জয়ের আনন্দ। গুয়াহাটিতে বিজেপি সমর্থকদের উৎসব। বৃহস্পতিবার। ছবি: পিটিআই।
তরুণ গগৈ সরকারের রাজ্যপাট কার্যত ‘সামলাতেন’ তিনি-ই।
বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মনোমালিন্যের জেরে ৯ জন অনুগামী বিধায়ককে নিয়ে দল ছাড়ার সময় সেই দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা জানিয়ে গিয়েছিলেন— মুখ্যমন্ত্রী নয়, কিং-মেকার হতেই বিজেপিতে যাচ্ছেন তিনি।
কথা রাখলেন হিমন্তবিশ্ব শর্মা।
প্রথমে বিপিএফ ও অগপর সঙ্গে জোটের বন্দোবস্ত করে, পরে রাজ্যজুড়ে ঝড়ো প্রচার চালিয়ে বিজেপিকে জয়ের দিকে অনেক কদম এগিয়ে দিলেন। নিজেও জিতলেন, তাঁর উপরে ভরসা করে বিজেপিতে যোগ দেওয়া ৯ জনকেও জিতিয়ে আনলেন। ৮৬ হাজার ভোটের ব্যবধানে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করলেন হিমন্ত।
মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী সর্বানন্দ সোনোয়াল হলেও, বিধানসভা ভোটে বিজেপির তারকা প্রচারক এবং সব চেয়ে বড় ভরসা ছিলেন প্রাক্তন কংগ্রেস নেতা হিমন্তই। তাঁর কাছে এটা ছিল রাজনৈতিক অস্তিত্বরক্ষার সংগ্রাম। বিজেপির কাছেও এই ভোট ছিল— হয় এ বার, নয় নেভার।
৪ মার্চ থেকে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত গোটা রাজ্য চষে ফেলেছিলেন হিমন্ত। ২৭০টি সভা, ১৬০ কিলোমিটার পদযাত্রায় পর ভোট প্রচারের শেষ দিন নিজের কেন্দ্র জালুকবাড়িতে এক বার মিনিট পাঁচেকের বক্তব্য রাখেন তিনি। ভেঙে পড়েছিলেন কান্নায়। ১৫ বছর ধরে জালুকবাড়ির বিধায়ক থাকা হিমন্তকে চতুর্থ বারও হতাশ করেনি জালুকবাড়ি। তিনি জিতলেন রাজ্যের মধ্যে সব চেয়ে বেশি ভোটের ব্যবধানে।
বরাবরের দুরদর্শী রাজনীতিবিদ ও সংগঠক হিমন্ত ঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া, সময়ের চেয়ে এগিয়ে ভাবার জন্যেই হিতেশ্বর শইকিয়ার আমল থেকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। বাঙালি বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম শরিক হয়েও আজ পর্যন্ত জালুকবাড়ির মানুষের কাছে তিনি অবিকল্প প্রার্থী। জালুকবাড়ির অনেক বাঙালি জানেনই না, হিমন্তের বিরুদ্ধে অন্য দলগুলির প্রার্থী কারা! এক সময় সাইকেলে প্রফুল্ল মহন্তর হয়ে প্রচারপত্র বিলি করতেন হিমন্ত। ছাত্র রাজনীতির সূত্র ধরেই আলফার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা বাড়ে বলে অভিযোগ। তোলা আদায়, অস্ত্র রাখার মতো ঘটনায় পুলিশের চোখ ছিল হিমন্তের উপরে। তার পরই হিতেশ্বর শইকিয়ার হাত ধরে তাঁর কংগ্রেস রাজনীতিতে প্রবেশ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ হিমন্ত আইনের পাঠ শেষ করে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত হাইকোর্টের আইনজীবী ছিলেন। আসুর পরিচয় মুছে ফেলে এলাকার বাঙালিদের কাছেও হিমন্ত ঘরের ছেলে হয়ে গিয়েছিলেন। অন্য দিকে সব বিভাগের নিয়মনীতি, কাজকর্ম নিয়ে অবগত হিমন্ত বিধানসভায় কখনও কংগ্রেস কোনঠাসা হলেই ত্রাতার ভূমিকা নিয়েছেন।
২০০২ সাল থেকে ২০১৪ পর্যন্ত রাজ্যের বিভিন্ন বিভাগের মন্ত্রিত্ব সামলানো হিমন্তের বিরুদ্ধে দুর্নীতির একাধিক অভিযোগ উঠেছে। লুই বার্জার ও সারদা কেলেঙ্কারিতে তাঁর নাম জড়ালেও, কোনও অভিযোগ প্রমাণ হয়নি। আলফা একাধিক বার দাবি করেছে, হিমন্ত তাদের হয়ে টাকা আদায় করতেন। উজানি অসমে বিরোধী ছাত্রনেতাদের হত্যার ঘটনাতেও হিমন্ত ও সর্বানন্দ জড়িত বলেও আলফা দাবি করে। কিন্তু তাতেও তাঁর জনপ্রিয়তা কমেনি। হিমন্তের সঙ্গে গগৈয়ের ক্ষমতার লড়াই শুরু হওয়ার পরও, এআইসিসি তাঁকে দলে ধরে রাখার অনেক চেষ্টা করেছিল।
গত দু’বার ভোটে কংগ্রেসের জয়ের অন্যতম কারাগর ছিলেন হিমন্ত। এ বার বিজেপির হয়ে প্রচারে তিনি এক দিকে ১৯৫১ সালকে ভিত্তিবর্ষ করার ঘোষণা করেন, অন্য দিকে জানান কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে আজমল হবেন উপমুখ্যমন্ত্রী। রাজনৈতিক শিবিরের বক্তব্য, এ ভাবে ভূমিপুত্রদের মনে জমি হারানোর আশঙ্কা ঢোকাতে সফল তিনি। উজানি অসমে আহোম ভোট ভাগ করে দেওয়া আর নামনিতে বাঙালি ও সংখ্যালঘু ভূমিপুত্রদের ভোট টানা—এই ছিল তাঁর হাতিয়ার। দু’টিতেই সফল তিনি।
কংগ্রেস এমনও বলেছিল— তাঁদের চর হয়েই বিজেপিকে শেষ করতে সেই দলে গিয়েছেন হিমন্ত। তরুণ গগৈ, রকিবুল হুসেনরা দাবি করেছিলেন— ১৯৫১ সালকে ভিত্তিবর্ষ করার কথা বলে হিমন্তই কংগ্রেসের জয়লাভের পথ সুগম করেছেন। কিন্তু হিমন্ত বরাবর বলে গিয়েছেন, তাঁর ওই মন্তব্যে পরাজয় নয়, বরং বিরাট ব্যবধানে জিতবে বিজেপি। গত রবিবারই হিসেব কষে বিজেপি জোটকে ৮৮টি আসন দিয়ে রাখেন হিমন্ত। তাঁর দাবিই সত্যি হল। হিমন্ত জানিয়েছেন, তিনি ক্ষমতা বা পদের জন্য লালায়িত নন। যে দল তাঁর উপরে আস্থা রেখেছে, সেই দলকে ঋণশোধ করার চেষ্টা করেছেন মাত্র। কিন্তু বিজেপি জানে, হিমন্তের মতো হাতিয়ারকে যোগ্য সম্মান না দিলে তা পাল্টা আঘাত হানতে পারে। তাই আসন্ন মন্ত্রিসভায় সর্বানন্দের পরেই হিমন্তের স্থান হতে চলেছে বলে দলীয় সূত্রে খবর। এ দিন জয়ের পর হিমন্ত বলেছেন, ‘‘অসমবাসীকে কৃতজ্ঞতা জানাই। এই জয় অমিত শাহ ও নরেন্দ্র মোদীর সাফল্য।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy