উত্তর-পূর্ব ভারতের এক বিস্তীর্ণ এলাকার অধিবাসীদের আয়কর ও সম্পত্তিকর দিতে হয় না। যে কোনও অঙ্কের টাকা তাঁরা নিজেদের অ্যাকাউন্টে জমা করতে পারেন। তার জন্য কোনও আয়কর নেই। যাঁরা কালো টাকা নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বসে ছিলেন, ৮ নভেম্বরের পরে তাঁদের অনেকেই এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়েছেন বলে সন্দেহ করছে আয়কর দফতর।
অফিসারদের সন্দেহ, এই তালিকায় পশ্চিমবঙ্গের লোকেরাও আছেন। বাতিল ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট এই রাজ্য থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতে পাঠিয়ে সেখানকার অধিবাসীদের ব্যাঙ্কে জমা করা হয়েছে। যাঁরা এ ভাবে টাকা পাঠিয়েছিলেন তাঁদের ধারণা ছিল, উত্তর-পূর্বের বাসিন্দাদের অ্যাকাউন্টে কত টাকা পড়ল, তা নিয়ে মাথা ঘামাবে না আয়কর দফতর।
এখন পরিস্থিতি বদলেছে। আয়কর দফতরের ডিজি (তদন্ত) এ শঙ্কর বৃহস্পতিবার বলেন, ‘‘উত্তর-পূর্ব ভারতের যে সব ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট এ ভাবে মানি লন্ডারিং (কালো টাকা পাচার)-এ ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলির উপরে নজর রাখা হচ্ছে।’’
যদিও গোয়েন্দা সূত্রের বক্তব্য, এই নজরদারির মধ্যেও পুরনো নোটের লেনদেন হচ্ছে। উত্তর-পূর্বের রাজ্য থেকেই পশ্চিমবঙ্গের অনেক ব্যবসায়ীর কাছে কালো টাকা সাদা করার প্রস্তাব আসছে। শর্ত হল, ৩০ নভেম্বরের মধ্যে সড়কপথে পৌঁছে দিতে হবে টাকা। বিমানবন্দর সূত্রের খবর, কলকাতা থেকে সপ্তাহখানেক আগে এক যাত্রী আড়াই কোটি টাকা নিয়ে গুয়াহাটি গিয়েছিলেন। সেই তথ্য আয়কর দফতরের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার পর থেকে বিমানবন্দর থেকে বড় অঙ্কের টাকা নিয়ে উত্তর-পূর্বে কেউ উড়ে যাননি।
গোয়েন্দাদের সন্দেহ, উত্তর-পূর্ব থেকে যাঁরা টাকা সাদা করার প্রস্তাব পাঠাচ্ছেন, তাঁরাই এখানকার ব্যবসায়ীদের সতর্ক করে দিচ্ছেন যাতে বিমানে টাকা পাঠানো না হয়। এমনকী ট্রেনে করেও টাকা না নিয়ে গিয়ে সড়কপথে মালবাহী লরির মধ্যে লুকিয়ে টাকা পাঠানোর কথা বলা হচ্ছে। এখান থেকে গুয়াহাটি পর্যন্ত ওই টাকা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব কালো টাকার মালিকের। তার পরের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য সেখানে লোক বসে রয়েছে। বলা হচ্ছে, এখন যে পরিমাণ টাকা উত্তর-পূর্বে পাঠানো হবে, তার ৮০% টাকা ফেরত পাওয়া যাবে দিন সাতেক পরে একেবারে কড়কড়ে নতুন নোটে। তবে ওই টাকা বেশিদিন ফেলে রাখলে ৯০% পর্যন্ত ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। বিশেষত, বুধবার ডিমাপুর থেকে সাড়ে তিন কোটি টাকা নিয়ে চার্টার্ড বিমানে দিল্লি গিয়ে দুই ব্যক্তি আটক হওয়ার পরে এবং তাঁদের জেরা করে একটি পেট্রোল পাম্প থেকে সেই টাকা উদ্ধার হওয়ার পরে সন্দেহ আরও চেপে বসেছে আয়কর কর্তাদের মনে।
উত্তর-পূর্বে আয়কর দফতরের মুখপাত্র এস কর জানিয়েছেন, আয়কর আইনের ১০ (২৬) ধারা এবং সংবিধানের ৩৬৬ ধারা তথা ষষ্ঠ তফসিলে উল্লেখ অনুযায়ী, অরুণাচল প্রদেশ, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা, সিকিম, লাদাখ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য এলাকার উপজাতি, খাসি-গারো-জয়ন্তীয়া হিলের উপজাতিরা আয়কর ও সম্পত্তিকর থেকে ছাড় পান। তাঁরা নিজেদের অ্যাকাউন্টে যত খুশি টাকা জমা করতে পারেন। তবে আয়কর অফিসারদের দাবি, উত্তর-পূর্বের মানুষ যতই ছাড় পান, কারও অ্যাকাউন্টে স্বাভাবিকের থেকে অনেক বেশি টাকা জমা পড়লে আয়কর দফতরের তদন্ত শাখা ওই ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই পারে। অসমের ডিমা হাসাও, কার্বি আংলং, বড়োল্যান্ড, মেঘালয়ের খাসি হিল, গারো হিল ও জয়ন্তীয়া হিল, গোটা অরুণাচল, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ডের উপজাতিভুক্তদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে আচমকা মোটা টাকার লেনদেন হলেই ব্যাঙ্ক ও আয়কর দফতরকে সতর্ক হতে বলা হয়েছে।
এ শঙ্কর বলেন, ‘‘এই সব অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে যাঁরা অন্যায্য সুবিধা নিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আয়কর দফতর কড়া ব্যবস্থা নেবে।’’ যাঁদের অ্যাকাউন্টগুলি কালো টাকা সাদা করার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে, তাঁরা সামান্য টাকার ‘লোভে’ এই কাজ করছেন বলে আয়কর অফিসারদের মত। ফলে অধিবাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে না বলেও জানানো হয়েছে। আয়কর দফতরের দাবি, মূল ভূখণ্ড থেকে বিভিন্ন উপায়ে উত্তর-পূর্বে টাকা ঢোকার আশঙ্কায় কড়া নজর রাখা হচ্ছে বিমানবন্দর, স্টেশন ও সড়ক সীমানা পোস্টগুলিতে। তবে, দেশের অন্যান্য প্রান্ত শুধু নয়, উত্তর-পূর্বেরই বহু বড় ব্যবসায়ী-নেতারাও নিজেদের কালো টাকা লুকোতে তা সাধারণ মানুষের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা করতে পারেন বলেও আশঙ্কা রয়েছে আয়কর দফতরের। এমনকী উত্তর-পূর্বের জঙ্গিগোষ্ঠীর হাতে যে বিশাল অঙ্কের টাকা রয়ে গিয়েছে, সেই টাকা নতুন নোটে বদলে নেওয়ার জন্য তারা উপজাতি অ্যাকাউন্টগুলি ব্যবহার করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy