বাংলাদেশ থেকে ভারতে ঢোকা জাল নোটের কারবারিদের ঢাল এখন বৈধ পাসপোর্ট-ভিসা!
জাল নোটের কারবারি বলতে যে ছবিটা ভেসে ওঠে, তা হল— কোঁচড়ে জালনোট নিয়ে লুকিয়ে সীমান্ত টপকে ভারতে ঢুকবে। বৈধ পাসপোর্ট-ভিসার প্রশ্নই নেই। কিন্তু সম্প্রতি সে ধারণা ভেঙে দিয়েছে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)-র হাতে আসা একটি মামলা। ওই চক্রের তিন বাংলাদেশি নাগরিককে ইতিমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। আর তাদের পাণ্ডা মহম্মদ আনারুল ইসলামের পাসপোর্ট তো আছেই, এমনকী সে গত বছর দু’বার বৈধ ভিসা নিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে এ দেশে ঢুকেছে। প্রথম বার ফেব্রুয়ারিতে, মেডিক্যাল ভিসা নিয়ে। পরের বার নভেম্বরে ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে। এ বছর জানুয়ারিতে মালদহে বিএসএফের হাতে ধরা পড়ে যায় বাংলাদেশের চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ এলাকার খড়িয়াল গ্রামের ওই বাসিন্দা। প্রথমে ঘটনার তদন্ত করছিল সিআইডি, পরে মামলার তদন্তভার দেওয়া হয়ে এনআইএ-কে।
আনারুলকে জেরা করে পাওয়া তথ্যে চমকে গিয়েছে এনআইএ। ৪৮ বছরের ওই ব্যক্তি প্রায় এক যুগ আগে উত্তরপ্রদেশে জাল নোট পাচারের একটি মামলায় বছর কয়েক জেল খেটেছিল। শাস্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর দেশে ফিরে সে ফের নেমেছে একই কারবারে। কিন্তু ভারতে জেল খেটে যাওয়ার পরেও কেউ কী ভাবে আবার ভিসা পেতে পারেন— সেটা এখন খতিয়ে দেখছে এনআইএ।
গোয়েন্দা সূত্রের খবর, এই তদন্ত ভার নেওয়ার পরেই এনআইএ-র আইজি সঞ্জীব সিংহ এক বার্তায় জানিয়েছেন, ভারতীয় ভিসার দালাল চক্র ও জাল নোটের চক্র এক সঙ্গে কাজ করছে। সেই চক্রীদের খুঁজে বার করতে হবে।
প্রাথমিক তদন্তে দালাল চক্রের বিষয়টিই গুরুত্ব পাচ্ছে। কারণ আনারুল নিরক্ষর। তার হয়ে অনলাইনে ভিসার দরখাস্ত করে দেয় কোনও দালালই। আনারুল জেরায় জানিয়েছে, শিবগঞ্জের পারচৌকা গ্রামের আপেল শেখ ২০ হাজার বাংলাদেশি টাকার বিনিময়ে তাকে গত বছর ফেব্রুয়ারিতে তিন মাসের মেডিক্যাল ভিসা পাইয়ে দেয়। পরে অক্টোবরের শেষে ট্যুরিস্ট ভিসা করানোর বিনিময়েও আপেল শেখ একই টাকা নেয়। দু’টি ক্ষেত্রেই ভিসা করানো হয়েছে রাজশাহির ভারতীয় সহকারী হাই কমিশন থেকে।
রাজশাহিতে ভারতের সহকারী হাই কমিশনার অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, খবর পেয়ে তাঁরা আনারুলের ভিসা সংক্রান্ত কাগজপত্র খতিয়ে দেখেছেন। দু’টি ক্ষেত্রেই নিয়ম মেনে আবেদন করার পরই ভিসা দেওয়া হয়েছে। মেডিক্যাল ভিসার ক্ষেত্রেও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ঠিকঠাক দেওয়া হয়েছিল। অভিজিৎবাবু জানান, দালাল চক্রের সঙ্গে দূতাবাসের কোনও কর্মীর যোগসাজস থাকার অভিযোগটি তাঁরা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখছেন।
ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের একটি সূত্রের বক্তব্য, অনলাইনে ভিসার আবেদনে সুবিধে যেমন হয়েছে, পোয়াবারো হয়েছে দালাল-চক্রেরও। তদন্তকারীরা জেনেছেন, দালালরাই আনারুলের হয়ে অনলাইনে ফর্ম পূরণ, নথি জমা দেওয়া— সব কাজ করেছে। আনারুলের জটিল ধরনের অর্শ থাকায় সেটা তাকে মেডিক্যাল ভিসা পেতে সাহায্য করেছে। জেরায় সে জানিয়েছে, উত্তরপ্রদেশে গিয়ে সে অস্ত্রোপচারও করালেও রোগ পুরোপুরি সারেনি। সে জন্য উত্তরপ্রদেশে সে ডাক্তার দেখাতে যায়। এক তদন্তকারী অফিসার বলেন, ‘‘অসুস্থতা একটা সুবিধেও রয়েছে। মেডিক্যাল ভিসা মিলছে, আবার এ দেশে ঢুকে জাল নোটের কারবারও করা যাচ্ছে।’’
এনআইএ প্রাথমিক তদন্তে জেনেছে, শিবগঞ্জের এই আপেল শেখই আবার বাংলাদেশ থেকে জাল নোট পৌঁছে দিয়েছিল মালদহে আনারুলের হাতে। আনারুল যা নিয়ে উত্তরপ্রদেশের ফিরোজাবাদে তাদের চক্রের লোকেদের হাতে তুলে দেয়। আগরায় ফতিমা নামে এক জনের বাড়িতে সে কিছু দিন ছিল। কিন্তু আপেল শেখ তাকে খবর দেয়, আরও জাল নোট পাঠানো হচ্ছে। জানুয়ারি মাসে সেগুলি নিতে মালদহে এসেই ধরা পড়ে আনারুল।
গোয়েন্দারা বলছেন— ধরা পড়ায় আনারুলের কথা জানা গিয়েছে। কিন্তু এ রকম আরও অনেকে যে পাসপোর্ট-ভিসা নিয়ে ভারতে ঢুকে জাল নোটের কারবার করছে না, সেটা বলা যায় না। এক গোয়েন্দার কথায়, ‘‘রাজশাহি জেএমবি-র ঘাঁটি। সেখান থেকে জাল নোটের কারবারিরা বৈধ ভিসা নিয়ে ঢুকছে। জঙ্গিরাও যে ঢুকছে না, সেটা কে বলতে পারে?’’
আনারুল এখন জেলে। তাকে ফের হেফাজতে নিতে আদালতে আবেদন করবে এনআইএ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy