Advertisement
১৮ মে ২০২৪

ধর্মঘটের হুমকি, শ্রম সংস্কারে অনড় মোদী

জনা সাতেক কর্মীকে একজোট করেই আর শ্রমিক ইউনিয়ন খাড়া করে ফেলা চলবে না। একটি সংস্থায় একটিই মাত্র শ্রমিক ইউনিয়ন থাকবে। কোনও দাবিদাওয়া নিয়ে কর্তৃপক্ষ তাদের সঙ্গেই কথা বলবে। কারখানার বাইরে থেকে রাজনৈতিক নেতারা এসে গণ্ডগোল পাকাতেও পারবে না।

প্রেমাংশু চৌধুরী
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৫ ০৩:১৯
Share: Save:

জনা সাতেক কর্মীকে একজোট করেই আর শ্রমিক ইউনিয়ন খাড়া করে ফেলা চলবে না। একটি সংস্থায় একটিই মাত্র শ্রমিক ইউনিয়ন থাকবে। কোনও দাবিদাওয়া নিয়ে কর্তৃপক্ষ তাদের সঙ্গেই কথা বলবে। কারখানার বাইরে থেকে রাজনৈতিক নেতারা এসে গণ্ডগোল পাকাতেও পারবে না। নিয়ম মেনে চলতে হবে শ্রমিক ইউনিয়নগুলিকেও। নইলে তাদেরই অনুমোদন বাতিল হয়ে যাবে।

শিল্প সংস্থা ও কারখানায় এই ভাবেই শ্রমিক ইউনিয়নের ‘দাদাগিরি’ বন্ধ করতে চাইছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। সরকারের যুক্তি, এর ফলে কারখানায় উৎপাদন বাড়বে। মসৃণ হবে শিল্প ও বিনিয়োগের পথ। তৈরি হবে চাকরির সুযোগ। শ্রমিক সংগঠনগুলি যদিও একজোট হয়ে এ সব প্রস্তাবের বিরোধিতা করছে। তবে সরকারের দাবি, শ্রমিক-কর্মচারীদের স্বার্থের বিষয়টি মোটেই অবহেলা করা হচ্ছে না।

বহু দিন ধরেই শিল্পমহল ও বিনিয়োগকারীরা শ্রম আইন সংস্কার করে এর সরলীকরণের দাবি তুলছে। তাঁদের যুক্তি, কেন্দ্র ও রাজ্য মিলিয়ে এত রকম আইন রয়েছে যেগুলি ছোট শিল্প সংস্থা তো বটেই, বড় সংস্থাগুলির পক্ষেও মেনে চলতে অসুবিধা হয়। সব মিলিয়ে ব্যবসার উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। কোনও সংস্থা ক্ষতিতে চললেও বাড়তি কর্মীর বোঝা কমাতে পারে না। তাই শিল্পমহলের দাবি ছিল, শ্রম আইনের সংখ্যা কম হোক। এমন আইন তৈরি হোক, যা ছোট শিল্পপতি ও শ্রমিকদের বোধগম্য হয়।

এ বার সেই পথেই শ্রম আইনের আমূল সংস্কার করতে চাইছে মোদী সরকার। শ্রম মন্ত্রকের পরিকল্পনা হল, নানা রকমের শ্রম আইন মিশিয়ে দিয়ে বেতন, মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক, সামাজিক সুরক্ষা, শ্রমিকের নিরাপত্তা ও কল্যাণ— এই চারটি মূল বিষয়ে চারটি বিধি তৈরি হবে। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ আইনগুলিরও সংশোধন করা হবে। কারখানা আইন ও অ্যাপ্রেন্টিস আইনে সংশোধনের প্রস্তাব এনে আগেই বিল এসেছিল। আসন্ন বাদল অধিবেশনে আরও চারটি নতুন বিল আনতে চলেছে সরকার। বিরোধিতাও শুরু হয়ে গিয়েছে। ১১টি শ্রমিক সংগঠন আগেই ২ সেপ্টেম্বর সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। ধর্মঘটে শরিক সঙ্ঘ-পরিবারভুক্ত শ্রমিক সংগঠন বিএমএস-এর সাধারণ সম্পাদক ব্রিজেশ উপাধ্যায় বলেন, ‘‘শ্রমিকদের স্বার্থে আঘাত এলেই আমরা রুখে দাঁড়াব।’’

শ্রম আইনের কোথায় কোথায় গুরুত্বপূর্ণ বদল আনতে চাইছে মোদী সরকার?

এক, এখন কোনও সংস্থায় কর্মী সংখ্যা যা-ই হোক না কেন, সাত জনকে নিয়েই ইউনিয়ন তৈরি করা যায়। এ বার এ জন্য মোট কর্মী সংখ্যার ১০ শতাংশ বা অন্তত ১০০ জন কর্মী দরকার হবে। অভিযোগ, এতে ট্রেড ইউনিয়ন তৈরি করাই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

দুই, এখন একটি কারখানায় একাধিক ইউনিয়ন থাকে। কখনও তারা আলাদা ভাবে বা একজোট হয়ে মালিকের সঙ্গে কথা বলে। মালিকপক্ষকে সকলের সঙ্গেই আলোচনা করতে হয়। মোদী সরকারের ভাবনা হল, ভবিষ্যতে একটি কারখানায় একটিই স্বীকৃত শ্রমিক ইউনিয়নই থাকবে। তারাই শ্রমিকদের দাবিদাওয়া নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দর কষাকষি করবে।

তিন, কোনও সংস্থায় ৩০০ জন বা তার কম শ্রমিক থাকলে সরকারি অনুমোদন ছাড়াই ছাঁটাই করা যাবে। এখন ১০০ জনের সংস্থায় এই নিয়ম প্রযোজ্য।

চার, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, কোনও রাজনৈতিক দলের নেতা একই সঙ্গে একাধিক ট্রেড ইউনিয়নের শীর্ষপদে বসে রয়েছেন। নতুন নিয়মে সংস্থার কর্মী নন, এমন কেউ ইউনিয়নের পদে বসতে পারবেন না।

পাঁচ, কারখানায় অন্তত ৪০ জন শ্রমিক কাজ না করলে, সেগুলি শ্রম আইনের আওতায় আসবে না। শ্রমিক নেতাদের অভিযোগ, দেশের ৬৭ শতাংশ শ্রমিক এই ধরনের ছোট কারখানায় কাজ করে। সে ক্ষেত্রে তাদের জন্য শ্রম আইনের আর কোনও সুরক্ষা থাকবে না।

শ্রম মন্ত্রকের সচিব শঙ্কর অগ্রবাল বলেন, ‘‘সময়ের চাহিদা মেনে, শ্রমিকদের স্বার্থের জন্য এই সব সংস্কার করা হচ্ছে। কেননা, প্রতি মাসে ১ লক্ষ নতুন কর্মসংস্থান প্রয়োজন।’’ কিন্তু এআইটিইউসি-র সাধারণ সম্পাদক গুরুদাস দাশগুপ্তর অভিযোগ, ‘‘এক কথায় মোদী সরকার ট্রেড ইউনিয়ন শব্দটাই অভিধান থেকে তুলে দিতে চাইছে। সবটাই মালিকপক্ষের স্বার্থের কথা ভেবে, ইচ্ছেমতো ছাঁটাইয়ের ব্যবস্থা।’’ শ্রমমন্ত্রী বন্দারু দত্তাত্রেয়কে চিঠি লিখে সিটু-র সাধারণ সম্পাদক তপন সেন প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘শ্রম মন্ত্রক কি শ্রমিকদের ক্রীতদাস বানাতে চাইছে?’’

শ্রম মন্ত্রকের পাল্টা দাবি, শ্রমিকদের স্বার্থও দেখা হচ্ছে। এত দিন ইউনিয়নগুলি নিজেদের নথিবদ্ধ করতে পারত। কিন্তু ইউনিয়নকে স্বীকৃতি দিতে সংস্থার কর্তৃপক্ষের বাধ্যবাধকতা ছিল না। এই দাবিতেই চার বছর আগে হরিয়ানার মানেসরে মারুতি সুজুকি কারখানাতে ১৩ দিন ধর্মঘট হয়েছিল। এখন যে ইউনিয়নের পিছনে সব থেকে বেশি কর্মীর সমর্থন থাকবে, তারাই স্বীকৃতি পাবে। কিন্তু তাদেরও নিয়ম নেনে চলতে হবে। অধিকাংশ ইউনিয়নে বছরের পর বছর কোনও ভোট হয় না। আয়ব্যয়ের হিসেব পেশ হয় না। ভুল তথ্য দিয়ে ইউনিয়নগুলি নাম নথিবদ্ধ করায়। এ বার এই সব নিয়ম মানা না হলে ইউনিয়নগুলির রেজিস্ট্রেশন বাতিল হয়ে যাবে।

শিল্পমহলের দাবি ছিল, ছাঁটাইয়ের আইনি জটিলতা কাটানো হোক। একই সঙ্গে শ্রমিকদের জন্য বাড়তি ক্ষতিপূরণেরও বন্দোবস্ত করা যেতে পারে। বণিক সংগঠন সিআইআই-এর সভাপতি সুমিত মজুমদার সরকারের কাছে প্রস্তাব রেখেছিলেন, ‘‘শ্রম আইনগুলি এক সঙ্গে মিশিয়ে সরলীকরণ করা হোক। যাতে আইন মানা সহজ হয়। এর ফলে কারখানায় নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে।’’

শ্রম মন্ত্রকের যুক্তি, ছাঁটাই হওয়া কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে যাতে নতুন করে নিয়োগের উপযোগী করে তোলা যায়, সে জন্য একটি তহবিল তৈরি হবে। তা ছাড়া শুধু শ্রমিকদের স্বার্থেই বিভিন্ন আইনে এক গুচ্ছ সংশোধন হবে। এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ট ফান্ড আইনে সংশোধন করে যে সব কারখানায় ১০ জন শ্রমিক কাজ করে, সেখানেও এই আইন বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। এখন ২০ জন কর্মী হলে আইন প্রযোজ্য হয়। এ ছাড়া, সর্বাধিক বোনাসের পরিমাণ ৩,৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬ হাজার টাকা করার প্রস্তাব রয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE