Advertisement
E-Paper

ভেসে গিয়েছে সব, রয়েছে শুধু প্রাণটুকু

এখন আর জমে নেই বন্যার জল। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে ভূস্বর্গের জনজীবন। খুলছে দোকানপাট। মানুষের হাসি মুখগুলো দেখতে পাচ্ছি আবার। বেশ কিছু দিন ধরে যেগুলো এক্কেবারেই দেখতে পাইনি। কিন্তু তা-ও যেন কিছুতেই ভুলতে পারছি না ৬ সেপ্টেম্বরের সেই রাতের কথা। ৬ সেপ্টেম্বর তখন সন্ধে সাড়ে সাতটা হবে। শ্রীনগরে নামে মুষলধারে বৃষ্টি। রাজবাগে ঝিলম নদী থেকে আমার বাড়ি বেশি দূরে নয়।

সাবির ইবন ইউসুফ

শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০১:২৩
বন্যায় ভেঙে পড়া বাড়ির ধ্বংসাবশেষ পরিষ্কার করা হচ্ছে। শনিবার অনন্তনাগে।  ছবি: পিটিআই

বন্যায় ভেঙে পড়া বাড়ির ধ্বংসাবশেষ পরিষ্কার করা হচ্ছে। শনিবার অনন্তনাগে। ছবি: পিটিআই

এখন আর জমে নেই বন্যার জল। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে ভূস্বর্গের জনজীবন। খুলছে দোকানপাট। মানুষের হাসি মুখগুলো দেখতে পাচ্ছি আবার। বেশ কিছু দিন ধরে যেগুলো এক্কেবারেই দেখতে পাইনি। কিন্তু তা-ও যেন কিছুতেই ভুলতে পারছি না ৬ সেপ্টেম্বরের সেই রাতের কথা।

৬ সেপ্টেম্বর তখন সন্ধে সাড়ে সাতটা হবে। শ্রীনগরে নামে মুষলধারে বৃষ্টি। রাজবাগে ঝিলম নদী থেকে আমার বাড়ি বেশি দূরে নয়। ২০০ গজের মধ্যে। শুনেছি, বন্যার সময় এক তলা সমান জল জমেছিল ওখানে।

আড়াই বছরের ছেলে মুসা, আর স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি ছাড়তে হয়েছিল ৭ তারিখ বিকেলেই। সাত-আট দিন পরে যখন জল কমে তখন বাড়ির কাছে গিয়ে কিছুই চিনতে পারছিলাম না। বন্যার জলে বাড়ি ও তার সংলগ্ন এলাকা ধুয়ে মুছে সাফ। সব দেখে আমার স্ত্রী কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। কাঁদতে কাঁদতে ধন্যবাদ জানাচ্ছিল আল্লাকে, আমাদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য।

গত ৪ সেপ্টেম্বর রাত থেকেই দক্ষিণ শ্রীনগরের মানুষ আকাশ-ভাঙা বৃষ্টির সাক্ষী থাকেন। তার পর দিন, অর্থাৎ ৫ সেপ্টেম্বর, শুক্রবার সন্ধেয় রাজ্য সরকারের তরফে জারি করা হয় বন্যা সতর্কতা। শনিবার সকালে আমার কথা হচ্ছিল প্রতিবেশী ছেলের সঙ্গে। ওর সঙ্গে কথা বলতে বলতেই শুনলাম, ঝিলমের জল তখনই নাকি বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে। অবশ্য সে দিন সকাল থেকেই মাইকে সরকারের লোকেরা ঘোষণা করেছিলেন রাজবাগ এবং জওহিরনগরের বাসিন্দারা সবাই যেন সময় থাকতে থাকতেই নিরাপদ জায়গায় উঠে যান।

তাই আমি দেরি না করে পরিস্থিতি জানতে দক্ষিণ শ্রীনগরের পুলিশ সুপার ইমতিয়াজ ইসমাইল প্যারিকে ফোন করি। ওঁর সঙ্গে কথা বলেই বুঝেছিলাম, পরিস্থিতি সত্যিই খারাপ। ছেলে ও স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। সম্বল পকেটে মাত্র কিছু টাকা। কিন্তু মন চাইছিল না বাড়ি ছেড়ে বেরোতে। কিন্তু আমাদের বেরোতেই হতো। তাই বেরোলাম। তার আধ ঘণ্টার মধ্যেই আমার মোবাইলে একটি ফোন আসে। তখনই খবর পাই ঝিলমের জলে ভেসে গিয়েছে রাজবাগ। আমরা ঠিক সময়েই বাড়ি ছেড়েছিলাম।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমি প্রথমে গিয়েছিলাম লাল চকের দিকে। ওখান থেকে পারিমপোরার দিকে যাওয়ার কথা ছিল আমাদের। কিন্তু তখন বন্যার জল ঢুকছে চার দিক থেকে। জম্মু ও কাশ্মীর কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়েছিল গোটা দেশ থেকে। তাই আমরা উঠে যাই জাবারওয়ান পর্বতের পাদদেশে। ওখানে তখন মোবাইলে আর নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে না। তাই আর কিছু উপায় না পেয়ে ওই জাবারওয়ান পর্বতের পাদদেশের ত্রাণশিবিরেই আশ্রয় নিয়েছিলাম।

সেখানে হঠাৎই দেখা হয় আমার এক বন্ধুর সঙ্গে। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার ওই বন্ধু আমাকে এবং আমার পরিবারকে নিয়ে যান নিজের মেস বাড়িতে। কিন্তু ওখানে আগে থেকেই এত লোক ছিল যে আমাদের পক্ষে সেখানে থাকা সম্ভব ছিল না। তাই আমি মুসা ও স্ত্রীকে নিয়ে ত্রাণশিবিরেই আশ্রয় নিই।

মনে আছে, খুব কষ্টে সে দিন ছ’বোতল জল আর আট প্যাকেট বিস্কুট আর ক’টা কেক জোগাড় করেছিলাম। মুসা চাইছিল না এই ভাবে থাকতে। ওর কষ্ট আমি বুঝেছিলাম। আমার স্ত্রী তখন মুসাকে বুঝিয়েছিল, “এই পরিস্থিতিতেও আমরা এক সঙ্গে আছি। এবং সুস্থ আছি। আল্লার আশীর্বাদ। উনি না থাকলে এটা সম্ভব হত না।”

তিন দিন পর জল কিছুটা নামলে ট্রাক্টরে মুসা ও স্ত্রীকে নিয়ে আমি চলে আসি বারজুলায়। সেখানে আমাদের এক আত্মীয়ের বাড়ি আছে। তখনও টেলি-যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হয়নি। সারা দিন দেখতাম কী ভাবে দিন রাত এক করে সেনা কাজ করছে। হেলিকপ্টারে উদ্ধারকাজ চলছে। আর ওই ক’দিনে এত মৃত্যুর খবর শুনেছি যে মানসিক ভাবে খুব ভেঙে পড়েছিলাম। তখন ২০০৫ সালের অক্টোবর মাসের ভূমিকম্পের কথা খুব মনে পড়ত।

কিন্তু এত কিছুর পরও আমরা সবাই একসঙ্গে আছি, এটা মনে করে আমার স্ত্রী খুশি। তাই গত কাল থেকেই সব ভুলে আমি আবার কাজে ফিরেছি। তার জন্য আমাকে আট কিলোমিটার দূরে বিমানবন্দর এলাকায় আসতে হচ্ছে। কারণ, রাজ্যে শুধুমাত্র ওখান থেকেই ইন্টারনেটে কাজ করা যাচ্ছে। মনে আশা, কিছু দিনের মধ্যে হয়তো পুরনো দিনগুলি ফিরে পাব। যেগুলো হারিয়েছি বন্যায়।

flood kashmir srinagar
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy