দেশ জুড়ে এখন সব থেকে প্রার্থিত অতিথি মৌসুমি বায়ু। সেই অতিথি অর্থাৎ বর্ষার উপরে বঙ্গোপসাগরের সদ্যোজাত ঘূর্ণিঝড় কতটা প্রভাব ফেলতে পারে, তা নিয়ে আশঙ্কার অঙ্ক কষে চলেছেন আবহবিদেরা। কিন্তু হঠাৎ দারুণ চমক দিয়ে জন্মের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গের বুকে বর্ষার মেজাজ এনে দিল রোয়ানু নামের সেই ঘূর্ণিঝড়!
শত্রুর আলখাল্লায় এটা বন্ধুর কাজ, নাকি ওই ঘূর্ণিঝড় আসলে শত্রুই— তা নিয়ে আমজনতার সংশয়-বিভ্রান্তি থাকতে পারে। কিন্তু প্রমাদ গুনছে হাওয়া অফিস। তাদের আশঙ্কা, ধ্বংসের স্বাভাবিক শক্তি নিয়ে ঘূর্ণিঝড় যা ক্ষতি করার, তা তো করতেই পারে। তার উপরেও বর্ষার ঘাড়ে থাবা বসিয়ে রুখে দিতে পারে তার অগ্রগতি। তাই মেঘলা আকাশ, বিক্ষিপ্ত বৃষ্টি নিয়ে বর্ষার আমেজ ঘনিয়ে আনলেও ঘূর্ণিঝড়ের এই বন্ধুসুলভ ভূমিকাটা আসলে ছলনার আলখাল্লা। মৌসুমি বায়ুর দেরি করিয়ে দেওয়ার জন্য যতটা সম্ভব শত্রুতা সে করবেই করবে।
এই আশঙ্কা কেন?
আবহবিদদের অনেকেই বলছেন, বর্ষা সমাগমের ঠিক আগে অর্থাৎ প্রাক্-বর্ষার মরসুমে বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ বা ঘূর্ণিঝড় তৈরি হওয়াটা মোটেই ভাল নয়। কারণ, দেশে বর্ষাকে টেনে আনার জন্য আরবসাগর আর বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রা, বায়ুচাপ-সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক প্রবণতার মধ্যে ভারসাম্য প্রয়োজন হয়। কিন্তু এই ধরনের আকস্মিক নিম্নচাপ বা ঘূর্ণিঝড় সেই ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়। ফলে বর্ষার আগমন পিছিয়ে যেতে পারে। নষ্ট হয়ে যেতে পারে তার স্বাভাবিক ছন্দ। আর সেই ছন্দোভঙ্গের বিরূপ প্রভাব পড়বে দেশের কৃষিতে, সামগ্রিক আবহেও।
দিল্লির মৌসম ভবন সূত্রের খবর, কেরলে বর্ষা ঢোকার স্বাভাবিক নির্ঘণ্ট ১ জুন। কিন্তু বঙ্গোপসাগরের বিরূপ পরিস্থিতি আঁচ করেই এ বার ঘোষণা করা হয়েছে, কেরলে বর্ষার প্রবেশ এক সপ্তাহ পিছিয়ে যেতে পারে। এখন ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব সেই পরিবর্তিত নির্ঘণ্টও বজায় রাখতে দেবে কি না, সেটা ভাবাচ্ছে আবহবিদদের। স্বাভাবিক অবস্থায় মৌসুমি বায়ু নির্ঘণ্ট মেনে কেরলে পৌঁছে গেলে তার এক সপ্তাহের মধ্যে অর্থাৎ ৮ জুন নাগাদ বর্ষা চলে আসে বাংলায়। ঘূর্ণিঝড়ের বাগড়ায় মৌসুমি বায়ুর পরিবর্তিত নির্ঘণ্টও বিগড়ে গেলে বাংলায় পৌঁছতে আরও দেরি হবে বর্ষার।
কোথা থেকে এল এই রোয়ানু?
মৌসম ভবন জানায়, তামিলনাড়ু উপকূলের কাছে দানা বেঁধেছিল একটি সুগভীর নিম্নচাপ। বৃহস্পতিবার সকালে অন্ধ্রপ্রদেশ উপকূলের কাছে এসে তা ঘূর্ণিঝড়ের চেহারা নিয়েছে। তারই নাম দেওয়া হয়েছে রোয়ানু। মলদ্বীপের দেওয়া এই নামের অর্থ নারকেল ছোবড়ার দড়ি। আবহবিদেরা বলছেন, এই নিম্নচাপের প্রভাবেই তামিলনাড়ু থেকে পশ্চিমবঙ্গ— পূর্ব উপকূল জুড়ে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গের একাংশে এ দিন দফায় দফায় যে-বৃষ্টি হয়েছে, তাতেও রোয়ানুর হাত দেখছেন তাঁরা।
হাওয়া অফিসের পূর্বাভাস, রোয়ানু এ বার ক্রমশ উত্তর দিকে সরতে শুরু করবে। ফলে উপকূল এলাকায় বৃষ্টি ঝরাবে সে। তাই আজ, শুক্রবারেও কলকাতা-সহ উপকূল জেলাগুলিতে বৃষ্টির পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। ভারী বৃষ্টিও হতে পারে কোনও কোনও এলাকায়। সমুদ্র উত্তাল থাকায় মৎস্যজীবীদের মাছ ধরতে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। অন্ধ্রপ্রদেশ আর ওড়িশার উপকূল এলাকাতেও ভারী থেকে অতিভারী বৃ়ষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।
অনেক আবহবিদ বলছেন, তীব্র দহনে বিপর্যস্ত বাংলা এই বৃষ্টিতে স্বস্তি পাচ্ছে ঠিকই। কিন্তু এতে পুলকিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ, বর্ষার অগ্রগতি রুখে দিয়ে এই ঘূর্ণিঝড় বড় ক্ষতি করে দিতে পারে।
রোয়ানু এখন কোথায়?
উপগ্রহ-চিত্র বিশ্লেষণ করে আবহবিজ্ঞানীরা জানান, বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৫টায় অন্ধ্রপ্রদেশের কাকিনাড়া থেকে ১১০ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরে ছিল রোয়ানু। শক্তি বাড়ছে তার। আজ, শুক্রবার সকালের মধ্যেই প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের চেহারা নেবে সে। তার পরে উত্তর দিক বরাবর এগিয়ে কাল, শনিবার গভীর রাতে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম উপকূলে আছড়ে পড়ার কথা সেই প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের। আলিপুর আবহাওয়া দফতরের এক বিজ্ঞানী বলছেন, উপকূল ঘেঁষে এগোনোর ফলে স্থলভূমিতে প্রবল বৃষ্টি হবে এবং তাতে রোয়ানুর শক্তিক্ষয় হবে। ফলে চট্টগ্রামের কাছে পৌঁছনোর আগেই ফের প্রবল ঘূর্ণিঝড় থেকে ঘূর্ণিঝড়ের চেহারা নেবে রোয়ানু।
বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় দানা বাঁধার পর থেকেই আশঙ্কা ছড়িয়েছে এ রাজ্যের অনেক বাসিন্দার মনে। তাঁরা বলছেন, মুখ ঘুরিয়ে বাংলায় ঢুকে পড়বে না তো রোয়ানু?
মৌসম ভবনের ঘূর্ণিঝড় সতর্কতা বিভাগের এক বিজ্ঞানী জানান, আবহাওয়ার আচমকা পরিবর্তনে কখনও কখনও ঘূর্ণিঝড়়ের মুখ ঘুরে যেতেই পারে। তাই রোয়ানুর উপরে টানা নজরদারি চালাচ্ছেন তাঁরা। তবে বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত রোয়ানুর অভিমুখ ঘুরে যাওয়ার তেমন কোনও ইঙ্গিত মেলেনি।
সংবাদ সংস্থা জানাচ্ছে, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে অন্ধ্রের অনেক জায়গাতেই রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে উপকূল এলাকায় সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং বিদ্যুৎ পরিষেবায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীকে তৈরি থাকতে বলা হয়েছে। বিপর্যয় ঠেকাতে এই ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছে ওড়িশাও। দমকল, পুলিশ ও বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরকে প্রস্তুত রাখার সঙ্গে সঙ্গে সরকারি অফিসারদের ছুটি বাতিলের নির্দেশও দিয়েছেন ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক। অন্ধ্রপ্রদেশ আর ওড়িশার মৎস্যজীবীদেরও সাগরে যেতে দেওয়া হচ্ছে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy