Advertisement
E-Paper

সেতু গড়েই বড়খলার উন্নয়নের স্বপ্ন কিশোরের

মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে বেরিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘‘জিতলে কোন কাজটা আগে করব, আর কোনটা পরে, তা বলা মুশকিল। পুরো বড়খলায় সমস্যা আর সমস্যা।’’ খুব টানাটানির মধ্যে যখন তাঁকে বিজয়ী ঘোষণা করা হল, তখনও ওই এক কথা তাঁর, ‘‘রাস্তাঘাট, পানীয় জল, বিদ্যুৎ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য — কোনটা যে আগে করব ভেবেই পাচ্ছি না।

উত্তম সাহা

শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:২৬

মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে বেরিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘‘জিতলে কোন কাজটা আগে করব, আর কোনটা পরে, তা বলা মুশকিল। পুরো বড়খলায় সমস্যা আর সমস্যা।’’

খুব টানাটানির মধ্যে যখন তাঁকে বিজয়ী ঘোষণা করা হল, তখনও ওই এক কথা তাঁর, ‘‘রাস্তাঘাট, পানীয় জল, বিদ্যুৎ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য — কোনটা যে আগে করব ভেবেই পাচ্ছি না। আমার ওখানে প্রতিটি জিনিসের চাহিদা একেবারে চূড়ান্ত পর্যায়ে।’’

তিন মাস পর ওই প্রশ্ন করা হলেও সুরবদল হয়নি বড়খলার বিজেপি বিধায়ক কিশোর নাথের। ‘‘এত সমস্যা! কোথা থেকে যে কাজটা শুরু করা! তাই এখনও যাঁরা যে সমস্যার কথা বলছেন সেটা নিয়েই ছোটাছুটি করছি। তবু একটা পরিকল্পনা তো করতেই হবে।’’

এ বার ছ’মাস পর আনন্দবাজার পত্রিকার কাছে প্রকাশ করলেন, কী তাঁর পরিকল্পনা। কোন ছকে এগোচ্ছেন তিনি।

তাঁর বসার ঘরে কাঁচে বাঁধা ফ্রেমে একটি ছবি। বরাক নদীতে নতুন এক সেতু। তাতে লেখা, ‘মাই ড্রিম বরাক রিভার।’ অর্থাৎ বরাক নদীকে ঘিরেই স্বপ্ন বা উন্নয়ন পরিকল্পনা বড়খলার বিধায়কের!

আনন্দবাজার পত্রিকাকে নতুন বিধায়ক জানান, বড়খলাকে কাছাড়ের প্রত্যন্ত এলাকা বলে মনে করার একটিই কারণ— বরাক নদী। ও পারের মানুষ জলপথে শিলচর শহরের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন। সেখানে একটি সেতুর বড় প্রয়োজন। আবার শুধু সেতু হলেই হবে না, উপযুক্ত জায়গায় সেতুটি তৈরি করা চাই। এত দিন অন্নপূর্ণাঘাট নাকি মধুরাঘাটে সেতু হবে, তা নিয়ে বিতর্কে সময় কেটেছে। কিশোরবাবুর ভাবনা, বড়খলার উন্নয়নের জন্য সেতু চাই তৃতীয় জায়গায়, তারাপুর শিববাড়ি এলাকায়।

তাঁর মতে, মধুরাঘাটের মানুষের দাবি মেটাতে একটি সেতু তৈরি হয়েই রয়েছে। অ্যাপ্রোচ বের করে দিলে সেটি করাতিগ্রাম দিয়ে সদরঘাট হয়ে শহরের সঙ্গে যুক্ত হবে। অ্যাপ্রোচের জমি নিয়ে তিনি মধুরামুখের জমিমালিকদের সঙ্গে কথা বলছেন। করাতিগ্রামের দিকে রাজি করাচ্ছেন উধারবন্দের বিধায়ক মিহিরকান্তি সোম। পরে ক্ষতিপূরণের জন্য জেলাশাসকের সঙ্গে আলোচনা করবেন। একে সমস্যা বলে মনে করছেন না কিশোর নাথ।

অন্য দিকে, শিববাড়িঘাট আর অন্নপূর্ণাঘাটে খুব একটা দূরত্ব নেই। শিববাড়িঘাটে সেতু তৈরি হলে অন্নপূর্ণাঘাট নিয়ে কারও দাবি-আপত্তি থাকবে না। বরং শিববাড়িঘাটে সেতু হলে টিআরকে সড়ক ও ইস্ট-ওয়েস্ট করিডরকে জুড়ে দেওয়া সম্ভব হবে। তাতে যান-চাপ কমবে তারাপুর, ট্রাঙ্ক রোড, রংপুরের মত পুরএলাকার। আন্তঃরাজ্য দুই বড় সড়ক করিডরে যুক্ত হলে বড়খলায় শিল্প-কারখানা তৈরির আগ্রহ দেখা যাবে। বড়খলা আসনের বিভিন্ন এলাকাতেও সে সময় বহুতল আবাসন হবে, হবে শপিং মল। বাড়বে কর্মসংস্থানের সুযোগ। শহর সম্প্রসারিত হবে দুধপাতিল পর্যন্ত।

সেতুতে শুধু যাতায়াত ও যোগাযোগের কথা ভাবছেন না বলে জানান নতুন বিধায়ক। তিনি বলেন, ‘‘বরাকের পুরো তীর বরাবর শিববাড়িঘাট থেকে সদরঘাট পর্যন্ত রিভার ট্যুরিজম প্রজেক্ট হাতে নেওয়া হবে। নদীতীর বরাবর আলো জ্বলবে। বিকেলে প্রবীণরা সেখানে হাঁটবেন, শিশু-কিশোররা খেলাধূলা করবে। হবে অ্যাকুয়া পার্ক, পার্কিং হাব। থাকবে মোটর বোট, স্পিড বোট।’’ শিলচর শহরও তাতে যুক্ত হবে বলে তিনি তাঁর স্বপ্নপূরণে ডেপুটি স্পিকার দিলীপকুমার পালের সহযোগিতা পাবেন বলে আশাবাদী।

কিশোরবাবু জানান, ২১ পঞ্চায়েত নিয়ে বড়খলা বিধানসভা কেন্দ্র। এমন কোনও পঞ্চায়েত নেই, যেখানে রাস্তাঘাট ভালো, বিদ্যুতও রয়েছে, মেলে বিশুদ্ধ পানীয় জল। অধিকাংশ জায়গায় নতুন রাস্তার প্রয়োজন। অর্ধেক এলাকায় বিদ্যুতের ব্যবস্থা হয়েছে। জলের হাহাকার সর্বত্র। তার উপর বেকারি।

তাঁর ইচ্ছা, ওই সব সমস্যাতেও তিনি সমান মনোযোগী হবেন। দামছড়া, বান্দরখালের মতো জায়গায় বিদ্যুতের লাইন টানা মুশকিল। সে সব গ্রামে সৌরবিদ্যুৎ জ্বালাবেন। চন্দ্রনাথপুরে রেললাইন ধরে চলাচল করেন তিন হাজারের বেশি মানুষ। কোনওদিন কোনও রাস্তা তৈরি হয়নি। সেখানে এ বার সমীক্ষা করা হয়েছে। মিটারগেজের ট্র্যাক তুলে নেওয়া পরিত্যক্ত সুড়ঙ্গটিকে রেল পাকাপাকি ভাবে ব্যবহারের সুযোগে রাস্তা নির্মাণে কোনও সমস্যা নেই। সুড়ঙ্গ ব্যবহার নিয়ে রেলকর্তাদের সঙ্গে কথা বলছেন তিনি। চন্দ্রনাথপুর চা বাগানের ম্যানেজার বাকি রাস্তার জন্য জমি ছাড়তে তৈরি রয়েছেন বলে কিশোরবাবু জানিয়েছেন।

তিনি জানিয়েছেন, বড়খলা-হরিণছড়া-সোনাছড়া রাস্তারও সমীক্ষা করা হয়েছে। সমীক্ষা হয়েছে দামছড়া-কাতলাছড়া-সাবাসপুর সড়কেরও। শ্রীকোণার সুরতারায় ফেরিঘাটের কাজ চলছে। বাজার হয়ে স্টেশনে যাওয়ার রাস্তা ভোটে জেতার ৩ মাসের মধ্যে তৈরি করে দিয়েছেন বলে দাবি করেন কিশোরবাবু। রাস্তা নিয়ে তাঁর আরও পরিকল্পনা, দুধপাতিলে ডাবল লেন রাস্তা হাতিছড়া পর্যন্ত যাবে। তাঁর স্বপ্ন, বড়খলার কোনও মা-বোন জল সংগ্রহে কলসী-বালতি নিয়ে রাস্তায় বেরোবেন না। প্রতিটি বাড়িতে কলে জল পড়বে। তাও সম্পূর্ণ পানীয় জল। বর্তমান শোধন ব্যবস্থা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে কিশোরবাবু জানান, জল তোলা হবে নদীর ঠিক মাঝখান থেকে।

ভোটের আগে বিজেপির নেতা-কর্মীদের একাংশ জানতেন, বড়খলায় পুরনোদের সঙ্গে এক জন নতুন দাবিদারও রয়েছেন। তবে সে ভাবে কেউ গুরুত্ব দেননি তাঁকে। কবীন্দ্র পুরকায়স্থের ছেলে কণাদ যেখানে অনেক দিন থেকে কাজ করছেন, সেখানে আর কারও আশা করা বৃথা। সাধারণ মানুষ কিশোর নাথের নাম জানতে পারেন নির্বাচন ঘোষণার মাত্র কিছু দিন আগে। তত দিনে সাংগঠনিক লড়াইয়ে কিশোর-কণাদ প্রায় বরাবর। প্রার্থিত্ব ঘোষণার পর দেখা যায়, নেতৃত্বের কাছে কণাদকে ছাড়িয়েই কিশোরের গ্রহণযোগ্যতা।

অনেক দিন এলাকা ছেড়ে বাইরে ছিলেন কিশোরবাবু। অরুণাচল প্রদেশে ব্যবসা করেছেন। ফিরে এসে খুব বেশি দিন সময় পাননি। বলতে হয় ভাগ্য ভাল। টিকিটের অনিশ্চয়তা কাটিয়ে ভোটে লড়লেন। গণনায় শুরু থেকে একেবারে প্রায়-শেষ পর্যন্ত পিছিয়েই ছিলেন কিশোরবাবু। শেষ বুথের গোনায় দেখা যায়, নির্দল মিসবাহুল ইসলাম লস্করকে মাত্র ৪২ ভোটে হারিয়ে দিয়েছেন।

ব্যবধান যাই হোক, ৩৬ হাজার ৪৮২ জন ভোটারের সমর্থন, সে কি কম কথা! তাও বিপক্ষে যখন প্রাক্তন মন্ত্রী মিসবাহুল ইসলাম লস্কর ও তখনকার সংসদীয় সচিব রুমি নাথ! কিশোরবাবু বলেন, ‘‘আসল কাজটা হয়েছে এনআরসি-র ফর্ম পূরণের সময়। অন্যরা যখন শুধু পরামর্শ দিয়েছে, সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন, আমি তখন গোটা এলাকা চষে বেরিয়েছি।’’ তাঁর মন্তব্য, ‘‘সার্বিক নয়, মানুষের ব্যক্তিগত সমস্যার জায়গাগুলি মিটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। প্রথমে শুধু নিজের গাড়িতে ল্যাপটপ রাখতাম। এলাকার বহু মানুষ ফর্ম পূরণ করতে জানেন না। কী কী নথি দিতে হবে, সে নিয়ে বিভ্রান্তিতে ছিলেন। দালালরা সে-সবের জন্য মোটা টাকা দাবি করতেন। আমি নিজে ফর্ম পূরণ করতাম। ল্যাপটপের সাহায্যে অনলাইনে ফর্ম জমা করতাম। এক ল্যাপটপে যখন কুলোনো যাচ্ছিল না, তখন আরও ৪-৫ বিজেপি নেতাকে ল্যাপটপ কিনে দিয়ে একইভাবে সাহায্য করতে বলি।’’

তাঁর দাবি, শুধু জেতার জন্য কিছু দিন কাজ দেখিয়েছেন, তাঁর কাছে ব্যাপারটি এমন নয়। তিনি মনেপ্রাণে কাজ করতে চান। তাঁর কথায়, ‘‘২০ বছর আগে মিসবাহুল ইসলাম ধুমকরে সেতুর জন্য পিলার বসিয়েছিলেন, সেতু আর হয়নি। রুমি নাথ পরে সেখানে ৮০ লক্ষ টাকার কাজের শিলান্যাস করেছিলেন।’’ তিনি জানান, এর পরও সেখানকার মানুষকে ৪০ মিটার বাঁশের সেতু দাবি করতে হয়। পাকা সেতুর আশা মানুষ ছেড়ে দিয়েছেন। আপাতত চলাচলের জন্য বাঁশের সেতু তৈরি করে দিলেও কিশোরবাবু পাকা সেতু নির্মাণকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন।

এমন আরও বহু চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় নিজের অঙ্গীকারের কথা শোনান বড়খলার বিধায়ক কিশোর নাথ। তাঁর আশা, দেখিয়ে দেবেন, এক জন বিধায়ক এলাকার জন্য কতটুকু কী করতে পারেন!

Bridge Shilchar
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy