মোদী-শরিফের কাছাকাছি আসা নিয়ে কটাক্ষ কংগ্রেসের। ছবি: পিটিআই।
মনমোহন সিংহ পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনায় বসলেই সন্ত্রাসের প্রসঙ্গ তুলে কট্টর জাতীয়তাবাদী অবস্থান নিত বিজেপি। আজ মোদীর সঙ্গে পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের বৈঠক এবং তার পরে মোদীর পাকিস্তান সফরের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর কংগ্রেস সেই একই অবস্থান নিল। কংগ্রেসের অভিযোগ, সন্ত্রাসের প্রশ্নে পাকিস্তানের থেকে কোনও নির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি ছাড়াই মোদী দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় রাজি হয়ে গিয়েছেন। এত দিন সন্ত্রাসের প্রশ্নে পাকিস্তান সম্পর্কে যে কঠোর সুর ধরে রেখেছিল ভারত, সেই সুর অনেকটাই নরম করে ফেললেন মোদী।
কংগ্রেস জমানায় মনমোহন সিংহ বরাবরই পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার পক্ষেই সওয়াল করে গিয়েছেন। শর্ম-এল-শেখ থেকে শুরু করে সেই আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার নীতিতেই অটল থেকেছেন তিনি। কংগ্রেস কি তবে সেই নীতিরই বিরোধিতা করছে?
কংগ্রেস মুখপাত্র আনন্দ শর্মার বক্তব্য, ‘‘আমরাও আলোচনার পক্ষে। বিরোধী থাকার সময় বিজেপি যে মারমুখী অবস্থান নিত, তাতে কূটনৈতিক বোধের অভাব ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের প্রশ্নে মোদীর নীতি অসঙ্গতিতে ভরা। প্রথমে তিনি পাক প্রধানমন্ত্রীকে শপথ গ্রহণে ডাকলেন। তার পর বিদেশসচিব পর্যায়ের বৈঠক বাতিল করে দিলেন। তার পর আবার বিনা কারণে বিদেশসচিবকে ইসলামাবাদে পাঠালেন। ক’দিন আগেই বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ঘোষণা করেছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে কোনও আলোচনা হবে না। আর আজ প্রধানমন্ত্রী নিজেই আলোচনা শুরু করে দিচ্ছেন!’’
কংগ্রেসের বক্তব্য, এত দিন পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনার প্রাথমিক শর্ত ছিল সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ইসলামাবাদকে ব্যবস্থা নিতে হবে। সর্বোপরি ২৬/১১-র মুম্বই-হামলার ষড়যন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে পাকিস্তানকে। কিন্তু আজ শরিফের থেকে সে বিষয়ে কোনও নির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি ছাড়াই মোদী দ্বিপাক্ষিক আলোচনা শুরু করে দিয়েছেন। গত দু’দিনে নিয়ন্ত্রণ রেখায় পাকিস্তানের গুলিতে ভারতীয় জওয়ান নিহত হয়েছেন। মোদী জমানায় অগুনতি বার সংঘর্ষবিরতি লঙ্ঘন করেছে পাকিস্তান। সে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভারতে পরমাণু হামলারও হুমকি দিচ্ছেন। এ কথা উল্লেখ করে কংগ্রেসের আনন্দ শর্মা প্রশ্ন তোলেন, লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে যে মোদী নিয়মিত পাকিস্তানকে হুঁশিয়ারি দিতেন, তিনিই কেন এখন নরম অবস্থান নিচ্ছেন?
পাকিস্তান সম্পর্কে বরাবরই কট্টর অবস্থান নিয়ে চলা শিবসেনাও আজ মুখর হয়েছে মোদীর বিরুদ্ধে। শিবসেনা প্রধান উদ্ধব ঠাকরে প্রকাশ্যেই প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘আগের সরকার যা করছে, এখনও তা-ই চলছে। মোদীর যথেষ্ট সাহস আছে আমরা জানি, তিনি চাইলে পাকিস্তানকে শিক্ষা দিতে পারতেন। কিন্তু আমাদের সেনা জওয়ানরাই পাকিস্তানের হাতে নিহত হচ্ছেন।’’
লোকসভা ভোটের প্রচারে মোদী বারবার মনমোহন সরকারকে আক্রমণ করে বলতেন, তিনি ক্ষমতায় এলে পাকিস্তানের সঙ্গে কোনও আপস হবে না। কোনও সমঝোতা হবে না সন্ত্রাসের প্রশ্নে। অস্বস্তি তাই বিজেপির অন্দরমহলেও। দলের নেতাদেরও মোদীর আগের ও এখনকার অবস্থানকে মেলাতে সমস্যা হচ্ছে। যদিও মোদী-নওয়াজ বৈঠকের পরেই বিজেপির মুখপাত্র এম জে আকবর দিল্লিতে সাংবাদিক বৈঠক করে বলেন, ‘‘পাকিস্তান এই প্রথম বার সন্ত্রাস নিয়ে আমাদের অবস্থান মেনে নিয়েছে। পাকিস্তানও এখন বলছে, যে কোনও ধরনের সন্ত্রাসই গ্রহণযোগ্য নয়।’’
ঘরে-বাইরে সমালোচনার মুখে বিজেপির এ-ও দাবি, মোদী সরকার যে সমাধান খুঁজছে, সমস্যার জালে আটকে নেই— আজকের ঘোষণা তার প্রতিফলন। সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে সহমত তৈরি হয়েছে। তা আলোচনার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করবে। সীমান্তে শান্তি আসবে। আগামী বছর সার্ক সম্মেলনে যোগ দিতে মোদীর পাকিস্তান সফর দু’দেশের সম্পর্কে নতুন মাইলফলক হয়ে উঠতে পারে।
এই দাবিকেও ‘হাস্যকর’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। তাঁদের যুক্তি, যৌথ বিবৃতিতে কণ্ঠস্বরের নমুনার কথা বলে ভারত এটাই মেনে নিল যে, ২৬/১১-র ষড়যন্ত্রীদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ এত দিন দেওয়া হয়নি। অথচ পাঁচ বছর আগেই পাকিস্তানের হাতে সমস্ত তথ্যপ্রমাণ তুলে দেওয়া হয়েছে। সেই তথ্যপ্রমাণ তুলে দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জের কাছেও। তবু পাক-প্রশাসন এত দিন বলে এসেছে তথ্যপ্রমাণের অভাবে নাকি লকভিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে তাতেই সিলমোহর বসিয়েছেন মোদী। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও ডিজিএমও-র বৈঠককেও কোনও মাইলফলক বলতে রাজি নয় কংগ্রেস। যুক্তি, এই পর্যায়ে এমনিতেই কথা হতো। তার জন্য যৌথ বিবৃতির দরকার ছিল না।
গত কয়েক বার বিদেশ সফরে গিয়েও ঘরোয়া রাজনীতির প্রসঙ্গ টেনে কংগ্রেস ও তার বিগত জমানাকে বিঁধেছেন প্রধানমন্ত্রী। তা-ই নিয়ে মোদীর কম সমালোচনা করেনি কংগ্রেস। এ বারের সফরে এখন পর্যন্ত তেমনটি করেননি মোদী। এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলেও কংগ্রেস মুখপাত্র কটাক্ষ করে বলেন, তা করেননি বটে। আবার নিজের মন্ত্রিসভার সদস্যদের বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ উঠেছে, সে প্রসঙ্গেও মুখ খোলেননি তিনি। অর্থাৎ এটা বেশ স্পষ্ট, মোদীকে আক্রমণের কোনও সুযোগই আর হাতছাড়া করতে রাজি নয় কংগ্রেস। প্রধানমন্ত্রী বিদেশ সফরে থাকলে তাঁর সমালোচনা না করার রাজনৈতিক সৌজন্য বা রীতিতেও আর আস্থা রাখছে না কংগ্রেস।
মোদীর সঙ্গে বৈঠকের পরেই পাক ঘরোয়া রাজনীতিতে কার্যত একই হাল শরিফেরও। সে দেশেও পিপিপি-সহ বিরোধী দলগুলি ও সংবাদমাধ্যমের একাংশ এখন পাক প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনায় মুখর। তাদের বক্তব্য, শীর্ষ বৈঠকের পরে জারি যৌথ বিবৃতিতে কাশ্মীর প্রসঙ্গ না থাকাটা খুবই আশ্চর্ষের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy