সর্বদল বৈঠকে মেহবুবা মুফতির সঙ্গে রাজনাথ সিংহ ও অরুণ জেটলি। শ্রীনগরে। রবিবার। ছবি: পি টি আই
খুলল না দরজা। গলল না বরফ। সেই অন্ধকারেই পড়ে রইল ভূস্বর্গের ভবিষ্যৎ।
এক পা বাড়িয়ে সর্বদলীয় বৈঠকের মাঝপথে হুরিয়ত নেতা সৈয়দ আলি শাহ গিলানির সঙ্গে বৈঠক করতে বেরিয়েছিলেন সীতারাম ইয়েচুরি, ডি রাজা, শরদ যাদবেরা। বৈঠকের সম্ভাবনায় সরে গিয়েছিল গিলানির বাড়ির সামনের পাহারাও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দরজা খুললেন না গিলানি। বন্ধ দরজার সামনে প্রায় মিনিট দশেক অপেক্ষা করার পর ফিরে আসতে বাধ্য হলেন ইয়েচুরিরা। একই ভাবে আসাদউদ্দিন ওয়েইসিদের ফিরিয়ে দিয়েছেন মিরওয়াইজ উমর ফারুক ও ইয়াসিন মালিকের মতো অন্য চরমপন্থী নেতারা। প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে না বসার প্রশ্নে চরমপন্থী নেতাদের এই ঐক্য অশান্তি দীর্ণ কাশ্মীরের ভবিষ্যতকে ফের প্রশ্নচিহ্নের মুখে ফেলে দিল।
সব মিলিয়ে দিনভর দফায় দফায় বিভিন্ন শিবিরের সঙ্গে প্রতিনিধি দলের বৈঠক হওয়ার পরেও কাশ্মীর যে আগামী দিনেও অশান্ত থাকবে, তা বিলক্ষণ বুঝছে নয়াদিল্লি।
কাশ্মীর-বিশেষজ্ঞরা অবশ্য গোড়া থেকেই এই বৈঠক নিয়ে বিশেষ আশাবাদী ছিলেন না। তাঁদের মতে, এ বার হুরিয়ত নেতাদের উস্কানিতে কাশ্মীর সমস্যা এমন জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে যে এখন সেখান থেকে ফিরতে গেলে ওই নেতাদের বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে পৌঁছে যাবে! গোয়েন্দাদের মতে, চলতি অশান্তির পিছনে পাকিস্তানের উস্কানি এবং টাকা রয়েছে। বিদেশ থেকে টাকা পাওয়ার তালিকায় গিলানির বড় ছেলের নাম রয়েছে বলেও অভিযোগ। এক দিকে উপত্যকার মানুষ, অন্য দিকে পাকিস্তানের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতে নারাজ হুরিয়ত নেতারা তাই ছক কষেই বৈঠক থেকে দূরে রইলেন।
প্রশ্ন হল, কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ কী চাইছেন? উত্তর হল, উপত্যকা এখন স্থায়ী সমাধান চায়। দু’মাস ধরে রুটি-রুজি বন্ধ। পর্যটনের মরসুম প্রায় পুরোটাই জলে গিয়েছে। বছরের বাকি সময়টাতেও আর তেমন আশা নেই। ফলে সঙ্কট আরও বাড়বে। কিন্তু আম-কাশ্মীরি স্থায়ী শান্তির জন্য আরও দীর্ঘ সময় ধরে কষ্ট করতে রাজি। বিশ্লেষকরা বলছেন, চলতি অশান্তির পিছনে পিডিপি-বিজেপি জোটকে মেনে না নেওয়া একটি বড় কারণ। বিজেপিকে রুখতে ভোট চেয়ে জিতে আসা পিডিপি ভোটের পরেই নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে হাত মেলানোয় উপত্যকার বড় অংশের কাছে মেহবুবার দল বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। সর্বদলীয় প্রতিনিধি দলের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এর আগে ২০০৮ ও ২০১০-এ অশান্তির সময় সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে গিয়েছিল সংসদীয় দল। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা ন্যাশনাল কনফারেন্স প্রধান ওমর আবদুল্লার কথায়, ‘‘উপত্যকা শান্ত হতেই সেই প্রতিশ্রুতি ভুলে যায় সব শিবির!’’ আমজনতা তাই এ বার প্রতিনিধি দলের কথায় ভুলতে নারাজ।
তাই চরমপন্থীদের ধাঁচেই একাধিক শিবির যেমন আজকের বৈঠকে গরহাজির রইল, তেমনই প্রতিনিধি দলের সফরের বিরোধিতায় রাস্তায় নামল সাধারণ মানুষ। হুরিয়ত নেতা মাসরুর আব্বাস আনসারি প্রতিনিধি দলের পথ আটকানোর চেষ্টা করলে তাঁকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পুলওয়ামা, অনন্তনাগেও বিক্ষোভ হয়। এরই মধ্যে হিজবুল মুজাহিদিনের প্রধান সালাউদ্দিন আজ হুমকি দিয়েছেন, আত্মঘাতী জঙ্গিরা আঘাত হানতে তৈরি। তারা কাশ্মীরকে ভারতীয় সেনার কবরস্থানে পরিণত করবে। গোয়েন্দারা অবশ্য সালাউদ্দিনের হুমকি নিয়ে বিশেষ চিন্তিত নন। তাঁদের বক্তব্য, পাকিস্তানের চাপে অশান্তি জিইয়ে রাখতেই সালাউদ্দিন এ সব বলছে।
সর্বদলীয় বৈঠকেও অশান্তির জন্য পাকিস্তানকেই দায়ী করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা। প্রতিনিধি দলের সদস্য তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায় বলেন, ‘‘যে তরুণেরা পাথর ছুড়ছেন তাদের কে বোঝাবে, সেই প্রশ্নটি অমীমাংসিত রয়ে গিয়েছে।’’ মেহবুবার দাবি, এই তরুণদের হাতে পাথর ছোড়ার জন্য টাকা দেওয়া হচ্ছে। আর এদের চালিত করছেন হুরিয়ত নেতত্ব।
সব পক্ষই বুঝছে, হুরিয়তকে পাশে পেলে সমস্যা অনেকটাই মিটে যাবে। তাই ঠিক হয়, রাজনাথ সিংহ বা অরুণ জেটলিরা না গিয়ে বিরোধী সাংসদদের পাঠানো হবে তাঁদের কাছে। সেই মতো জেলবন্দি হুরিয়ত নেতা মিরওয়াইজ উমর ফারুকের সঙ্গে কথা বলতে যান সাংসদ আসাদউদ্দিন ওয়েইসি। মিরওয়াইজ তাঁকে ফিরিয়ে দেন। এর পর বাদগামের কাছে হুমহুমা পুলিশ স্টেশনে বন্দি জেকেএলএফ নেতা ইয়াসিন মালিকের সঙ্গে দেখা করতে যান ডি রাজা-ইয়েচুরিরা। মালিককে বলেন, ব্যক্তিগত ভাবে তাঁরা দেখা করতে এসেছেন। কিন্তু প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন ইয়াসিন মালিক। সূ্ত্রের খবর, তিনি বলেছেন, উপত্যকার এই অবস্থায় আলোচনা অর্থহীন।
গিলানির বাড়িতেই সব থেকে অস্বস্তিতে পড়েন সীতারাম-শরদ যাদবরা। সীতারামেরা ঠিক করেন, তাঁরা নিজেরাই যাবেন গিলানির সঙ্গে কথা বলতে। সেই মতো তাঁরা সেখানে গেলেও অতিথিদের জন্য দরজা খোলেননি গিলানি। উল্টে সাংসদদের সামনে ভারতবিরোধী স্লোগান দেন তাঁর সমর্থকেরা। বন্ধ দরজার সামনে প্রায় দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে আসেন সীতারাম-শরদরা। হতাশ সীতারাম পরে বলেন, ‘‘আমরা এসেছিলাম গিলানির কথা শুনতে। উনি দরজা খোলেননি। আলোচনাই কিন্তু সমাধানের একমাত্র পথ।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy