Advertisement
০৪ মে ২০২৪

জনসমুদ্রে ভেসে বিজেপিতে হিমন্ত, আক্রমণ রাহুলকে

‘বিশ্ব-রূপ’ দেখে সন্ত্রস্ত কংগ্রেস। দলের অন্দরমহলের খবর, মুখে স্বীকার না করলেও মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ ইতিমধ্যেই সনিয়া গাঁধীকে জানিয়ে দিয়েছেন, রাজ্যের আরও অম্তত ৪-৫ জন বিধায়ক বিজেপিতে যোগ দিতে পারেন!

জন সমুদ্রে। বিজেপি দফতরে যাওয়ার পথে হিমন্তবিশ্ব শর্মা। শুক্রবার গুয়াহাটিতে। ছবি: উজ্জ্বল দেব।

জন সমুদ্রে। বিজেপি দফতরে যাওয়ার পথে হিমন্তবিশ্ব শর্মা। শুক্রবার গুয়াহাটিতে। ছবি: উজ্জ্বল দেব।

রাজীবাক্ষ রক্ষিত
গুয়াহাটি শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০১৫ ০৩:১২
Share: Save:

‘বিশ্ব-রূপ’ দেখে সন্ত্রস্ত কংগ্রেস।

দলের অন্দরমহলের খবর, মুখে স্বীকার না করলেও মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ ইতিমধ্যেই সনিয়া গাঁধীকে জানিয়ে দিয়েছেন, রাজ্যের আরও অম্তত ৪-৫ জন বিধায়ক বিজেপিতে যোগ দিতে পারেন!

বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর রাহুল গাঁধীর দিকে তোপ দাগেন হিমন্ত। তিনি বলেন, ‘‘ওঁর একনায়কত্ব মনোভাব ও আম কংগ্রেস নেতাদের পাত্তা না দেওয়া, দলে পরিবারতন্ত্র চালানোর জন্যই কংগ্রেস ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’’

আজ সকাল থেকে গুয়াহাটি বিমানবন্দরে জনসমুদ্র এর আগে শেষ কবে দেখা গিয়েছে, তা কেউ মনে করতে পারছেন না। অসমের প্রাক্তন মন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মাকে কনভয়ে বিজেপি দফতরে নিয়ে যাওয়ার কথা আগেই জানানো হয়েছিল। সে জন্য সরকারি ভাবে অনুমতি ৩০০ গাড়ি ও ১ হাজার মোটরসাইকেলের অনুমতি মিলেছিল। কিন্তু এ দিন বিজেপি কর্মী-সমর্থক ও সাধারণ মানুষের গাড়ি মিলিয়ে সংখ্যাটি কার্যত দ্বিগুণ হয়ে যায়। খোলা জিপে ৪৫ মিনিটের পথ পেরতে হিমন্তের কনভয়ের সময় লাগে ৫ ঘণ্টা!

হিমন্ত-বিদায়ের ছবিকে ম্লান করতে কংগ্রেস দলের সদর দফতর রাজীব ভবনে ‘আনন্দ উল্লাস দিবস’ পালনের ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু, হিমন্ত-ম্যাজিকে সেই আয়োজন বর্ণহীন হয়ে পড়ে। দলের আশঙ্কা সত্যি করে, কংগ্রেসের ৭ জন বিধায়ক বিমানবন্দরে হিমন্তকে সংবর্ধনা জানান। এ দিন দিল্লি থেকে হিমন্তের সঙ্গেই আসেন তিন জন বিধায়ক। দল বাঁচাতে তাঁদেরও শো-কজ নোটিস ধরাতে চলেছে মরিয়া কংগ্রেস হাইকম্যান্ড।

এ দিন বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ বিজেপিতে আনুষ্ঠানিক ভাবে যোগ দিয়ে হিমন্ত বলেন, ‘‘স্বামী বিবেকানন্দের বই পড়ে ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে আমার অজ্ঞানতা কেটেছে। ক্ষমতার লোভ বা রাজনীতি নয়, মহাপুরুষদের বাণী আর ভারতীয়ত্বের ডাকেই তাই বিজেপিতে এলাম।’’ দলত্যাগের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর, এআইসিসির তরফে হিমন্তের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। হিমন্ত শিবিরের খবর, সনিয়া গাঁধীর আবেদন ফিরিয়ে রাজ্যের প্রাক্তন ওই মন্ত্রী জানিয়ে দেন— অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।

কংগ্রেস সূত্রে জানা গিয়েছে, চিন্তিত সনিয়া গত কাল সন্ধেয় গগৈয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে গগৈ মেনে নেন, হিমন্তর কংগ্রেস ত্যাগকে ক্ষতি বলে মনে করেন সনিয়া। তিনি সনিয়াকে আশ্বাস দিতে জানিয়েছেন, হিমন্ত দলত্যাগ কংগ্রেসের পক্ষে বড় ক্ষতির নয়। বরং দলে থেকেই বেশি ক্ষতি করছিলেন হিমন্ত। এর আগেও অনেকে দল ছেড়েছেন, তবু কংগ্রেস ভেঙে পড়েনি। আশঙ্কিত কংগ্রেস সভানেত্রী জানতে চান, হিমন্তর সঙ্গে আর কেউ দল ছাড়ছেন না তো? অসম কংগ্রেস সভাপতি অঞ্জন দত্ত যদিও দাবি করেন, অন্য বিধায়করা দল ছাড়বেন না। কিন্তু গগৈ জানিয়ে দেন, আরও অন্তত ৫ জন বিধায়ক দল ছাড়তে পারেন। হিমন্ত কংগ্রেস ছাড়ায় বরাক, হাফলং, কামরূপের কংগ্রেস নেতারা সদলবলে কংগ্রেস ছাড়ছেন।

এ দিন, দলের চোখরাঙানি কার্যত অগ্রাহ্য করে হিমন্তপন্থী কংগ্রেস বিধায়ক জয়ন্তমল্ল বরুয়া, বলিন চেতিয়া, প্রদান বরুয়া, আবু তাহের বেপারি, বিনন্দ শইকিয়ারা বিমানবন্দরে হাজির হন। প্রদান বলেন, ‘‘হিমন্তর সঙ্গেই রয়েছি। তাঁর দল ছাড়া কংগ্রেসের পক্ষে বড় ক্ষতি। দল ছাড়ার বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত নেব।’’ বিজেপি বিধায়ক প্রশান্ত ফুকন বলেন, ‘‘কংগ্রেসের অন্তত ১৬ জন বিধায়ক বিজেপিতে যোগ দিতে চলেছেন।’’

এ দিন সকাল ৮টা থেকে হাজার দশেকের ভিড় গরম অগ্রাহ্য করে নাচে-গানে মেতে ছিলেন। অনেকে উঠে পড়েন আশপাশের গাছের ডালেও! বিভিন্ন উপজাতির নৃত্যে বিমানবন্দর চত্বরে যেন কার্নিভালের মেজাজ। বেলা ১১টা নাগাদ এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানে দিল্লি থেকে আসেন হিমন্ত। বিমানবন্দরের দরজা থেকে গাড়ি পর্যন্ত এক মিনিটের রাস্তা পেরতে তাঁর ১০ মিনিট লাগে। ততক্ষণে ভিড়ের সংখ্যা ছুঁয়েছে বিশ হাজার। নাচ-গান-স্লোগানে মুখর বিমানবন্দর চত্বর থেকে হিমন্তকে নিয়ে বের হয় দেড় হাজার মোটরসাইকেল ও শ’তিনেক গাড়ির কনভয়। খোলা জিপে দাঁড়ানো, বুকে পদ্মফুল লাগানো স্থানীয় বিধায়কের দিকে কেউ তখন ছুঁড়ে দিচ্ছেন গামোছা, কেউ গাঁদার মালা। আজারা, ধারাপুর, জালুকবাড়ি, ভরলু, ফ্যান্সিবাজার, শিলপুখুরিতে জায়গায় জায়গায় তাঁকে সংবর্ধনা নিতে দাঁড়াতে হয়। ভিড় আর যানজটের চাপে বাতিল করতে হয় কামাখ্যা যাওয়ার পরিকল্পনা। ৫ ঘণ্টা পর কনভয় হেঙেরাবাড়িতে বিজেপি সদর দফতরে পৌঁছয়।

কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতা মহেন্দ্র সিংহ, অশোকানন্দ সিংঘল, প্রদেশ বিজেপি সভাপতি সিদ্ধার্থ ভট্টাচার্য, সাংসদ বিজয়া চক্রবর্তী, কামাখ্যা প্রসাদ তাসা মঞ্চে হিমন্তর পাশে থাকলেও, যে ব্যক্তির সঙ্গে হিমন্তের সংঘাত নিয়ে কংগ্রেস আঙুল তুলছে, সেই কেন্দ্রীয় ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল অবশ্য এ দিন সকালে ডিব্রুগড় থেকে গুয়াহাটি না এসে সোজা দিল্লি চলে যান। সর্বানন্দ জানান, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করার পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচী থাকার জন্যই গুয়াহাটি যেতে পারছেন না। হিমন্তকে দলে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আগামী বছর বিজেপির অসম জয়ে হিমন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে চলেছেন। বরাক থেকে ব্রহ্মপুত্রের মানুষ কংগ্রেসকে হঠাতে তৈরি।’’

হিমন্ত এ দিন বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর বলেন, ‘‘গোটা পথে মানুষ যে ভালবাসা দেখিয়েছেন, তা আসলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রতি জনতার সম্মান। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে সমস্যামুক্ত উন্নত অসমের স্বপ্ন দেখতাম। তিন বার বিধায়ক-মন্ত্রীও হলাম। কিন্তু স্বপ্নের অসম গড়া হল না।’’ হিমন্তের কথায়, ‘‘নরেন্দ্র মোদী লালকেল্লায় যুব শক্তিকে বড় স্বপ্ন দেখতে বললেন। আম আদমির ছেলেমেয়েকে নিয়ে স্বপ্নের ভারত গড়তে চাইলেন। বেদ, গীতা, স্বামী বিবেকানন্দের বই পড়ে মনের অন্ধকার কাটে। তরুণ গগৈয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে মুখ্যমন্ত্রী হতে দল ছাড়িনি। ভারতীয়ত্বের টানেই বিজেপিতে এসেছি।’’

এক সময় হিমন্তই বিজেপির বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন। তা নিয়ে হিমন্ত বলেন, ‘‘ভাগ্যের লিখন বলে কথা আছে। সেখানেই লেখা ছিল, ২৩ বছর কংগ্রেস করবো। বিজেপির বিরুদ্ধে কিছু মন্দ কথাও বলবো। তারপর বিজেপিতেই যোগ দেব। আশা করি পুরনো কথা ভুলে গিয়ে আপনারা আমাকে আপন করে নেবেন।’’ হিমন্তের দাবি, আসন্ন নির্বাচনে কংগ্রেস ১৫টি আসনও পাবে না। বিজেপি রাজ্যে নব দিগন্ত আনবে। বিজেপির বর্তমান রাজ্য নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর স্বার্থের সংঘাতের আশঙ্কা উড়িয়ে তিনি বলেন, ‘‘আজ থেকে আমি সিদ্ধার্থবাবুদের ছাত্র।’’

এ দিকে, হিমন্তর বিজেপি গমনকে ‘উদযাপন’ করতে এ দিন কংগ্রেস আনন্দ উল্লাস দিবস পালন করে। রাজীব ভবনে অঞ্জন দত্ত বলেন, ‘‘এক সময় অস্ত্র আইন ও অন্যান্য মামলায় ফেঁসে যাওয়া হিমন্ত বাঁচার জন্য তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী হিতেশ্বর শইকিয়ার হাতেপায়ে ধরে কংগ্রেসে ঢোকে। এখন ফের বিভিন্ন কেলেঙ্কারিতে ফেঁসে যাওয়ায় তিনি মোদী-অমিত শাহের শরণাপন্ন হয়েছেন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

BJP Ex-minister Hemanta
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE