বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে মৃত পুলিশ ইনস্পেক্টর সুবোধ কুমার সিংহ। ছবি: পিটিআই।
২০১৫-র ২৮ সেপ্টেম্বর। উত্তরপ্রদেশের দাদরির বিসারা গ্রামে গুজব রটে যায়, মহম্মদ আখলাকের বাড়িতে গরুর মাংস রয়েছে। গ্রামের মানুষ হামলা চালায় আখলাকের বাড়িতে। গণপিটুনিতে মারা যান ৫২ বছরের আখলাক।
সেই রাতে পুলিশ জিপ নিয়ে সুবোধকুমার সিংহই প্রথম পৌঁছেছিলেন বিসারা গ্রামে। তিনিই জিপে করে আখলাক ও তাঁর ছেলে দানিশকে হাসপাতালে নিয়ে যান। দানিশ বেঁচে গেলেও আখলাক বাঁচেননি। ওই খুনের তদন্ত শুরু করেন সুবোধই। তিনিই আখলাক-খুনের প্রথম তদন্তকারী অফিসার। সেই হিসেবে ওই মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী।
সোমবার বুলন্দশহরে গোহত্যার গুজবের জেরে উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের তাণ্ডবে সেই সুবোধই খুন হয়ে যাওয়ার পরে প্রশ্ন উঠেছে, এর পিছনে কি কোনও ষড়যন্ত্র রয়েছে? সুবোধকে তাঁরই সার্ভিস পিস্তল দিয়ে গুলি করে মারা হয়েছে বলে পুলিশের অনুমান। আরও প্রশ্ন উঠেছে, আখলাক-খুনের মামলা ভেস্তে দিতেই কি পরিকল্পিত ভাবে তাণ্ডব বাধিয়ে সুবোধকে খুন করা হল?
আজ এই অভিযোগ তুলেছেন সুবোধেরই বোন। তাঁর দাবি, ‘‘দাদরির গোরক্ষক বাহিনীর হামলার তদন্ত করছিল বলেই আমার ভাইকে খুন করা হয়েছে। না-হলে ভাই পুলিশের গাড়িতে কেন একা থাকবে? অন্য অফিসার, চালক সুবোধকে ছেড়ে দিয়ে কেন চলে যাবে? আমি এর জবাব চাই। পুলিশও এই ষড়যন্ত্রে জড়িত।’’
আরও পড়ুন: ‘এ বার কার বাবার পালা?’ গো-রক্ষকদের হাতে পুলিশ অফিসারের মৃত্যুতে ছেলের প্রশ্ন
বেশি দিন অবশ্য আখলাক খুনের তদন্ত করতে পারেননি সুবোধ। দেড় মাসের মধ্যেই, ৯ নভেম্বর ওই তদন্ত থেকে তাঁকে সরিয়ে বদলি করে দেওয়া হয় বারাণসীতে। কিন্তু আইনজীবীদের বক্তব্য, আখলাক খুনের মামলার শুনানি শুরু হলে সুবোধ ওই মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হয়ে উঠতেন। সাধারণত যে কোনও খুনের মামলার শুনানিতেই তদন্তকারী অফিসারদের ডাক পড়ে। এ ক্ষেত্রে যে অফিসার তদন্ত শেষ করে চার্জশিট দায়ের করেছেন, তাঁরই ডাক পড়ত। কিন্তু সুবোধ যে-হেতু পুলিশকর্মীদের মধ্যে প্রথম ঘটনার দিন দাদরিতে গিয়েছিলেন, তাই শুনানির সময়ে তাঁরও ডাক পড়ত।
কারণ একাধিক। এক, তদন্তে নেমে আখলাকের বাড়ির ফ্রিজ থেকে সুবোধই নমুনা সংগ্রহ করে গ্রেটার নয়ডার পরীক্ষাগারে নিয়ে যান। যে মাংস ‘গোমাংস’ বলে অভিযোগ উঠেছিল, তা পাঁঠার মাংস বলে জানায় পরীক্ষাগার। পরে সেই নমুনা আবার মথুরার ইউনিভার্সিটি অব ভেটেরিনারি সায়েন্সে নিয়ে যাওয়া হয়। মথুরার পরীক্ষাগার রিপোর্ট দেয়, ও’টি গোমাংস।
দুই, পুলিশ সূত্রের বক্তব্য, আখলাকের মৃত্যুর পরেও সুবোধ নিয়মিত বিসারা গ্রামে গিয়ে গুজব ধামাচাপা দিয়ে শান্তি বজায় রাখার চেষ্টা করতেন। হিন্দু-মুসলমান, দুই সম্প্রদায়ের সঙ্গেই বৈঠক করেছিলেন তিনি। যাতে আর উত্তেজনা না ছড়ায়। ফলে কী ভাবে, কারা গ্রামে গুজব রটিয়েছিল, কী ভাবে আখলাকের বাড়িতে হামলা হয়েছিল, তা তাঁর জানা। আখলাকের ভাই জান মহম্মদ আজ সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘সুবোধই জিপে করে আখলাককে হাসপাতালে নিয়ে যান। তদন্তের সময়েও তিনি সংবেদনশীল ছিলেন।’’
নরেন্দ্র মোদী সরকারের জমানায় আখলাকের হত্যার পরেই দেশ জুড়ে অসহিষ্ণুতার অভিযোগ ওঠে। কিন্তু তিন বছর কাটলেও আখলাক-খুনে কারও শাস্তি হয়নি। সুবোধের পরেও আর এক জন তদন্তকারী অফিসার বদলি হয়েছেন। তৃতীয় তদন্তকারী অফিসার চার্জশিট দায়ের করেছেন। কিন্তু আদালতে এখনও চার্জ গঠন হয়নি। ১৮ জন অভিযুক্তের সকলেই জামিন পেয়ে গিয়েছেন। যাঁদের মধ্যে স্থানীয় বিজেপি নেতার আত্মীয়ও রয়েছেন। পুলিশ বলছে, আরও তথ্যপ্রমাণ দেওয়া বাকি। আখলাকের পরিবারের আইনজীবী ইউসুফ সাইফির অভিযোগ, ‘‘অভিযুক্তরা অভিযোগ থেকে রেহাই পেতে দ্রুত মামলার নিষ্পত্তি চান। এখানে অভিযুক্তরাই দেরি করেছেন।’’
সরব মমতা
বুলন্দশহরে গোহত্যার গুজব ঘিরে তাণ্ডবে খুন হয়েছেন পুলিশ অফিসার সুবোধকুমার সিংহ। ওই ঘটনা নিয়ে এ বার সরব হলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কারও নাম না করে মঙ্গলবার মেদিনীপুরে প্রশাসনিক বৈঠকে তিনি বলেন, ‘‘কাল দেখলাম একজন পুলিশ অফিসারকে খুন করা হয়েছে। তিনি একটা গণপিটুনির ঘটনায় তদন্ত করছিলেন।’’ পুলিশকে সতর্ক থাকতেও বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর বার্তা, ‘‘এখানেও পুলিশকে সতর্ক থাকতে হবে। আইসিদের সব নজরে রাখতে হবে।’’
নিজস্ব সংবাদদাতা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy