্বে বাজপেয়ী ও জ্যোতিবাবুকে এক মঞ্চে দেখা গিয়েছিল। কিন্তু সিপিএম-তৃণমূলকে কখনও এক মঞ্চে দেখা যায়নি। অবশ্য লোকপাল বিল নিয়ে রাজ্যসভায় এক বার কক্ষ সমন্বয় হয়েছিল সিপিএম এবং তৃণমূলের।
মোদীর বিরুদ্ধে বিহার নির্বাচনের পর অসন্তোষ তীব্র হয়ে উঠেছে। তাকে কেন্দ্র করে ফেডেরাল ফ্রন্ট গঠনের সম্ভাবনা তীব্র হয়ে উঠছে। সংসদের কার্যকলাপের কর্মসূচি তৈরি করে উঠতে চাইছেন নেতারা, যেটা ভবিষ্যতে লোকসভা নির্বাচনের কর্মসূচি যৌথ হয়ে উঠতেই পারে। তবে আগামিকালই কিন্তু ফ্রন্ট গঠন হচ্ছে না। নির্বাচনের প্রস্তুতির কথাও কেউ বলছেন না। যা হচ্ছে সাংবিধানিক শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান। কিন্তু রাজনীতিতে প্রতীকী ভাষাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
বলা যেতে পারে, এটা আরম্ভের আগে সেই আরম্ভ!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy