করিমগঞ্জের তেঘড়ি এলাকায় বাঁধ ভেঙে জল ঢুকেছে বিভিন্ন গ্রামে। রবিবার শীর্ষেন্দু সী-র তোলা ছবি।
কোথাও ধস, কোথাও হড়পা বান, কোথাও আবার বাঁধ ভাঙা নদী। প্রাক বর্ষার প্রাকৃতিক বিপর্যতে বিপর্যস্ত উজানি অসম ও বরাক উপত্যকা। বর্ষার আগেই, অসমে বন্যা কবলিতের সংখ্যা ৪৩ হাজার হয়েছে।
গত কাল কাছাড় জেলার জাটিঙ্গামুখের পাথর খাদানে অন্য দিনের মতোই পাথর ভাঙার কাজ চলছিল। আচমকা পাহাড়ি সরু নদী জাটিঙ্গায় হড়পা বান আসে। জলের স্রোত দেখে বাকি শ্রমিকরা কোনওমতে তীরে উঠে পড়লেও ৯ জন শ্রমিক নদীর মাঝখানে উঁচু পাথরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখান থেকে এক জনকে উদ্ধার করা গেলেও, ৮ জন জলের তোড়ে ভেসে যান। জেলার এসপি রজবীর সিংহ জানান, শ্রমিকদের পাথরে আটকে থাকার খবর পেয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জগদীশ দাস ঘটনাস্থলে রওনা হন। কিন্তু রাস্তায় ধস সরিয়ে পৌঁছতে অনেক দেরি হয়। ততক্ষণে স্রোত শ্রমিকদের ভাসিয়ে নেয়। অবশ্য পুলিশের দাবি হড়পা বানে পাঁচ জন নিখোঁজ হয়েছেন। তিনসুকিয়ায় গাড়ির উপর দাছ পড়ে তিন জন মারা গিয়েছেন।
ডিমা হাসাও জেলার শিলচর-হাফলং রোডে রেডজল ও রেকো এলাকার মধ্যে আজ ধস নেমে। সেই সঙ্গে নেমে আসে হড়পা বান। তার ধাক্কায় ওই রাস্তা দিয়ে যাওয়া একটি ট্রাক ভেসে যায়। ঘটনাস্থলে এক জনের দেহ উদ্ধার হয়েছে। ট্রাকে থাকা অন্য জন ভেসে গিয়েছেন। তাঁর খোঁজে সেনাবাহিনী তল্লাশি চালাচ্ছে। মৃতের দেহ হাফলং হাসপাতালে আনা হয়েছে। ইস্ট-ওয়েস্ট করিডরের হাফলং-লামডিং অংশের তিনটি জায়গায় ধস নেমেছে। এর মধ্যে এনলাইকুলের রাস্তায় প্রচুর পাথর এসে পড়ায় যাতায়াত বন্ধ। ফলে লামডিং থেকে হাফলং পর্যন্ত ট্রেন ও সড়ক দুই পথেই যোগাযোগ থমকে। গুয়াহাটি থেকে হাফলং যাওয়ার পূর্ত সড়কের দু’টি জায়গায় ধস নেমেছে। তা অবশ্য পরিষ্কার করা হয়েছে। হাফলং শহরেরও ২০-২৫টি জায়গায় ছোট-বড় ধস নামে। তাই হাফলংয়ের ভিতরেও যাতায়াত ব্যহত। তা সাফ করতে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজ করছে পূর্ত বিভাগ। মুখ্যসচিব ভি কে পিপারসেনিয়া জেলাশাসক অমরেন্দ্র বরুয়ার সঙ্গে কথা বলে জানিয়েছেন, রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর একটি দলকে শিলচর থেকে হাফলং পাঠানো হয়েছে। উধারবন্দে গত কাল সন্ধে থেকে মধুরা নদীর জল বেড়ে বিভিন্ন অংশ প্লাবিত হয়। বিমানবন্দরগামী ভিআইপি সড়কও জলমগ্ন। জাটিঙ্গা, মধুরা নদীতে জল বাড়ায় বরাক নদীরও জলস্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে তা এখনও বিপদসীমা ছোঁয়নি। করিমগঞ্জে লঙ্গাই নদীর তেঘড়ি এলাকা দিয়ে জল ঢুকছে। গত বছর বন্যায় ওই বাঁধে ফাটল ধরেছিল। অভিযোগ, এক বছরেও ফাটল সারাতে কোনও কাজ করেনি জলসম্পদ বিভাগ। এ বার সেখান দিয়ে জল ঢুকে চেংজুরিপার, আন্ধেরিগ্রাম, শহিদখানি, কাকরিপাড় পুরো ডুবে গিয়েছে। সেখানে যাতায়াতের অন্য কোনও উপায় নেই। নৌকারও ব্যবস্থা হয়নি। তাই বাসিন্দারা সকলে জলবন্দি। জেলাশাসক মনোজকুমার ডেকা বাঁধের ভাঙা অংশ পরিদর্শনে যান। গ্রাম পঞ্চায়েত সভাপতি উজ্জ্বল মালাকার অভিযোগ করেন, এক বছর ধরে কোনও কাজ না হওয়ার ফলেই এত জন গৃহহীন হয়ে পড়লেন। বিধায়ক তথা মন্ত্রী সিদ্দেক আহমেদের অভিযোগ,এনরেগার আওতায় বাঁধ সারানোর কাজ করাতে বলেছিলেন তিনি। কিন্তু নির্বাচন আছে বলে জেলাশাসক কাজ করাতে দেননি। মুখ্য সচিব এ দিন বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে জেলাশাসককে ফোন করেন।
রাজ্য সরকারের হিসেবে এখন পর্যন্ত রাজ্যের প্রায় ৪৩ হাজার মানুষ বন্যা কবলিত। বন্যার প্রকোপ বেশি লখিমপুর, যোরহাট, শিবসাগর এবং চড়াইদেও জেলায়। বুড়িদিহিং ও দিসাং নদী বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে। দিখৌ, রঙানদী, জিয়াঢল, জিয়াভরালিও ফুঁসছে। ত্রাণ ও উদ্ধার অভিযানে নেমেছে সেনাবাহিনী, জাতীয় ও রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী। আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, ২৫ এপ্রিল থেকে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। টানা বৃষ্টিতে জল জমে রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কাজিরাঙায় নির্দিষ্ট সময়ের আগেই জিপ সাফারি বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বন দফতর। সাধারণত ১ মে থেকে সাফারি বন্ধ হয়।
কয়েক দিনের টাকা বর্ষণে বন্যার পাশাপাশি ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়ে চা চাষের ক্ষেত্রে। ভারতীয় চা অ্যাসোসিয়েশনের মতে, অকালে এত বৃষ্টি এবং কম তাপমাত্রা থাকায় ‘সেকেন্ড ফ্লাশ’ চায়ের উৎপাদন ও গুণমান কমবে। এই সময়েই অসমের সেরা চা তৈরি হয়। কড়া লিকার ও রংয়ের জন্য সেকেন্ড ফ্লাশ বিশ্বখ্যাত। কিন্তু এ বার সেই চায়ের উপরেই প্রকৃতির আঘাত নামায় চিন্তিত ছোট-বড় চা সংস্থাগুলি। সব চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে শিবসাগর জেলায়। টোকলাই চা গবেষণাকেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা জানান, এমন বৃষ্টি আরও কয়েক দিন চললে চা গাছের বৃদ্ধি থেমে যাবে।
অন্য দিকে, তাওয়াং জেলার লুমলায় ধসে গত কাল মারা যাওয়া বৃদ্ধ দম্পতির সৎকার করা হয়। ওই ঘটনায় জখম হয়ে পাঁচ জন হাসপাতালে ভর্তি। তাওয়াংয়ের বিধায়ক সেরিং তাসি, লুমলার বিধায়ক তথা পরিষদীয় সচিব জাম্বে তাসি, সেনাবাহিনী ও ডিসি কামডুক ডুলি গত কাল বিকেলে পরিস্থিতি নিয়ে জরুরি বৈঠকে মিলিত হন। তাওয়াংয়ের স্কুলগুলিতে ত্রাণশিবির খোলা হয়েছে। ধস নেমে ইটানগর-নাহারলাগুনে জল সরবরাহ ব্যহত হচ্ছে। নোয়া ডিহিং নদীর বন্যায় ডিয়ুনের ডুম্পানি-উদয়পুরে ২০০টি চাকমা পরিবার গৃহহীন হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy