Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪

নোট-যুদ্ধ সামাল দিতে ফের পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব

কথা ছাড়া গতি নেই! তবে সেটাও তো হতে হবে পরস্পরের সুবিধে-অসুবিধে বুঝে! মোটামুটি এই বোঝাপড়ার মনোভাবকে সামনে রেখেই ইসলামাবাদের সঙ্গে ফের বিদেশসচিব পর্যায়ে আলোচনা শুরুর বার্তা দিল নয়াদিল্লি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৩:২২
Share: Save:

কথা ছাড়া গতি নেই! তবে সেটাও তো হতে হবে পরস্পরের সুবিধে-অসুবিধে বুঝে! মোটামুটি এই বোঝাপড়ার মনোভাবকে সামনে রেখেই ইসলামাবাদের সঙ্গে ফের বিদেশসচিব পর্যায়ে আলোচনা শুরুর বার্তা দিল নয়াদিল্লি। তবে এখনই নয়, উত্তরপ্রদেশের ভোট মিটে গেলে হতে পারে সেই আলোচনা। পর্যবেক্ষকরা অবশ্য বলছেন, উত্তরপ্রদেশের ভোটই সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা নয়। গত ৮ নভেম্বর থেকে দেশেই অন্য এক যুদ্ধ শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। নোট-বাতিলের ফ্রন্টে ভাল কিছু ফল আম-জনতার সামনে তুলে ধরার ব্যাপারে বেশ চাপে রয়েছেন তিনি। সেই চাপ সামলানোটাই এখন তার প্রথম লক্ষ্য। এর মধ্যে প্রতিবেশীর সঙ্গে উত্তেজনা বাড়িয়ে চলা বা জিইয়ে রাখাটা বিপজ্জনক হতে পারে। ঘরোয়া রাজনীতিতেও তা নিয়ে পাল্টা চাপে পড়ার আশঙ্কা থেকে যাবে।

নোট-বাতিলের পরে ডিজিটাল লেনদেন বাড়ানোর জন্য মোদী প্রচারে ঝাঁপালেও, ভারতের মতো দেশে তা কতটা সম্ভব তা-ই নিয়েই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। নোটের জোগান না বাড়ায় লাইনের মানুষের দুর্ভোগ কমানো যাচ্ছে না। মোদী নিজে ধৈর্য দেখানোর জন্য মানুষকে ‘সাবাসি’ দিলেও এটিএমে টাকা তোলার লাইনে, ব্যাঙ্কে মারা যাচ্ছেন মানুষ। এমন নড়বড়ে অবস্থায় পাকিস্তানের সঙ্গে বিরোধে গিয়ে জাতীয়তাবাদের হাওয়া তোলার চেষ্টা হঠকারী হবে, এটা বেশ বুঝতে পারছেন নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহরা।

গত ৮ নভেম্বরের সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের পরেই এ ব্যাপারে এক দফা জল মাপা হয়ে গিয়েছে। ওই সেনা অভিযানের কৃতিত্ব জাহিরে নেতা-মন্ত্রী-দল-সঙ্ঘ সকলে মিলে ঢাক পেটাতে নেমে ফল হয়েছে উল্টো। জাতীয়তাবাদের হাওয়াকে মোটেই ঝড়ে পরিণত করা যায়নি। উল্টে ওই সেনা অভিযানের পরেই বেড়ে গিয়েছে প্রত্যাঘাত। পাক রেঞ্জারদের গোলা ও জঙ্গি হামলায় মৃত্যু হচ্ছে সেনা জওয়ান থেকে সাধারণ নাগরিকদের। আক্রান্ত হচ্ছে একের পর এক সেনা ঘাঁটি। এই অবস্থায় পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বন্দ্ব আপাতত শিকেয় তুলে রেখে নোট-বাতিলের ডামাডোল সামলানো বা ঘর গোছানোর দিকেই বেশি মন দিতে হচ্ছে মোদী সরকারকে।

কূটনীতিকরা আবার এটাও মনে করছেন যে, দেশের নোট-যুদ্ধে মন দিতে প্রতিবেশীর সঙ্গে বাগ্‌যুদ্ধে শান না দিতে চাইলেও উত্তরপ্রদেশে ভোটের মুখে পাকিস্তান সম্পর্কে কোনও নরম অবস্থান নেওয়া সম্ভব নয় মোদীর পক্ষে। কূটনৈতিক সূত্রের খবর, ইসলামাবাদকে বার্তা দেওয়া হয়েছে যে, বিনা শর্তে পাকিস্তানকে আলোচনার জমি ছাড়তে রাজি নয় নয়াদিল্লি। আগামী ক’মাসে পাকিস্তান যেন আলোচনার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। এর জন্য দু’টি শর্ত দেওয়া হয়েছে নওয়াজ সরকারকে:
• সীমান্তপারের সন্ত্রাস রোধে পাকিস্তানকে আগামি তিন মাসের মধ্যে কিছু করে দেখাতে হবে।
• আলোচনা হবে পুরোপুরি দ্বিপাক্ষিক ভিত্তিতে। অর্থাৎ, হুরিয়তকে কোনও ভাবেই এর সঙ্গে যুক্ত করা যাবে না।

আগেও দ্বিপাক্ষিক আলোচনার যে কোনও উদ্যোগে এই দু’টি শর্তকেই সামনে রেখে এগিয়েছে নয়াদিল্লি। কিন্তু পাকিস্তান বারবারই উল্টো পথে হেঁটেছে। এ বারে তারা নতুন কিছু করবে কি না সে প্রশ্ন আলাদা। তবে কূটনীতিকরা মনে করছেন, আলোচনার দরজা খোলার ব্যাপারে এই মুহূর্তে যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে পাকিস্তানেরও। গত কালই অমৃতসরে এর স্পষ্ট ইঙ্গিত মিলেছে। প্রত্যাশিত তারিখের এক দিন আগেই ‘হার্ট অব এশিয়া’ সম্মেলনে যোগ দিতে গত কাল অমৃতসরে পৌঁছে যান পাক প্রধানমন্ত্রীর বিদেশনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা সরতাজ আজিজ। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে উষ্ণ করমর্দন, নৈশাহার, শারীরিক কারণে অমৃতসরে অনুপস্থিত বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের জন্য ফুল পাঠানো— এই সবের মাধ্যমে বার্তা আরও স্পষ্ট করার চেষ্টা হয় পাক তরফে।

পাশাপাশি সরতাজের সঙ্গে কিছু সৌজন্যমূলক কথাবার্তাও হয়েছে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের। বিষয়টি নিয়ে পাক সংবাদমাধ্যম যে ভাবে মাতামাতি করছে, তাতেও স্পষ্ট ভারতের সঙ্গে যে কোনও আলোচনা কতটা গুরুত্ব পাচ্ছে ও-পারে। ভারত কিন্তু একে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা বলতে নারাজ। বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র বিকাশ স্বরূপ বলেছেন, ‘‘দু’দেশের মধ্যে কোনও দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়নি গত কাল।’’ আজিজ অমৃতসরে স্বর্ণমন্দিরে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করলেও নিরাপত্তার কারণে তার ব্যবস্থা করা যায়নি। এমনকী, সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে তিনি কথা বলতে চাইলেও দেওয়া হয়নি সেই অনুমতি। সার্ক সম্মেলন উপলক্ষে পাকিস্তানে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এটাকে তার পাল্টা বলতে অবশ্য রাজি নন কূটনীতিকরা।

এটা স্পষ্ট যে, উরি হামলার পর থেকে পাকিস্তানে কূটনৈতিক ভাবে একঘরে করার যে চেষ্টা ভারত চালিয়ে যাচ্ছে, তাতে ঢিলে দেওয়া হচ্ছে না। চলতি ‘হার্ট অব এশিয়া’ সম্মেলনেও কাবুলকে পাশে নিয়ে সন্ত্রাস প্রসঙ্গে কড়া নিন্দায় সরব হয়েছে নয়াদিল্লি। তবে ভারত-পাকিস্তান, দু’টি দেশের কাছেই এটা স্পষ্ট যে, সীমান্তে যতই উত্তেজনা বাড়ুক, কিংবা সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের মতো সেনা অভিযান হোক, শেষ পর্যন্ত আলোচনার টেবিলেই ফিরতে হবে দু’টি দেশকে। পুরো দস্তুর যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া কোনও মতেই সম্ভব নয় পরমাণু শক্তিধর দু’টি রাষ্ট্রের পক্ষে। কিন্তু শীর্ষ স্তরে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা যখন বন্ধ, তখন ‘ট্র্যাক-টু’ আলোচনাই পরীক্ষিত পথ। অমৃতসরে ওই সম্মেলনে কয়েক জন প্রাক্তন বিদেশসচিব, রাষ্ট্রদূত এবং কূটনীতিককে এ কাজে লাগানো হয়েছে। যদিও বিদেশ মন্ত্রক জানে, পাকিস্তানের ক্ষমতার কেন্দ্র অনেকগুলি। তার একটি ভারতের কাছে ঘেঁষছে মনে করলেই বাকিরা রাজনৈতিক সদিচ্ছাকে পিছনে থেকে টেনে ধরে। ভেস্তে যায় আলোচনা।

এর আগেও দু’দেশের মধ্যে স্থির হওয়া বিদেশসচিব পর্যায়ের বৈঠক ভেস্তে গিয়েছিল, পাক কর্তারা হুরিয়ত নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করায়। মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সামগ্রিক আলোচনার যে চেষ্টা শুরু হয়েছিল, তা সেই যে ধাক্কা খায়, সেই জট এখনও ছাড়েনি। মুম্বই থেকে উরি— একের পর এক পাক হামলার তথ্য-নথি ইসলামাবাদকে দিয়ে দ্রুত পদক্ষেপ চেয়েছে নয়াদিল্লি। কোনও ফল হয়নি তাতেও। বরং সীমান্তে সংঘর্ষ, জঙ্গি অনুপ্রবেশের চেষ্টা বেড়েছে। নওয়াজ প্রশাসনকে তাই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, আলোচনার দরজা খুলতে এ বার অন্তত হাতেকলমে কিছু করে দেখাক তারা।

পাকিস্তানের পক্ষ থেকেও ‘ট্র্যাক-টু’-র মাধ্যমে এই বার্তাই দেওয়া হয়েছে যে, তারাও তাদের অবস্থান অনেকটাই নরম করেছে ভবিষ্যৎ আলোচনার স্বার্থে। সন্ত্রাস নিয়ে খোলাখুলি আলোচনায় বসতে পাকিস্তান আগে গররাজি থাকত। কিন্তু এখন অন্য সব বিষয়ের সঙ্গে সন্ত্রাস নিয়েও কথা বলতে তারা প্রস্তুত। ‘হার্ট অব এশিয়া’ সম্মেলনে সন্ত্রাস-বিরোধী প্রস্তাব পাশ হয়েছে ইসলামাবাদের উপস্থিতিতেই। পাক দূতাবাসের দাবি, ইসলামবাদ যে সন্ত্রাসের সমস্যা নিয়ে আলোচনায় প্রস্তুত, এটা তার প্রমাণ। যদিও সন্ত্রাস দমন নয়, মোদীর মন এখন ‘নোট-সন্ত্রাসের’ অভিযোগ খণ্ডনে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

India Pakistan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE