Advertisement
০৯ মে ২০২৪

গব্বরের ডেরার কাছে ক্রেনে এল যশের মালা

সাড়ে চার দশক আগে এই এলাকাতেই তৈরি করা হয়েছিল শোলের রামগড় গ্রাম আর গব্বর সিংহের ডেরা।

সিনেমায় যেমন হয়: সুমালতার হয়ে প্রচারে কন্নড় তারকা যশ। —নিজস্ব  চিত্র।

সিনেমায় যেমন হয়: সুমালতার হয়ে প্রচারে কন্নড় তারকা যশ। —নিজস্ব চিত্র।

সুব্রত বসু
রামনগর শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০১৯ ০৩:৩৯
Share: Save:

এই পাথরের পাশে বাসন্তীর নাচের কথা মনে পড়লে এখনও গায়ে কাঁটা দেয় ৭০ বছরের রামাইয়ার। দক্ষিণী উচ্চারণে গেয়ে ওঠেন, ‘যব তক হ্যায় জান....।’ ফোকলা মাড়িতে হেসে শোনান ডায়লগ, ‘চল্ ধন্নো, আজ তেরি বাসন্তী কা ইজ্জত কা সওয়াল হ্যায়... ’

হিন্দি ভাষাটা ততটা রপ্ত হয়নি তো কী, বার তিনেক পর্দায় দেখে ফেলেছেন জয়, বীরু, গব্বরকে।

সাড়ে চার দশক আগে এই এলাকাতেই তৈরি করা হয়েছিল শোলের রামগড় গ্রাম আর গব্বর সিংহের ডেরা। রামাইয়াদের মতো অনেকেই তখন সারাদিন এখানে বসে শুটিং দেখতেন। পরে শোলে এখানের সিনেমা হলে দেখানো হয়। ভাষা সবটা না বুঝলেও রামাইয়ার মতো অনেকেই তখন থেকে অমিতাভ, ধর্মেন্দ্রর ভক্ত।

বেঙ্গালুরু থেকে মহীশূর রোড ধরে পঞ্চাশ কিলোমিটার এগোলেই রামনগর। ছোট এই এলাকার খ্যাতি রেশম-শিল্পের জন্য। যে কেউ দেখিয়ে দেবেন জাতীয় সড়ক থেকে ভিতরে রামগড় গ্রাম। আর সেখানেই এক বুক স্মৃতি নিয়ে বসে রয়েছেন রামাইয়ার মতো প্রবীণেরা।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

ভারতীয় ফিল্মের অন্যতম সেরা ব্লক-ব্লাস্টারের এই পটভূমিকাতেই কর্নাটক লোকসভা নির্বাচনের সব চেয়ে বড় তারকা-যুদ্ধটি হচ্ছে, কিছুটা দূরের মান্ডিয়া কেন্দ্রে। এখানে লড়াইয়ে মুখোমুখি দুই তারকা। আর তাঁদের জন্য প্রচারে নেমে পড়েছেন কন্নড় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির মহাতারকারা।

কী রকম?

জাতীয় সড়ক ধরে আরও ৩০ কিলোমিটার এগোতেই রাস্তায় বিশাল যানজট। গাড়ির চালক জানালেন, প্রচারে এসেছেন কন্নড় ফিল্মের একনম্বর তারকা যশ। কেজিএফ (হিন্দি ভার্সন-সহ) মুক্তি পাওয়ার পরে নতুন প্রজন্মের কাছে যশ এখন কর্নাটকের সলমন খান।

গাড়ি থেকে নেমে এগোতেই যে দৃশ্য চোখে পড়ল, তাতে যে কোনও বঙ্গসন্তানের চোখ কপালে উঠতে বাধ্য। একটি ট্রাকের মতো গাড়ির উপরে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে কন্নড় মহাতারকা। তাঁর মাথার উপরে ক্রেন দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে অতিকায় মালা। ক্রেন ধীরে ধীরে অতিকায় মালাটা নামিয়ে আনছে যশের দিকে। চলছে পুষ্পবৃষ্টি। মালাটি যশের চারদিকে ঝুলে থাকার পরে একজন তাঁর হাতে ধরিয়ে দিলেন মাইক। যশ বললেন, “এখানকার প্রার্থী আমার মা। আমি তাঁর ছেলের মতো। তাই তাঁর হয়ে প্রচারে এসেছি।”

যশ প্রচার করতে এসেছেন মান্ডিয়ার নির্দল প্রার্থী, আর এক তারকা সুমালতা অম্বরীশের হয়ে। সুমালতার বয়স ৫৬। দেখলে মুনমুন সেনের ‘গ্ল্যামার’ মনে পড়তে বাধ্য। তবে অভিনেত্রী হিসেবে সুমালতার পরিচিতি মুনমুনের চেয়েও বেশি। কন্নড়, তেলুগু, মালয়ালম এবং তামিল মিলিয়ে তাঁর ছবির সংখ্যা ২২০টির মতো। স্বামী প্রয়াত এমএইচ অম্বরীশও ছিলেন কন্নড় ফিল্মের তারকা। পরে তিনি কংগ্রেসে যোগ দিয়ে মনমোহন সিংহের প্রথম দফায় সেচ-প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন। তামিলনাড়ুর সঙ্গে কাবেরীর জল বিতর্কের সময়ে তিনি মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেন। গত বছর নভেম্বরে তাঁর শেষযাত্রায় লাখো মানুষ পথে নেমেছিলেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়েরা।

কংগ্রেসের সঙ্গে জেডি(এস)-এর জোট হওয়ার পরেও যে সব জায়গায় কর্মীরা আকচা-আকচি করছেন, মান্ডিয়া তার মধ্যে অন্যতম। জোটের ভাগাভাগিতে কেন্দ্রটি পড়েছে জেডি(এস)-এর ভাগে। জেডি(এস)-ও প্রার্থী করেছে কন্নড় ফিল্মের নতুন হিরো নিখিল দেবগৌড়াকে। তিনি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এইচডি দেবগৌড়ার নাতি, মুখ্যমন্ত্রী কুমারস্বামীর ছেলে। কিন্ত কংগ্রেসের একাংশ এই কেন্দ্রে জেডি(এস)-প্রার্থীকে মানতে রাজি হয়নি। তাঁরাই নির্দল হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন সুমালতাকে।

বিজেপি গত পাঁচ মাস আগের উপনির্বাচনে এখানে শোচনীয় ভাবে হেরেছে। এ বার দুই জোটসঙ্গীর কাজিয়া দেখে তারা কাউকে প্রার্থী করেনি। নেপোকে দিয়ে দই মারার কৌশলে তারা সমর্থন করছে সুমালতাকেই। রাজ্য বিজেপির অন্যতম মুখপাত্র শ্রীধর বলেন, “বিক্ষুব্ধ কংগ্রেস, আমাদের নিজেদের ভোট, সুমালতার তারকা ভাবমূর্তি ও স্বামীর সহানুভূতি ভোট মিলিয়ে এই আসন ছিনিয়ে নিতে পারব।” সুমালতাও বলছেন, ‘‘মান্ডিয়া নিয়ে আমার স্বামীর অনেক স্বপ্ন ছিল। সব তিনি করে যেতে পারেননি। সেই স্বপ্ন পূরণের জন্যই ভোটে দাঁড়িয়েছি।” বিজেপি পিছনে থাকায় সুমালতার হয়ে প্রচারে নেমে পড়েছেন আর এক কন্নড় মহাতারকা দর্শন থুগুদীপ। তিনিও ভোট চাইছেন ‘সুমালতা আক্কা’(দিদি)-র হয়ে।

রামনগরে গিয়ে শোলের শুটিংয়ে সময়ে বলিউডের অনেক তারকাকে দেখেছিলেন সেই সময়ের তরুণ-যুবকেরা। প্রায় ৪৪ বছর পরে ফের তাঁদের হাতের সামনে ঘুরছেন কন্নড় মহাতারকারা। এলাকার যুবক মঞ্জুনাথ এম বলেন, ‘‘নিখিল-সুমালতা তো আছেনই। এ ছাড়াও রোজই কোনও না কোনও ফিল্মস্টার আসছেন। সবার ছবি তুলছি।”

কিন্তু ভোট? পুরনো মহীশূর অঞ্চলের এই এলাকা বহুকাল ধরেই ভোক্কালিগাদের (দেবগৌড়ার সম্প্রদায়) গড় বলেই পরিচিত। রাজ্য জেডি(এস)-এর সাধারণ সম্পাদক নারায়ণ রাও বলেন, “এত দিন কংগ্রেসের সঙ্গেই আমাদের লড়াই ছিল। বিজেপি এখানে নেই বললেই চলে। এখন জোট হওয়ায় নিজেদের মধ্যে সমস্যা আছে ঠিকই। কিন্তু তাতে ফলাফলের হেরফের হবে না। কংগ্রেসের ভোট না পেলেও নিজেদের দমেই আমরা জিতব।”

তবে মুখে না মানলেও নিজেদের গড়েই জেডি(এস) যে বেশ চাপে আছে তা এলাকার নেতাদের সঙ্গে কথা বললেই বোঝা যায়। তাঁরা বলছেন, সুমালতার হয়ে যে এত মহাতারকা প্রচারে নেমে পড়বেন, তা আগে আঁচ করা যায়নি। এতেই সমস্যা হয়েছে।

তাই শেষ পর্যন্ত জাতের ব্রহ্মাস্ত্র হাতে ময়দানে নামতে হয়েছে ৮৬ বছরের পিতামহকেই। মান্ডিয়ার ভোক্কালিগা সম্প্রদায়ের ভোট এককাট্টা করতে নিজের কেন্দ্র টুমকুরের পাশাপাশি এখানেও নাতির হয়ে প্রচার করছেন দেবগৌড়া। কারণ, মান্ডিয়ার তারকা-যুদ্ধে জয়ই তাঁর কাছে ‘ইজ্জত কা সওয়াল।’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE