খনিগর্ভে নামছেন নৌসেনার জওয়ানরা। ছবি: এএফপি
চিরাঙের ভাঙনামারি গ্রামে এখন লোক আসছেন সাহেব আলিকে দেখতে। গত ১৩ ডিসেম্বর কসানে খনি গহ্বর থেকে যে পাঁচ জন শ্রমিক উঠে আসতে পেরেছিলেন, তাঁদের এক জন সাহেব। ২১ বছরের ওই যুবকের কাজ ছিল, কয়লা ক্রেনের উপরে তুলে আনা। বলেন, ‘‘প্রথম ধাপের সুড়ঙ্গে নামতেই তলা থেকে হু হু করে জলের শব্দ শুনতে পেলাম। আমার সঙ্গে আরও চার জন ছিল। ভাগ্য ভাল, একটা মোটরপাম্পের দড়ি সামনে পেয়ে সেটা ধরেই ওপরে উঠতে থাকি।’’
দড়ি বেয়ে উপরে ওঠার সময়েই সাহেবরা দেখেন, শ্রমিকদের নিয়ে ট্রলি নামছে। ট্রলিটি আর ফেরেনি। চেঁচিয়ে ডাকতে তো পারতেন ওঁদের। সাহেব উত্তর দেন না। তখন বাঁচার তাগিদে বাঁচানোর কথা মনে হয়নি হয়তো। আর চেঁচালেও বাঁচানোর উপায় ছিল না। বেআইনি খনিতে ট্রলির দড়ি ধরে খাড়া নামিয়ে দেওয়া হয়। মাঝপথে ট্রলি থামিয়ে উঠিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। তাই সাহেবরা বাঁচলেন। ট্রলির শ্রমিকরা নিখোঁজ।
সাহেবের মা সরিতা বিবি বলেন, ‘‘দুর্ঘটনার তিন দিন আগেই ছেলে ফোনে বলছিল, কাজটা কত ঝুঁকির। ওকে বলেছিলাম, টাকার চেয়ে জান বড়। তুই ফিরে আয়। ও কথা শোনেনি। আল্লার অসীম দয়া যে ছেলেকে ফিরে পেয়েছি। আর ওকে যেতে দেব না।’’
সরিতার বড় ছেলে সইজল রহমানও খনিতে কাজ করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু বিয়ের পরে আর যাননি। মায়ের ইচ্ছে, সাহেবও দাদার মতোই আশপাশে কাজ খুঁজে নিক। কিন্তু দাদার তেমন রোজগার নেই এখানে। সাহেব বলে, ‘‘চোখের সামনে মৃত্যুকে দেখেছি। মনে হয়েছিল, আর কখনও ফিরব না। কিন্তু এখানে জমি নেই, কাজ নেই। মনে হচ্ছে কাজ করতে ফের মেঘালয়েই যেতে হবে।’’
সাহেবই জানান, অসমের চিরাং ও আশপাশের অনেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই মেঘালয়ের বেআইনি খনিতে শ্রমিক হয়ে যান। ওখানকার খনি চলছে মূলত বাংলাভাষী মুসলিম শ্রমিকদের উপরে ভর করে। তাঁদের অধিকাংশ আসেন পশ্চিম গারো পাহাড় ও অসমের সংখ্যালঘু গ্রাম থেকে। দালালদের মাধ্যমে আসেন বাংলাদেশের শ্রমিকও। ২০১২ সালে পশ্চিম গারো পাহাড়ের নাঙালবিবরায় খনিতে আটকে পড়া ১৫ জনের দেহ আর উদ্ধার হয়নি। তাঁরা বাংলাদেশের। ফলে শোরগোল হয়নি এখানে। গারো পাহাড়ে কাজ করে আসা এক খনি শ্রমিক জানান, কখনও বিষাক্ত গ্যাসে, কখনও পাথরের চাঁই চাপা পড়ে বা কখনও লিফ্ট আছড়ে নীচে পড়ে মরছেন শ্রমিকেরা। দরিদ্র পরিবারের হাতে খনি মালিকই টাকা গুঁজে দেন। ফলে থানা-পুলিশ-প্রেস হওয়ার প্রশ্ন নেই। এবার এত জন নিখোঁজ হওয়ায় এবং তাঁদের মধ্যে স্থানীয় তিন জয়ন্তিয়া শ্রমিক থাকায় ঘটনা সামনে এসেছে। গ্রেফতার হয়েছে খনির মালিক ক্রিপ সুলে। তবে শ্রমিকদের জোগাড় করে আনা মাইন-ম্যানেজার মহেশ পলাতক।
ভুটান সীমান্তঘেঁষা ভাঙনামারি গ্রাম বা পশ্চিম গারো পাহাড়ের রাজাবালা, মেন্দিপথারের মানুষরা অবশ্য চান না, ধরা পড়ুক মহেশ। কারণ, হাজারো পরিবারের একমাত্র রোজগেরে ছেলেটার হাতে দিনপ্রতি হাজার টাকা তুলে দিতে পারেন মহেশ। এবং মহেশের মতো দালালেরাই।
শুধু পেটের দায় নয়। রয়েছে ভয়ও। দালালেরা গ্রামে ইতিমধ্যে শাসিয়ে গিয়েছে, বেশি ছবি বা খবর বেরোলে পুলিশ গ্রামের লোককেই ধরবে। কারণ, বেআইনি খনিতে তো তাঁরাই কাজ করতে যাচ্ছেন। পেটের দায়ে মরণ-খনিই তো ভরসা। (শেষ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy