সকালে সৌজন্য। বিমানবন্দরে মোদীকে স্বাগত জানাচ্ছেন নীতীশ। রয়েছেন বিহারের নতুন রাজ্যপাল রামনাথ কোভিন্দ। বেলা গড়াতেই অবশ্য শুরু হল ভোটের দ্বৈরথ। মঙ্গলবার পটনায়। ছবি: পিটিআই।
ম্যাচের শুরুতেই দুসরা। আর তাতে হইচই শুরু হয়ে গেল পটনা থেকে দিল্লি!
গত কাল রাতে দুবাই থেকে ফিরেছেন নরেন্দ্র মোদী। আজ সকালে যখন পটনায় তাঁকে স্বাগত জানাতে গেলেন নীতীশ কুমার, ঘুণাক্ষরেও জানেন না, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সরকারি মঞ্চ থেকে বিহারের জন্য বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করবেন প্রধানমন্ত্রী। গত পাঁচ-সাত বছর ধরে এই আর্থিক প্যাকেজই ছিল নীতীশের অন্যতম অস্ত্র। যে কোনও ভোটের আগে জেডিইউ নেতা তথা বিহারের মুখ্যমন্ত্রী তুলেছেন এই প্যাকেজের প্রসঙ্গ। প্রথমে দিল্লি গিয়ে দাবি জানাতেন। তার পরে পটনা থেকে সেই নিয়ে ‘কেন্দ্রের বঞ্চনার’ অভিযোগ তুলে নামতেন প্রচারে। ইউপিএ সরকারের বিরুদ্ধে এই অস্ত্র তিনি একাধিক বার ব্যবহার করেছেন। এখন তাঁর লক্ষ্য ছিল এনডিএ সরকার। কিন্তু ম্যাচের শুরুতেই তাঁর হাত থেকে সেই অস্ত্রটি কেড়ে নিলেন মোদী। এ দিন প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দিলেন, বিহারের জন্য সওয়া লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজ দিচ্ছে তাঁর সরকার। যেখানে রয়েছে সড়ক, পরিকাঠামো, শিক্ষা, কৃষি, বিমান থেকে শুরু করে ডিজিটাল প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ। যাকে ভোটের উপহার হিসেবেই দেখতে শুরু করেছে সকলে।
আরায় সরকারি অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকে ঘোষণাটিও মোদী স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে নাটকীয় ভাবেই করেছেন এ দিন। প্যাকেজের পরিমাণ নিয়ে আগাম কোনও ইঙ্গিত ছিল না। মোদী সভায় হাজির জনতাকে সঙ্গে নিয়ে ধাপে ধাপে উঠলেন এই লক্ষ-কোটির অঙ্কে। সেই মঞ্চে তখন উপস্থিত নীতীশ কুমারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ, রাজ্যের পূর্তমন্ত্রী রাজীব রঞ্জন ওরফে ললন সিংহ। মোদী বলতে থাকেন, অটলবিহারী বাজপেয়ীর সরকার বিহারকে ১০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ দিয়েছিল। সেই টাকার মধ্যে এক হাজার কোটি টাকা এখনও রাজ্য খরচ করতে পারেনি। মনমোহন সিংহের সরকারের কাছে বারবার চাওয়ার পরে ১২ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ মিলেছিল। কিন্তু সেই টাকার মধ্যেও আট হাজার কোটি টাকা খরচ করে উঠতে পারেনি নীতীশ-সরকার।
এর পরেই নীতীশকে প্রধানমন্ত্রীর খোঁচা, ‘‘অথচ তিনি (নীতীশ) এখন ৫০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ চাইছেন!’’ প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বলেন, ‘‘সংসদ চলছিল। তাই গত সফরে বিহার প্যাকেজ নিয়ে কিছু বলতে পারিনি। গত চার দিন হল সংসদ শেষ হয়েছে।’’ তা হলে কি বিহারকে প্যাকেজ দেবে কেন্দ্র? নাটকীয় কায়দায় এর পর হাজির জনতাকে মোদী বলেন, ‘‘টুকরো দিয়ে উন্নয়ন সম্ভব নয়। দিল্লির সরকার টুকরোর কথা ভাবছেই না। তা হলে কত টাকার প্যাকেজ দেওয়া উচিত? ৫০ হাজার কোটি? ৬০ হাজার কোটি? ৭০ হাজার কোটি?’’ জনতা তখন উচ্ছ্বসিত! মোদীর প্রশ্নের তালে তালে উত্তর দিতে শুরু করেছে তারা। শেষে বিহারের জন্য সওয়া লক্ষ কোটির প্যাকেজ ঘোষণা করেন মোদী। কয়েক মুহূর্ত সব চুপ! এর পরেই উঠে দাঁড়ান সভায় হাজির মানুষ। হাততালির ঝড় ওঠে। সভা শান্ত হলে মোদী জানান, এই প্যাকেজ সম্পূর্ণ নতুন প্রকল্পের জন্য। ৪০ হাজার ৭০০ কোটি টাকার চলতি প্রকল্পগুলি এই প্যাকেজের বাইরে। মঞ্চে তখন বজ্রাহতের মতো বসে আছেন ললন সিংহ।
এখানেই শেষ নয়। এরই পাশাপাশি, দিল্লিতে সেন্ট্রাল বোর্ড অব ডিরেক্ট ট্যাক্সেস (সিবিডিটি) এক বি়জ্ঞপ্তি জারি করে পটনা-সহ বিহারের ২১টি জেলাকে অনগ্রসর জেলা হিসেবে চিহ্নিত করে সেখানে লগ্নিকারীদের বিনিয়োগে উত্সাহিত করতে ১৫ শতাংশ বাড়তি আয়কর ছাড়ের কথা ঘোষণা করেছে। গত রাতেই বি়জ্ঞপ্তিটি জারি করা হয়েছে। পাঁচ বছরের জন্য এই কর ছাড় বলবত্ থাকবে বলে জানানো হয়েছে।
অথচ সকালে মোদী যখন পটনা বিমানবন্দরে নীতীশের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন, তখন এমন কিছুর আন্দাজ করতে পারেননি বিহারের মুখ্যমন্ত্রী। এর পর প্রধানমন্ত্রী রাজ্যপাল রামনাথ কোভিন্দকে সঙ্গে নিয়ে রওনা দেন ভোজপুরের জেলা সদর আরার দিকে। সেখানে ৯ হাজার ৭০০ কোটি টাকার ১১টি জাতীয় সড়ক নির্মাণ-সম্প্রসারণ প্রকল্পের কোনওটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন, কোনওটির উদ্বোধনের পরে শুরু করলেন তাঁর পরিকল্পিত বক্তৃতা। সরকারি অনুষ্ঠান হলেও যা দ্রুত বদলে গেল প্রচারের মঞ্চে। শুরুটা মোদী করলেন দু’লাইনের ঠেট ভোজপুরিতে। ব্যস, তাতেই উদ্বেল জনতা। ধীরে ধীরে আক্রমণের তির ঘুরিয়ে দিলেন বিহার সরকারের দিকে। তার পরে প্যাকেজ ঘোষণা। এবং সব শেষে নীতীশের জন্য ছুড়ে দিয়ে গেলেন কৌশলী কটাক্ষ: ‘‘এর পর উনি কী করবেন আমি জানি। কিছু সাংবাদিককে ডাকবেন। তাঁদের বলবেন, এ সব তো পুরানা কথা। নতুন কিছুই দিলেন না!’’
কার্যত সেটাই কিন্তু বললেন নীতীশ, পরে সাংবাদিকদের ডেকে। এই বিপুল ভেটের চাল সামলাতে তত ক্ষণে দিল্লি থেকে রাহুলের ফোন এসে গিয়েছে জনতা দল নেতৃত্বের কাছে। যে ফোনের পরে সেখানে সাংবাদিক বৈঠক করেন রাহুল। এ দিকে, নীতীশও অভিযোগ করেন, ‘‘৫০ হাজার... ৬০ হাজার— বিহারকে নিলামে তুলছেন নাকি!’’ তার পরে বলেন, ‘‘এমন মনে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী যেন দয়া করছেন! কেন্দ্র কোনও দয়া করছে না। রাজ্যের পাওনাই দিচ্ছে। অন্য সব রাজ্যকে দিয়েছেন। বিহারকেও দিচ্ছেন।’’ এবং পাল্টা কটাক্ষ, ‘‘এতে নতুন কী আছে? একটা মুরগিকে কতবার কাটবেন তিনি!’’
দিল্লিতে কংগ্রেস নেতৃত্ব বলছেন, মোদীর ‘উপহারের’ তালিকায় সবই কিন্তু নতুন নয়। একাধিক পুরনো, এমনকী ইউপিএ আমলে ছাড়পত্র পেয়ে যাওয়া প্রকল্পের কথাও রয়েছে।
বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বক্তব্য, এর আগে বিহার সফরে এসে ‘ডিএনএ’ এবং ‘বিমারু’ বলে দু’টি বিতর্ক তৈরি করে গিয়েছিলেন মোদী। সেই দুই অস্ত্র ব্যবহারে উঠেপড়ে লেগেছেন নীতীশ। কয়েক লক্ষ ডিএনএ-র নমুনাও জোগাড় হয়েছে। এ সব থেকে চোখ ঘুরিয়ে দিতে ‘ধামাকা’ দরকার ছিল মোদীর। এক লক্ষ ২৫ হাজার কোটি টাকার যে উপহার তিনি এ দিন দিলেন বিহারকে, তা এক অর্থে ধামাকাই। তবে ভোটের রাজনীতি করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী যে উন্নয়নের বদলে ভেটের দিকেই ঝুঁকে পড়লেন, তাও মেনে নিচ্ছে দল। এই সওয়া লক্ষ কোটি টাকার প্রকল্পে সড়ক, বিমানবন্দরের মতো কিছু পরিকাঠামোগত প্রকল্প রয়েছে ঠিকই, কিন্তু বিহারে উন্নয়নে গতি বাড়াতে শিল্পমহলের জন্য কোনও ছাড়ের ঘোষণা নেই। বরং ভোট-বালাইয়ের কথাই মনে পড়িয়ে দিচ্ছে এই বিপুল প্যাকেজ।
বিজেপি নেতাদের আরও বক্তব্য, লালু-নীতীশের জোট সামলানোও বড় চ্যালেঞ্জ মোদী। যেমন বড় পরীক্ষা বিহারের জাতপাতের রাজনীতিতে বিরোধী পক্ষকে পিছনে ফেলে দেওয়া। মোদী এবং অমিত শাহ ভাল ভাবেই জানেন, এটা তাঁদের লিটমাস টেস্ট। বিহারের নির্বাচনই ঠিক করে দেবে, দলে এই জুটির কর্তৃত্ব কতটা বজায় থাকবে। তার উপর সামনের বছর পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ুর মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে বিধানসভা ভোট। তার আগে নিজেদের জায়গা দলে নড়বড়ে হয়ে গেলে তো বিপদ।
সেটা বুঝেই এ দিন মোদীর যাবতীয় গোলাবর্ষণ। সরকারি মঞ্চ থেকে প্যাকেজ ঘোষণার পরে তিনি চলে আসেন কোশী অঞ্চলের সহরসাতে। লালু প্রসাদের দল আরজেডি এখানে যথেষ্ট প্রভাবশালী। গত লোকসভা নির্বাচনে এই এলাকা থেকেই তাঁর দলের চার সাংসদ জিতে এসেছেন। এই যাদবদুর্গেও প্রবল বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে মোদীর সভায় তখন লক্ষাধিক মানুষ। এটা রাজনৈতিক মঞ্চ। সুতরাং আক্রমণ শানালেন নিজের কৌশলমতো। কখনও তুললেন জঙ্গলরাজের প্রসঙ্গ, কখনও সাত বছর আগে বন্যা ত্রাণে মোদীর গুজরাতের দেওয়া পাঁচ কোটি টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার কথা। কখনও বললেন, ‘‘জয়প্রকাশ নারায়ণকে জেলে বন্ধ করে যারা অত্যাচার চালিয়েছিল, সেই কংগ্রেসের সঙ্গে আঁতাঁত করা হচ্ছে। জেপি-র হত্যাকারীদের ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল বিহার। সেই তাদেরই ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী ওঁরা (লালু-নীতীশ)।’’
প্যাকেজের খবর আগেই পেয়ে গিয়েছেন স্থানীয় মানুষ। তাঁদের দিকে লক্ষ করে মোদী বললেন, ‘‘আমাদের সঙ্গে থাকুন। বিহারের চেহারা আমরা বদলে দেব।’’ চিৎকার করে তাতেই যেন সায় দিল জনতা।
৩০ অগস্ট আনুষ্ঠানিক ভাবে ভোট-প্রচার শুরু করতে চাইছিলেন নীতীশরা। তাঁদের সভায় হাজির থাকতে পারেন সনিয়া বা রাহুল। সে দিনই আবার ভাগলপুরে মোদীর সভা। দ্রুত আসন রফা সেরে নিয়ে দুই জনতা নেতা ভেবেছিলেন, ৩০শে মোদীকে মহা-টক্কর দেবেন। কিন্তু খেলাটা ঘুরিয়ে দিলেন মোদী-ই। কারণ যা-ই হোক না কেন, তাঁর মঙ্গলবারের বিহার সফর লালু-নীতীশ এবং কংগ্রেসকে প্রথম ধাক্কাটা দিয়ে গেল। এর পরে এই প্যাকেজকে ‘ফাঁকা বুলি’ বলে প্রচার চালাবে এই জোট। কিন্তু তার পথ বন্ধ করতে রাতেই প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় থেকে ১ লক্ষ ২৫ হাজার কোটি টাকার কোন খাতে কত খরচ, সেই হিসেব দিয়ে দেওয়া হল।
অর্থাৎ, পয়লা বাজিতে এগিয়ে রইলেন মোদী। বিহারের রাজনীতিকরা বলছেন, নীতীশরা জবাবে নতুন কিছু দিতে পারেন কি না, এখন কিন্তু তার দিকেই তাকিয়ে বিহার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy