পরিকল্পনা হয়েছিল এক যুগেরও বেশি আগে। ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে একটু দূরে সমুদ্রের বুকে গড়ে তোলা হবে সশস্ত্র বাহিনীর সদা-যুদ্ধপ্রস্তুত এক ঘাঁটি। সেনা, বায়ুসেনা ও নৌসেনার মিশেলে তৈরি এক যৌথ বাহিনী মোতায়েন থাকবে সেখানে। সেই মতো ২০০১ সালে আন্দামানে গড়ে তোলা হয় তিন বাহিনীর পূর্ণ ক্ষমতার অপারেশনাল কম্যান্ড— ‘আইএনএস জারোয়া’। ভারত মহাসাগরে নয়াদিল্লির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাই ছিল এই ভাবনার প্রধান উদ্দেশ্য।
১৫ বছর পেরিয়েছে। কিন্তু পরিকাঠামো ও যুদ্ধ প্রস্তুতির নিরিখে এই যৌথ কম্যান্ড এখনও পুরোপুরি তৈরি হয়ে উঠতে পারেনি বলে জানাচ্ছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের একাংশ। পরিবেশ আইনের বাধা, জমির জট, পর্যাপ্ত অর্থের অভাবের মতো নানা কারণে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে সেনা পরিকাঠামোর প্রকল্পগুলি সময় মতো তৈরি করা যাচ্ছে না বলে জানিয়ে দিচ্ছেন বাহিনীর স্থানীয় কর্তারাই।
সম্প্রতি কলকাতার ইনস্টিটিউট অব কালচারাল অ্যান্ড সোশ্যাল স্টাডিজ এবং তিন বাহিনীর যৌথ আলোচনায় এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন আন্দামানের উপ-রাজ্যপাল এ কে সিংহও। তিনি বলেন, ‘‘এই দ্বীপপুঞ্জকে সীমান্ত আউটপোস্ট হিসেবে দেখলে চলবে না। দেশের নিরাপত্তা রক্ষার স্প্রিংবোর্ডে পরিণত হয়েছে এই অঞ্চল। জিমন্যাস্টরা যেমন স্প্রিংবোর্ডের উপরে কসরত করেন, নয়াদিল্লিকেও ভারত মহাসাগরে কর্তৃত্ব করতে হবে আন্দামানকে ঘিরে। এটা বোঝার সময় এসেছে।’’
যৌথ কম্যান্ডের চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল পি কে সিওয়াচ ওই আলোচনাচক্রে রাখঢাক না করেই বলেন, ‘‘চিন এক বছরের মধ্যে কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করে যুদ্ধজাহাজ রাখতে পারে। আর আমরা ১৫ বছরে দু’টো এয়ারস্ট্রিপের সম্প্রসারণ করতে পারলাম না। সেখানে যুদ্ধবিমান নামানোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল। আমাদের আরও দ্রুত এগোতে হবে!’’
কিন্তু কী ভাবে? সব চেয়ে বড় প্রশ্ন এখন সেটাই! আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ ৭৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ। উত্তরে ইস্ট দ্বীপ এবং ল্যান্ডফল দ্বীপ থেকে মায়ানমারের কোকো দ্বীপ মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে। আর একেবারে দক্ষিণে গ্রেট নিকোবর থেকে সুমাত্রা মাত্র ১৪০ কিলোমিটার। গ্রেট নিকোবরের ঠিক ৩০ কিলোমিটারের মধ্যেই আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচলের পথ। যেখান দিয়ে পৃথিবীর শতকরা ৭৫ ভাগ জ্বালানি এবং ৬০ ভাগ পণ্য যাতায়াত করে। ফলে ভূ-কৌশলগত কারণেই আন্দামানের নিরাপত্তা আরও শক্তিশালী হওয়া উচিত বলে বিশেষজ্ঞদের মত। অথচ বাস্তবে প্রতিরক্ষা প্রস্তুতির দিক থেকে এই দ্বীপপুঞ্জের বর্তমান অবস্থাটা তেমন আশাব্যঞ্জক নয়।
সেনা কর্তারা জানালেন, উত্তর আন্দামানের ডিগলিপুরের শিবপুরে নৌবাহিনীর একটি বিমানঘাঁটি (নেভাল এয়ারবেস) রয়েছে। পোর্ট ব্লেয়ারে রয়েছে তিন বাহিনীর সদর দফতর এবং ১৪ ডকের নৌ-ঘাঁটি। কার নিকোবরে বায়ুসেনা ঘাঁটি। এখানে সুখোই-৩০-এর মতো যুদ্ধবিমান ওঠা-নামা করতে পারে। এ ছাড়া কামোর্তা দ্বীপে রয়েছে আরও একটি নৌ-ঘাঁটি ‘আইএনএস কারদীপ’। একেবারে দক্ষিণে গ্রেট নিকোবরের ক্যাম্পবেল বে-তে রয়েছে নৌবাহিনীর আরও একটি এয়ারফিল্ড। পোর্ট ব্লেয়ারে অবশ্য একটি ভাসমান ডকও রয়েছে। এক শীর্ষ সেনা কর্তা বলেন, ‘‘যৌথ অপারেশনাল কম্যান্ড তৈরির সময় প্রতিটি ঘাঁটিরই পরিকাঠামো বৃদ্ধির পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য, একটিও বাস্তবায়িত হয়নি।’’
কী রকম এই দীর্ঘসূত্রতা? একে একে আসা যাক।
পোর্ট ব্লেয়ারের নৌ-ঘাঁটিটি ব্রিটিশ আমলের। সেখানে সব সময় কম-বেশি ১৫টি যুদ্ধজাহাজ রাখা হয়। কিন্তু বড় আকারের আধুনিক যুদ্ধজাহাজ এখানে আসতে পারে না। এ দিকে, আন্দামানে আরও ৭-৮টি জাহাজ রাখার পরিকল্পনা রয়েছে নৌবাহিনীর। সেই কারণেই একটি নতুন দ্বীপকে চিহ্নিত করে আরও একটি নৌ-ঘাঁটি তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। কিন্তু ওই পর্যন্তই। নতুন নৌ-ঘাঁটি তৈরির তোড়জোড় আটকে রয়েছে পরিবেশ আইনের ফাঁসে। যুক্তি হল এই, নৌ-ঘাঁটি তৈরি করতে গেলে প্রচুর গাছ কাটা পড়বে।
বায়ুসেনার অবস্থাও তথৈবচ। যৌথ কম্যান্ডের এক বায়ুসেনা কর্তা জানান, ২০০৪ সালে সুনামির পর কার নিকোবর বিমানঘাঁটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখন শুধু সেখানেই যুদ্ধবিমান নামতে পারে। পরিকল্পনা ছিল, শিবপুর এবং ক্যাম্পবেল বে-র ১০০০ মিটার দীর্ঘ এয়ারস্ট্রিপ দু’টিকে বাড়িয়ে ৩০০০ মিটার করা হবে, যাতে সুখোই ওঠানামা করতে পারে। ওই বায়ুসেনা কর্তার কথায়, ‘‘আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচলের রুটের আশপাশে আমাদের এমন একটি বিমানঘাঁটি খুব প্রয়োজন।’’ কিন্তু গত ১৫ বছরে এই কাজটাও হয়নি। কারণ পরিবেশ আইন। রানওয়ে লম্বা করতে হলে জঙ্গল কাটতে হতো। ছাড়পত্র মেলেনি আজও।
আরও আছে। কামোর্তা দ্বীপে ‘আইএনএস কারদীপ’ ঘাঁটিকে পারমাণবিক শক্তিচালিত ডুবোজাহাজের ডক হিসেবে প্রস্তুত করার পরিকল্পনা ছিল নৌবাহিনীর। কারণ, এখান থেকেই এডেন উপসাগর, মালাক্কা এবং হরমুজ খাঁড়িতে গোপন নজরদারি চালানো সম্ভব। এখানে প্রায় ৩০০ একর জমি থাকলেও বিভিন্ন কারণে কাজের কিছুই অগ্রগতি হয়নি।
পোর্ট ব্লেয়ারে আরও একটি ভাসমান ডক নির্মাণের প্রস্তাব পাশ হয়েছে।
কিন্তু কবে তা বাস্তবায়িত হবে, কেউ জানে না।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ তথা আন্দামানের প্রাক্তন মুখ্যসচিব শক্তি সিনহা বলছিলেন, ‘‘এই সমস্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে আরও এক যুগ লাগবে।’’ চমকে ওঠার মতোই আরও একটা খবর দিলেন তিনি। বললেন, “২০১৪ সালের ৮ মার্চ রাতে মালয়েশিয়ার বিমান এমএইচ ৩৭০ নিখোঁজ হয়ে যায়। আন্দামানের খুব কাছ দিয়েই সেটি গিয়েছিল। কিন্তু আমাদের ঘাঁটির বিমান ট্র্যাকিং সিস্টেমের রেডারে তা ধরাই পড়েনি। কেন জানেন?
রাতে নাকি ট্র্যাকিং সিস্টেম বন্ধ ছিল। এই হল আমাদের যৌথ বাহিনীর প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি!’’
বিশেষজ্ঞরা উদ্বিগ্ন। আন্দামানের মুখ্যসচিব আনন্দ প্রকাশ অবশ্য আশ্বাস দিচ্ছেন। তাঁর যুক্তি, ‘‘পরিবেশ ও প্রতিরক্ষার মধ্যে ভারসাম্য রাখতে হবে। নির্বিচারে গাছ কাটা যাবে না, আবার যুদ্ধ প্রস্তুতিও চালাতে হবে। সে বিষয়ে প্রশাসন সচেতন। দেরি হলেও সব প্রকল্পই শেষ হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy