স্মৃতিবিজড়িত: হাইলাকান্দি শহরের ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হাইস্কুল ভবন। ছবি: অমিত দাস।
হাইলাকান্দির সরকারি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হাইস্কুলে ক্লাস ফোর-এ ভর্তি হই ১৯৬৫ সালে। সে সময়ে এ শহরে সাকুল্যে ছিল ৪টি স্কুল—৩টি ছেলেদের ও একটি মেয়েদের জন্য। তার মধ্যে আমার স্কুল ছিল গৌরবে ও মহিমায় অগ্রগণ্য। ১৯০৩ সালে মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে উন্নীত হওয়ার দিন থেকেই এটি শহরের প্রধান স্কুল। সব পরিবারের অভিভাবক চাইতেন, তাঁর ছেলে এই স্কুলে পড়ুক। আমরা ভর্তি হওয়ার পর বা তারও আগে বড়দের মুখে শুনতাম কিংবদন্তি হয়ে যাওয়া মাস্টারমশাইদের গল্প। ছোটবেলায় তাঁদের বেশ কয়েক জনকে দেখেছি, বাকিরা তখন ইতিহাস। শোনা যেত, স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে তাঁরা পড়ানোর পাশাপাশি কী ভাবে জাতিগঠন করার কাজটিও করে যেতেন। পণ্ডিতমশাই রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য সন্ধেবেলার পরে কোনও ছেলেকে রাস্তায় গুলতানি মারতে দেখলে কী ভাবে কান ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে বাড়ি পৌঁছে দিতেন। শিক্ষকদের পাশাপাশি কৃতী ছাত্রদেরও ছিল দীর্ঘ তালিকা। তাঁদের একজন মাননীয় ব্রজকান্ত গুহ, আইসিএস, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় উপাচার্য। ষাটের দশকে সে গৌরব-রবি অনেকটা অস্তমিত, যদিও শেষ বর্ণচ্ছটা পুরোটা মিলিয়ে যায়নি।
শহরের প্রধান খেলার মাঠের সামনে লালরঙা ইটের বাড়িটি আজও সমান দৃষ্টিনন্দন। বাড়িটির ডান পাশে লম্বা দিঘিতে পড়ত তার ছায়া। দিঘির অপর পারে হেড মাস্টারমশাইয়ের কোয়ার্টারটি এখন নেই। স্কুলবাড়ির ঠিক পিছনে চতুর্থ প্রধান শিক্ষক কেদারেশ্বর ভট্টাচার্যের আমলে খনন করা দিঘি ‘কেদার-সাগর’। সবুজ মাঠ পেরিয়ে স্কুলের প্রধান প্রবেশ পথটির বাঁ দিকে কয়েক ধাপ লাল সিঁড়ির পর হেড মাস্টারমশাইয়ের কামরা। স্কুল শুরুর আগে সিঁড়ির সামনে ছেলেরা সারিতে দাঁড়ালে প্রধান শিক্ষক ও অন্য শিক্ষকদের উপস্থিতিতে শুরু হয় ‘প্রেয়ার’। ক্লাস শুরু হলে বেত হাতে প্রধান শিক্ষকমশাইয়ের টহল ছিল নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। দেরি হলে হাত পেতে বেতের ঘা নিতে হত। তা নিয়ে কখনও কোনও অভিভাবককে উষ্মা প্রকাশ করতে দেখিনি। তবে সব প্রধান শিক্ষক একই রকম ছিলেন না। কুলদারঞ্জন ছিলেন স্নেহশীল, বিনোদ ভট্টাচার্য (স্থানীয় উচ্চারণে ‘বিনোদ ভট’) একটু বেশি মাত্রায় কঠোর।
শহরের নিস্তরঙ্গ জীবনে শিক্ষকেরা অনেকেই ছিলেন ছাত্রদের পরিবারের সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবে পরিচিত। একই পরিবারের একাধিক ছেলে যেহেতু এ স্কুলেরই পড়ুয়া, তাই শাসনের সময় দাদা-ভাইয়ের সঙ্গে চলত প্রতিতুলনা। ছাত্রের আচরণে পরিবারের সম্মানের ভরাডুবি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা নিয়ে গভীর উদ্বেগ। অভিভাবকরা শাসনের দায়িত্ব শিক্ষকদের উপর ন্যস্ত করে দিয়ে যেন নিশ্চিন্ত ছিলেন। মনে পড়ে, সত্তরের দশকে আমরা যখন মাধ্যমিক পরীক্ষায় (অসমে তার নাম ছিল হাইস্কুল লিভিং সার্টিফিকেট) বসি—তখন যেহেতু পরীক্ষার হলে নৈরাজ্য দেখা দিচ্ছে, তাই অভিভাবকেরা স্কুলগুলিতে ঘুরে ঘুরে ইনভিজিলেশন দেন। এমনই নিবিড় ছিল স্কুলের সঙ্গে শহরের জনজীবনের সম্পর্ক।
স্কুলজীবনের কথা ভাবলে মনে পড়ে, বার্ষিক পরীক্ষার পরে দেখতাম শীতের রোদে পিঠ দিয়ে শিক্ষকেরা খাতা দেখছেন। ফল বেরোলে উঁচু ক্লাসের ভাল ছাত্রদের কথা ফলাও করে বলতেন। জল্পনা চলত এদের মধ্যে কার বোর্ডে শীর্ষ স্থান পাওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল। তখন কয়েক বছর অন্তর প্রথম দশ জনে জায়গা করে নিতেন দাদারা। তাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে গর্বে আর রোমাঞ্চে মন ভরে যেত। শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণ কোনওটিই তাই নীরস ছিল না।
সরকারি স্কুল হওয়ায় বহু ভাল শিক্ষককেই একটানা পাইনি আমরা। কিন্তু কত দ্রুততায় তাঁরা মন জয় করে নিতেন, সেটা ভাবলে অবাক লাগে। স্কুল ফাঁকি দিয়ে মুদ্রার বিনিময়ে নোট বিক্রির সংস্কৃতি তখনও চালু হয়নি। সত্তরের দশকের প্রারম্ভে অবক্ষয়ের শুরু দেখেছি। ক্লাসে পিছনের সারিতে বসা ছেলেগুলি সে দিন শুধু দুষ্টু নয়, অপরাধপ্রবণতা দেখা দিচ্ছে তাদের মধ্যে। তখন কিছু শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের মুখে যে বিষণ্ণতার ছায়া দেখেছি, আজও তা মনে পড়ে। যাঁরা এক দিন স্নেহভরে ছাত্রদের বুকে টেনে নিতেন, সেই সব শিক্ষকরাই যেন কিছুটা সিঁটিয়ে গেলেন। সে সময়কার টালমাটাল দিনে ছোটখাটো চেহারার প্রধান শিক্ষক বিপুল দত্তকে অপরিসীম ধৈর্য, ক্ষমা দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে দেখেছি। আজকাল যেটুকু শুনি তাতে মনে হয়, চার দিকে গজিয়ে ওঠা কেজো ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলের ভিড়ে আজও মহীরুহের মতো দাঁড়িয়ে থাকা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল যেন কিছুটা অপাঙ্ক্তেয়।
আশির দশকে করিমগঞ্জ শহরে গিয়ে শুনি, মৃত্যুপথযাত্রী বিপুল দত্ত মহাশয় আমাকে দেখতে চেয়েছেন। তাঁর শয্যার পাশে গিয়ে দাঁড়ালে তিনি যখন মাথায় তাঁর হাত রাখলেন, আমার মনে হল যেন এক মহৎ প্রজন্ম বিদায় চেয়ে নিল তার দীন উত্তরসূরির কাছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy