Advertisement
০৮ মে ২০২৪

ফণীর দাপটে ক্ষয়ক্ষতি কত, হিসেব এখনও অমিল

পিছনে ঘর কার্যত গুঁড়িয়ে গিয়েছে। কোলের বাচ্চাকে নিয়ে কাশিহরিপুরে রাস্তার পাশেই বসে ছিলেন বনিতা রাউত। চোখে শূন্য দৃষ্টি। বাচ্চাটাও থম মেরে রয়েছে।

জীবন-যুদ্ধ: ঘূর্ণিঝড় ফণীর দাপটে ভেঙেছে আস্তানা। তারই মধ্যে চলছে রান্নার তোড়জোড়। শনিবার পুরীর সৈকতে, মৎস্যজীবীদের এক গ্রামে। এপি

জীবন-যুদ্ধ: ঘূর্ণিঝড় ফণীর দাপটে ভেঙেছে আস্তানা। তারই মধ্যে চলছে রান্নার তোড়জোড়। শনিবার পুরীর সৈকতে, মৎস্যজীবীদের এক গ্রামে। এপি

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়
পুরী শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০১৯ ০৩:২৭
Share: Save:

পিছনে ঘর কার্যত গুঁড়িয়ে গিয়েছে। কোলের বাচ্চাকে নিয়ে কাশিহরিপুরে রাস্তার পাশেই বসে ছিলেন বনিতা রাউত। চোখে শূন্য দৃষ্টি। বাচ্চাটাও থম মেরে রয়েছে। পিছনে ধংসস্তূপ হাতড়ে শেষ সম্বলটুকু খুঁজে চলেছেন বনিতার স্বামী মানস। একই অবস্থা বনিতার প্রতিবেশী প্রশান্তর পরিবারেরও। দিনমজুরের কাজ করে তিলে তিলে গড়ে তোলা সংসার ফের কী ভাবে দাঁড় করাবেন, ওঁরা জানেন না। বনিতা, প্রশান্তরা বললেন, ‘‘দুর্যোগের পর থেকে কেউ আসেনি। খাবারও জোটেনি।’’

প্রাণহানি ঠেকানো এবং মানুষকে আগাম সরিয়ে নিয়ে যেতে পেরে প্রশংসা কুড়োচ্ছে ওড়িশা প্রশাসন। বিপর্যয় মোকাবিলায় ওড়িশা নিজেদের সেরা বলে দাবিও করে। কিন্তু ঝড়ের পরের পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে এখনও পুরোপুরি গতি ‌আসেনি। শনিবার দুপুরেও তারা মৃত, আহতের সংখ্যা, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানাতে পারেনি। জেলাশাসকের দফতরে যোগাযোগ করলে জানানো হচ্ছে, ফোন, মোবাইলের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। তাই কোনও খবর নেই।

জেলা প্রশাসন না জানলেও জেলা সদর হাসপাতালে গেলে কিন্তু অনেক আহতকেই দেখা যাচ্ছে। তাদেরই এক জন, মাথায় গভীর ক্ষত নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি থাকা বাসুদেব সাহু। মাথা এবং ডান চোখে ব্যান্ডেজ জড়ানো অবস্থায় বললেন, ‘‘বলেছে, প্লাস্টিক সার্জারি হবে। কবে হবে জানি না।’’ উদ্ধারকাজের অংশীদার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মী জানালেন, তাঁরা জেলা হাসপাতালে অন্তত ২০০ জন আহতকে এনেছেন। এক মহিলা ও এক পুরুষকেও পাঁচিল চাপা অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছিল। হাসপাতালে আনতে আনতে তাঁরা মারা যান।

এ দিন সকাল থেকে চড়া রোদ উঠেছে পুরীতে। কিন্তু গোটা পুরী জেলায় দু’পা অন্তর ফণীর স্মৃতিচিহ্ন। জল নেই, দোকানপাট বেশির ভাগই তছনছ। ব্যাঙ্ক, এটিএম বন্ধ। মোবাইলের নেটওয়ার্ক অমিল। পুরী শহর ছাড়িয়ে কাশিহরিপুর, হরেকৃষ্ণপুর, মালতীপটপুর, সাক্ষীগোপাল ছড়িয়ে ভুবনেশ্বরের পথে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার কোনও যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই। ভেঙে দ হয়ে পড়ে রয়েছে বিশাল বিশাল মোবাইলের টাওয়ার। গাছের মাথায় আটকে রয়েছে টিনের চাল। রাস্তার দু’ধারের সারি দেওয়া নারকেল গাছগুলিকে দেখলে মনে হয়, কেউ যেন সব ক’টার ঘাড় মটকে দিয়েছে!

হাহাকার চলছে জ্বালানি নিয়েও। পুরীর ভিতরে তো বটেই, পুরী-ভুবনেশ্বর বাইপাসের দু’ধারে সব তেলের পাম্প বন্ধ। এই সুযোগে শুরু হয়েছে কালো কারবার। জ্বালানি সংগ্রহ করতে পুরীর চক্রতীর্থ রোডে এমনই একটি দোকানের বিশাল লাইন চোখে পড়ল। প্লাস্টিকের বোতল, জারিকেন নিয়ে সেখান থেকেই জ্বালানি কিনছেন মানুষজন।

পুরীর মেরিন ড্রাইভের সামনে হোটেলগুলিও লন্ডভন্ড। এদিন দুপুরেও সৈকতের সামনের রাস্তায় কয়েক হাত পুরু বালি। সৈকতে অবশ্য বালি কম, বোল্ডার বেরিয়ে পড়েছে। মন্দিরে যাওয়ার রাস্তাতেও দোকানপাট সব ভেঙেচুরে রয়েছে। আদালত, জেলাশাসকের বাংলো, রাজভবন চত্বরে বিরাট বিরাট গাছ উপড়ে পড়েছে। গাছ পড়ে, গেট ভেঙে বন্ধ জেলা হাসপাতালের মূল ফটক।

আকাল শুরু হয়েছে জলেরও। বিদ্যুৎ নেই, তাই পাম্প চলছে না। গোটা জেলার বেশির ভাগ জায়গায় বিদ্যুতের খুঁটি, ট্রান্সফর্মার উল্টে পড়ে আছে। এই পরিস্থিতিতে বিভিন্ন মহল্লায় যে কয়েকটা হাতেগোনা নলকূপ আছে সেগুলির সামনে বিরাট লাইন। পেশায় অটোচালক মদনমোহন লেংকা বললেন, ‘‘বাড়িতে সামান্য জল আছে। সকাল সকাল নলকূপ থেকে কয়েক বালতি জল ভরে বাড়িতে রেখেছি। পুরসভার জলের ট্যাঙ্কার তো আসেনি।" জলকষ্টে ভুগছে হোটেলগুলিও। ঝড়ের দাপটে বহু হোটেলের পাইপ ভেঙে গিয়েছে। জেনারেটর দিয়ে পাম্প চালালেও লাভ হচ্ছে না। একটি হোটেলের ম্যানেজার জয়দীপ মিশ্রের কথায়,‘‘কলের মিস্ত্রিকে খবর পাঠাবো কী করে! মোবাইল কাজ করছে না। এক জনকে ওর বাড়িতে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু রাস্তা বন্ধ!’’ ঘূর্ণিঝড় আসার কথা শুনেই পর্যটকদের বিদায় করেছিল প্রশাসন। কিন্তু তা সত্ত্বেও যে সব পর্যটক ফিরতে পারেননি, তাদের নিয়েই সমস্যায় পড়েছেন হোটেল মালিকেরা।

পর্যটকদের অনেকেই বলছেন, তাঁরা ফিরতে চান। কিন্তু ট্রেন বন্ধ। বাস চলাচলও শুরু হয়নি। বছর চারেক আগে জগন্নাথদেবের নবকলেবরের সময় মালতীপটপুরে বিরাট বাস টার্মিনাস তৈরি করেছিল ওড়িশা সরকার। ফণীর ছোবলে সেই বাস গুমটির দফারফা। পুরী থেকে ভুবনেশ্বর যাওয়ার রাস্তার দু’ধারেও ছোট ছোট গুমটি দোকান, ধাবা ভেঙেচুরে গিয়েছে। কেউ কেউ সেই ভাঙা দোকানের থেকেই জিনিসপত্র বের করে রাস্তার পাশে টেবিল পেতে পসরা সাজিয়েছেন। মওকা বুঝে বেশি দামও নিচ্ছেন। রাস্তা থেকে গ্রামে ঢোকার রাস্তা অবশ্য এদিন বিকেলেও বন্ধ ছিল। ভেঙে পড়া গাছ, ধ্বংসস্তূপের আড়ালে নজরে এসেছে ত্রাণের আকুতি নিয়ে চেয়ে থাকা মুখ।

ঘুরে দাঁড়ানোর কাজও শুরু

হয়েছে একটু একটু করে। কোথাও গাছ কাটতে দেখা গিয়েছে বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর কর্মীদের, দুপুরে সৈকতের উপর দিয়ে পাক খেয়েছে নৌবাহিনীর কপ্টার। হোটেলে সাফাইয়ের কাজ শুরু করেছেন কর্মীরা। ঝড়ে উড়ে আসা বালি এবং বৃষ্টির কাদা পরিষ্কার করা হয়েছে। এক-একটি হোটেল থেকে এক-এক ঢিপি বালি সরানো হয়েছে। হোটেলের কর্মীরা বলছিলেন, যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। ফের নতুন করে তো তৈরি করতে হবে। ব্যবসা তো থেমে থাকবে না! পুরীর মাছ বাজারে জলখাবারের দোকানি রাজেশ দাসেরও একই কথা। ‘‘পর্যটক না এলে পুরী বাঁচবে না। পর্যটকেরা যাতে আসেন, তাই পুরীকে ফের সাজাতে হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Cyclone Fani ফণী
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE