এ যেন এক মুখের আড়ালে অনেক পরিচয়!
খোলা আকাশের নীচে তাঁর চায়ের দোকান। দোকান বলতে সাজানো কয়েকটা ইট। ইটের উপরে একটা কাঠের কাঠামো। সেই কাঠামোতেই তিনি বসেন। কাছেই কাচের গ্লাসের ঝনঝন শব্দ। এক দিকে, তাঁর ব্যস্ত হাত খদ্দের সামলাচ্ছে। চা বানানোর পাশাপাশি তা পরিবেশনও করছেন সযত্নে । সঙ্গে চলে গ্লাস ধোয়া-মোছার কাজও। অন্য দিকে, সময় মতো সেই হাতেই দৌড়চ্ছে কলম।
রাজধানীর রাজপথে খোলামেলা একটি চায়ের দোকানের মালিক এই লক্ষ্ণণ রাও। একমাত্র কর্মচারীও তিনি। পাশাপাশি হিন্দি সাহিত্যের এক জন লেখকও লক্ষ্ণণ রাও। দোকানের একপ্রান্তে রাখা তাঁর লেখা একগুচ্ছ বই। কেননা, মালিক-কর্মচারী ‘কনসেপ্ট’-এর মতোই লক্ষণ রাওয়ের বইয়ের প্রকাশক এবং বিক্রেতা যে তিনিই!

একপ্রান্তে চায়ের দোকান আরেক প্রান্তে বইয়ের দোকান লক্ষণ রাওয়ের।
১৯৭৫-এ মহারাষ্ট্রের এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে দিল্লি চলে এসেছিলেন লক্ষ্ণণ। একটাই স্বপ্ন, লেখক হবেন। হিন্দি বইয়ের প্রকাশক হাব দিল্লি। তাই হিন্দিতে স্নাতক লক্ষণ রাও, ডিসট্যান্স কোর্সে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। অনেক প্রকাশককে তিনি নিজের বই দেখিয়েছেন। তাঁর বই অনেকের ভালও লেগেছে। কিন্তু, পথের ধারের চা দোকানির বই আজ পর্যন্ত কেউ প্রকাশ করতে বা পরিবেশন করতে সাহস করেননি। বরং প্রকাশকেরাই উল্টে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করছেন। ১৯৭৯-তে তাই নিজেই নিজের বই প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন। নিজেই একটা বই প্রকাশনা সংস্থাও খুলে ফেলেন। ‘নয়ি দুনিয়া কি নয়ি কহানি’ নামে নিজের প্রথম বই প্রকাশ করেন।
আরও পড়ুন- স্মৃতির ফাউল কাটলেট ফেরাতে তালিম রেলের রাঁধুনিদের
গুলশন নন্দ থেকে শেক্সপিয়র সবই তাঁর পছন্দের। নাটক থেকে শুরু করে উপন্যাস— সব কিছুই লেখেন লক্ষণ। মূলত বাস্তব জীবনের ছোট ছোট মুহূর্তই তাঁর বইয়ের উপজীব্য। সবের ভিতরেই থাকে রাজনীতির ছোঁয়া। ১৯৮৪তে প্রবীণ এক কংগ্রেস নেতা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীকে রাওয়ের কথা বলেন। আর তার পরেই প্রধানমন্ত্রী দফতরে ডাক পড়ে এই লেখকের। ইন্দিরা গাঁধীকে নিয়ে বই লেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেন লক্ষণ। প্রধানমন্ত্রী সে ইচ্ছায় অভিভূত হয়ে রাওকে লেখার নির্দেশ দেন। লেখক একটা প্রবন্ধও লিখে ফেলেন। কিন্তু, সে প্রবন্ধ দেখার আগেই ইন্দিরাজি মারা যান। ইন্দ্রপ্রস্থ সাহিত্য পুরস্কারও তিনি পান।

লেখক লক্ষণ রাওয়ের বই।
চায়ের দোকানে তিনি যেমন নিজের লেখা বই বিক্রি করেন, তেমনই সাইকেল নিয়ে এ দিক সে দিক ঘুরেই নিজের বইয়ের প্রচার করে থাকেন লক্ষণ। তাঁর কথায়, ‘‘লেখকেরা নিজেদের বইয়ের প্রচারের জন্য কেউ টেলিভিশন চ্যানেলের অফিসে সিরিয়ালের জন্য পাঠান। কেউ আবার সিনেমা পরিচালকদের কাছে পাঠান। আমি এক জন সাধারণ মানুষ। ফুটপাথেই আমাকে মেল পাঠান আমার পাঠকেরা। স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে আমার বই সাজানো থাকে। এর থেকে বড় পাওনা এক জন লেখকের কাছে আর কী হতে পারে?’’
বর্তমানে আমাজন থেকে ফ্লিপকার্ট সব জায়গাতেই তাঁর বই পাওয়া যায়।