Advertisement
০৯ মে ২০২৪
বিড়ম্বনা বাড়লো বসুন্ধরায়

তথ্য দিলেন ললিতই, সুষমার পাশে দাঁড়িয়েও দূরত্ব বোঝালেন জেটলি

বিজেপির বিড়ম্বনা বাড়িয়ে ললিত মোদী-কাণ্ডে এ বার ঢুকে পড়ল বসুন্ধরা রাজের নাম! কংগ্রেসের ক্রমবর্ধমান আক্রমণের মুখে আজ সাংবাদিক বৈঠক করে সুষমা স্বরাজের পাশে দাঁড়িয়েছেন অরুণ জেটলি ও রাজনাথ সিংহ। কিন্তু সেই সাংবাদিক বৈঠকও স্পষ্ট করে দিয়েছে কেন্দ্রের শাসক দলের অন্দরের বিভাজন। তার পর বসুন্ধরা প্রসঙ্গ আরও এলোমেলো করে দিয়েছে বিজেপি-কে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০১৫ ০৩:১৪
Share: Save:

বিজেপির বিড়ম্বনা বাড়িয়ে ললিত মোদী-কাণ্ডে এ বার ঢুকে পড়ল বসুন্ধরা রাজের নাম!

কংগ্রেসের ক্রমবর্ধমান আক্রমণের মুখে আজ সাংবাদিক বৈঠক করে সুষমা স্বরাজের পাশে দাঁড়িয়েছেন অরুণ জেটলি ও রাজনাথ সিংহ। কিন্তু সেই সাংবাদিক বৈঠকও স্পষ্ট করে দিয়েছে কেন্দ্রের শাসক দলের অন্দরের বিভাজন। তার পর বসুন্ধরা প্রসঙ্গ আরও এলোমেলো করে দিয়েছে বিজেপি-কে।

কী ভাবে জড়ালেন রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী?

ললিত মোদীর আইনজীবী মেহমুদ আবদির পক্ষ থেকে সংবাদমাধ্যমে পাঠানো এক নথিতে দাবি করা হয়েছে, ললিতকে যাতে ব্রিটেন অভিবাসন দেয় সে জন্য ২০১১ সালে তাঁর হয়ে সওয়াল করেছিলেন বসুন্ধরা। তিন পাতার ওই নথিতে লেখা হয়েছে, ‘ললিত মোদীর দায়ের করা অভিবাসন আবেদনকে আমি সমর্থন করছি। তবে কঠোর ভাবে এই শর্তে যে, আমার এই সমর্থনের কথা কোনও ভাবেই ভারতীয় কর্তৃপক্ষের গোচরে আসবে না।’

এই চিঠি আদপে বসুন্ধরার লেখা কি না, তা নিরপেক্ষ ভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। নথিতে কারও কোনও সই নেই। চিঠি মাঝপথেই শেষ হয়ে গিয়েছে। এমনকী, শেষ বাক্যটিও অসম্পূর্ণ। কিন্তু এই নথি প্রকাশ্যে আসার পরে ললিত নিজে একটি টিভি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘‘বসুন্ধরা আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ পারিবারিক বন্ধু। ব্রিটেনে অভিবাসন পাওয়ার ব্যাপারে আমার সমর্থনে লিখিত বিবৃতিও দিয়েছিলেন তিনি।’’ বসুন্ধরা নিজে অবশ্য এমন কোনও চিঠি লেখার কথা অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘(ললিত মোদীর) পরিবারকে আমি অবশ্যই চিনি।... কিন্তু ওরা কোন নথির কথা বলছে জানি না।’’

নথি সত্যি হোক বা না হোক, গোটা বিষয়টি প্রচারের আলোয় এসে দলের ভাবমূর্তিতে যে বড় মাপের ধাক্কা দিয়েছে, তা কবুল করছেন বিজেপির শীর্ষস্থানীয় অনেক নেতাই। তার উপর গত দু’দিন ধরে খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকেই আক্রমণের মূল লক্ষ্য করছে কংগ্রেস-সহ বিরোধীরা। এই অবস্থায় আজ আসরে নামলেন অরুণ জেটলি। ললিত মোদীর ট্র্যাভেল ডকুমেন্ট পাওয়ার ক্ষেত্রে সুষমা স্বরাজের ভূমিকা ফাঁসের ক্ষেত্রে জেটলি শিবিরের হাত রয়েছে বলেই জল্পনা দিল্লির রাজনৈতিক মহলে। কারণ জেটলি বিজেপিতে সুষমার বিরোধী শিবিরের লোক, আর ক্রিকেট রাজনীতিতে ললিতের। গত দু’দিন ধরে জেটলি মুখে কুলুপ এঁটে থাকায় সেই জল্পনা আরও জোরদার হয়েছে।

বিরোধীদের আক্রমণের নিশানায় খোদ প্রধানমন্ত্রী এসে পড়ায় আজ অভিযোগ খারিজের দায় বর্তায় জেটলির উপরে। বিজেপি সূত্র বলছে, বিরোধীদের চাপের মুখে সুষমাকে বরখাস্ত করতে নারাজ মোদী। তাই বিদেশমন্ত্রীরও পাশে দাঁড়িয়ে জেটলি আজ বলেছেন, ‘‘সমস্ত অভিযোগ ভিত্তিহীন। সুষমা একেবারেই সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে (ললিত মোদীকে) সাহায্য করেছিলেন। দল ও সরকার একজোট হয়ে তাঁর পাশে রয়েছে।’’

কিন্তু এর পরেও কথার প্যাঁচে গোটা ঘটনার দায় সুষমার ঘাড়ে চাপিয়েছেন জেটলি। তাঁকে যখন প্রশ্ন করা হয়, ললিতকে সাহায্য করার আগে সুষমা কি প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি নিয়েছিলেন? তখন জেটলির জবাব, ‘‘আমাদের মন্ত্রীরা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম। সেই সিদ্ধান্তের সামগ্রিক দায় সরকারের।’’ বিজেপির একটি সূত্রের মতে, এই মন্তব্যের মধ্যে দিয়ে জেটলি বোঝাতে চাইলেন যে ললিতকে ট্র্যাভেল ডকুমেন্ট পেতে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত সুষমার একার। অন্য সূত্রের অবশ্য ব্যাখ্যা, প্রশ্নটা যখন ছিল প্রধানমন্ত্রীকে জড়িয়ে, তখন এ ছাড়া আর কী জবাবই বা দিতে পারতেন জেটলি। তিনি যদি বলতেন যে মোদীর সম্মতি নিয়েই এগিয়েছিলেন সুষমা, তা হলে তো খোদ প্রধানমন্ত্রীকেই সরাসরি গোটা ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে ফেলা হতো! আর সেই সুযোগ নিয়ে আরও বাজার গরম করত বিরোধীরা।

বস্তুত গত কাল রাহুল গাঁধী রীতিমতো উত্তেজিত স্বরে মোদীকে আক্রমণ করার পরে আজ প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সুর আরও চড়িয়েছে কংগ্রেস। দলের তরফে আনন্দ শর্মা আজ বলেন, ‘‘কাউকে ভিসা পাইয়ে দেওয়ার মধ্যে বিষয়টি সীমাবদ্ধ নয়। সরকারের শীর্ষ সারিতে এমন কিছু নেতা আছেন, ক্রিকেট রাজনীতিতে যাঁদের সঙ্গে ললিত মোদীর আঁতাঁত ছিল। এক জন পলাতক অভিযুক্তকে সাহায্য করতে সরকারের মধ্যে একটা চক্র তৈরি হয়েছে। তাই সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে বিশেষ তদন্তকারী দল গড়ে এর তদন্ত হওয়া উচিত।’’ এই আক্রমণের পরেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহকে পাশে নিয়ে সাংবাদিক বৈঠক করেন জেটলি।

বিজেপি সূত্রের মতে, প্রধানমন্ত্রীকে আড়াল করে কার্যত যাবতীয় দায় সুষমার উপরেই চাপিয়ে রাখলেন জেটলি। এর পর জল কোন দিকে গড়ায় তা দেখে সুষমা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

কিন্তু এর মধ্যে আবার বসুন্ধরার নাম জড়িয়ে যাওয়ায় গোটা বিষয়টি যে আরও জট পাকিয়ে গেল, তা কবুল করছেন বিজেপি নেতারা। বসুন্ধরার বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজস্থানের বিরোধী দলনেত্রী থাকাকালীন ২০১১ ও ২০১৩ সালে মোট দু’বার ব্রিটিশ অভিবাসন দফতরের কাছে ললিত মোদীর হয়ে গোপনে সাক্ষ্য দেন তিনি। অথচ প্রথম বারই যখন বসুন্ধরা ললিতের হয়ে সওয়াল করেছিলেন বলে সংশ্লিষ্ট নথির দাবি, তখনই প্রাক্তন আইপিএল-কর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত শুরু হয়ে গিয়েছে।

ললিত মোদীর আইনজীবীর পাঠানো নথি অনুসারে তাঁর সাক্ষ্যের বিষয়টি ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে গোপন রাখার শর্ত জুড়েছিলেন বসুন্ধরা। আর সেই সূত্রে বিজেপির দীর্ঘলালিত জাতীয়তাবাদী ভাবমূর্তিকে আঘাত করার চেষ্টা করেছে কংগ্রেস। দলের নেতা দিগ্বিজয় সিংহের কটাক্ষ, ‘‘এই ধরনের বোকামি বসুন্ধরা রাজের কাছ থেকে প্রত্যাশা করা যায় না! এক জন মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি প্রশাসনের কাছ থেকে তথ্য গোপন করতে চান, এটা কোন ধরনের জাতীয়তাবাদী মনোভাব?’’

এহেন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বিজেপির পক্ষে স্বস্তির কথা হল, ট্র্যাভেল ডকুমেন্ট পাওয়ার ক্ষেত্রে ইউপিএ আমলের তিন মন্ত্রী শরদ পওয়ার, প্রফুল্ল পটেল এবং রাজীব শুক্লের সাহায্যও পেয়েছেন বলে আজ দাবি করেছেন ললিত। এনসিপি-র দুই নেতা পওয়ার এবং পটেলের প্রতিক্রিয়া পাওয়া না গেলেও কংগ্রেস নেতা রাজীব শুক্ল অস্ট্রেলিয়া থেকে ফোনে সংশ্লিষ্ট টিভি চ্যানেলের কাছে দাবি করেন, ললিত তাঁর কাছ থেকে কোনও সাহায্য চাননি। তিনিও কোনও সাহায্য করেননি। শুক্লর কথায়, ‘‘সবটাই ফালতু কথা। গত চার-পাঁচ বছর ললিতের সঙ্গে আমার কোনও যোগাযোগই নেই।’’

বিজেপি সূত্র বলছে, ইউপিএর বিরুদ্ধে লাগাতার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তোলা ললিত সেই আমলের মন্ত্রীদের নাম জড়াবেন, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু বসুন্ধরা রাজের সঙ্গে দীর্ঘদিনের পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও তাঁর আইনজীবী কেন আগ বাড়িয়ে এমন নথি সংবাদমাধ্যমের হাতে তুলে দিলেন, সেটাই বিস্ময়ের। বসুন্ধরা ও সুষমার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক বোঝাতে ললিত এ দিন দাবি করেছেন, ‘‘আমার স্ত্রীর অসুস্থতার সময় বসুন্ধরা ও সুষমা আমাকে সাহায্য করেছেন। বসুন্ধরা আমার স্ত্রীকে সঙ্গে করে পর্তুগালে নিয়ে গিয়েছিলেন চিকিৎসার জন্য।’’

গত রাজস্থান বিধানসভা ভোটের আগেও একেবারে খোলাখুলি বসুন্ধরার সমর্থনে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ললিত। রাজনৈতিক সমীকরণে দু’জনেরই শত্রু অরুণ জেটলি। নির্বাচনের ঠিক আগে ললিত টুইটে বসুন্ধরাকে সাবধান করে বলেন, ‘‘নির্বাচন এসে গিয়েছে। কিন্তু জেটলি ও ভূপেন্দ্র যাদবের মতো বিজেপির কিছু নেতা টাকার বিনিময়ে টিকিট বিক্রি করছে। এটাই এখন বিজেপির মন্ত্র। দুঃখজনক।’’ এর কয়েক দিন পরেই অন্য টুইটে সরাসরি বসুন্ধরাকে তিনি বলেন, ‘‘সাবধান। জেটলির ডান হাত ভূপেন্দ্র ও তোমার লোক ধীরেন্দ্র কামথান টাকার বিনিময়ে টিকিট বিক্রি করছে।’’

এর পরে এমন কী ঘটল যে বসুন্ধরাকেই কোণঠাসা করার কাজে নামলেন ললিত! রাজস্থানের বিজেপি নেতাদের একাংশ বলছেন, বসুন্ধরা দ্বিতীয় বার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে দু’জনের সম্পর্কে চিড় ধরতে শুরু করে। ললিত মোদী যে ভাবে চাইছিলেন, সে ভাবে রাজ্যে তাঁর ব্যবসায়িক স্বার্থরক্ষা হচ্ছিল না। ফলে তাঁর গলায় শোনা যেতে থাকে বসুন্ধরার সমালোচনা। বসুন্ধরার পরিবর্তে ওম মাথুরকে মুখ্যমন্ত্রী করা উচিত ছিল বলেও মন্তব্য করেন ললিত। সেই ফাটলই আজ চূড়ান্ত আকার নিল, বলছেন রাজস্থানের বিজেপি নেতারা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE