Advertisement
E-Paper

সংস্কার নিয়ে ভিন্ন সুরে মোদী যেন সেই সনিয়াই

সংস্কারের রথের ঘোড়া ছোটানোর আশ্বাস দিয়ে ক্ষমতায় আসা নরেন্দ্র মোদী ১৭ মাসে করলেনটা কী— প্রশ্নটা ক্রমেই জোরালো হচ্ছে দেশে-বিদেশে। সেই সমালোচনার মুখে আজ আত্মপক্ষ সমর্থনের ভঙ্গিতে সংস্কার নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করলেন প্রধানমন্ত্রী।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০১৫ ০৩:৪৪

সংস্কারের রথের ঘোড়া ছোটানোর আশ্বাস দিয়ে ক্ষমতায় আসা নরেন্দ্র মোদী ১৭ মাসে করলেনটা কী— প্রশ্নটা ক্রমেই জোরালো হচ্ছে দেশে-বিদেশে। সেই সমালোচনার মুখে আজ আত্মপক্ষ সমর্থনের ভঙ্গিতে সংস্কার নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করলেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর মতে, সংস্কার কোনও স্বল্প পাল্লার দৌড় নয়, ম্যারাথন। যার অর্থ, শিল্পমহল যতই অধৈর্য হোক, এক ঝটকায় বড় মাপের সংস্কার তিনি করবেন না। শুধু তা-ই নয়, ভবিষ্যতে সুদিনের আশায় এখন আমজনতাকে তেতো বড়ি গেলানোর যে প্রয়োজনীয়তার কথা অর্থনীতিবিদদের বড় অংশ বলে থাকেন, তার সঙ্গেও এ দিন দ্বিমত পোষণ করেছেন মোদী। তাঁর বক্তব্য, সংস্কারের উদ্দেশ্য জিডিপির হার বৃদ্ধি নয়, সমাজে পরিবর্তন আনা। গরিবদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা। আর সেই কাজটাই করতে চায় তাঁর সরকার।

আজ দিল্লি ইকনমিক্স কনক্লেভে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা শোনার পরে সংশ্লিষ্ট মহলের মন্তব্য, ১৭ মাসেই বদলে গিয়েছেন মোদী। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে যিনি সংস্কারের দাবিতে সরব ছিলেন, আর্থিক বৃদ্ধিকেই দারিদ্র দূরীকরণের অন্যতম হাতিয়ার বলে মনে করতেন, কর্মসংস্থানের অভাবে অধৈর্য তরুণ প্রজন্মকে শান্ত করতে দ্রুত অর্থনীতির হাল ফেরানোর কথা বলতেন, তিনিই আজ আমজনতার মনোরঞ্জনে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষপাতী। মোদীর গলায় আজ যেন সনিয়া গাঁধীর সুর! ইউপিএ-র দশ বছরে আমআদমির হাল ফেরাতে একাধিক সামজিক প্রকল্প চালু করার জন্য মনমোহন সিংহের উপরে লাগাতার চাপ সৃষ্টি করে গিয়েছেন কংগ্রেস সভানেত্রী। এহেন দান-খয়রাতিতে অর্থনীতির স্থায়ী লাভ হয় না বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত প্রকাশ করা সত্ত্বেও ভোটের রাজনীতির টানে সেই পথেই হেঁটেছে কংগ্রেস। আর ইউপিএ-র দ্বিতীয় ইনিংসে তো যাবতীয় সংস্কার কার্যত বন্ধই হয়ে গিয়েছিল।

সেই অচলাবস্থা থেকে বেরনোর আশা জাগিয়ে ক্ষমতায় এলেও এত দিনে জিএসটি থেকে জমি বিল, কার্যত কোনও ক্ষেত্রেই কিছু করে উঠতে পারেননি মোদী। আর আজ তাঁর বক্তৃতা শোনার পরে শিল্পমহল বলছে, এমন কথা তো সনিয়াদের গলাতেই শোনা যেত! বস্তুত, ইউপিএ নেতৃত্ব যে ভাবে অর্থনীতিবিদদের সমালোচনা ওড়াতেই প্রায় সেই ধাঁচেই সংস্কারের ধীর গতিকে সমর্থন করে মোদী বলেছেন, ‘‘বিশেষজ্ঞদের মন জয় করা বা তাত্ত্বিক আলোচনায় নম্বর পাওয়াটা কোনও দেশের লক্ষ্য হতে পারে না।’’

প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পরে ব্যবসা-বাণিজ্যের অনুকূল পরিবেশ তৈরির মাপকাঠিতে বিশ্বব্যাঙ্কের তালিকায় প্রথম একশোয় ঠাঁই করে নেওয়াকে নিশানা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন মোদী। সেই মোদীই আজ জানিয়েছেন— কোনও আন্তর্জাতিক তালিকায় স্থান দখল করা তাঁর লক্ষ্য নয়। ক্ষমতায় এসে আমূল সংস্কারের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন মোদী। যোজনা কমিশন তুলে দিয়ে প্রথা ভাঙা পথে এগোনোর আশা জাগিয়েছিলেন। কিন্তু তার পরে আর সাহসী সংস্কারের নমুনা মেলেনি। উল্টে গোমাংস-দলিত খুন-ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ঘিরে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। যে বিতর্কের ধাক্কায় অর্থনৈতিক সংস্কারের কর্মসূচিও বেলাইন হয়ে যেতে পারে বলে সতর্কবার্তা শোনাচ্ছে আন্তর্জাতিক আর্থিক বিশ্লেষক সংস্থা। কারণ অসহিষ্ণুতা ঘিরে বিরোধীদের সঙ্গে অবাঞ্ছিত বিবাদে জিএসটি নিয়ে ঐকমত্য তৈরি বা সংসদ সচল রাখাটা কঠিন হয়ে উঠতে পারে। লগ্নিকারীরাও ভারতে বিনিয়োগ থেকে সরে যেতে পারেন।

এই প্রেক্ষিতে আজ ‘দিল্লি ইকনমিক্স কনক্লেভ’-এর মঞ্চে নজর ছিল শিল্পমহলের। আশার সঞ্চার হয়েছিল, বোধ হয় সংস্কারের রথ ছোটানোর দিশা দেখাবেন মোদী। উল্টে মোদী বলেছেন, অর্থনীতির হাল ফেরানোটা হাত ঘোরালেই হয় না। এটা দূরপাল্লার ম্যারাথন দৌড়, ১০০ মিটারের স্প্রিন্ট নয়। আর চোখে না-পড়া আর্থিক সংস্কার নিয়ে কী তাঁর মত? মোদীর ঘোষণা— তাঁর আর্থিক সংস্কারের লক্ষ্য সংবাদপত্রে শিরোনাম তৈরি করা নয়। শুধুমাত্র আর্থিক বৃদ্ধির হার বাড়ানোও সংস্কার হতে পারে না।

তা হলে লক্ষ্যটা কী? কীসের জন্য সংস্কার? মোদী বলছেন, ‘‘সমাজ পরিবর্তনের জন্য। সমস্ত নাগরিক, বিশেষ করে গরিবদের জীবনযাত্রার উন্নতিতে যা সাহায্য করে, তা-ই সংস্কার।’’ বিশেষজ্ঞদের মন জয়ের থেকে তিনি যে জনগণেশকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন, তা স্পষ্ট করে মোদী বলেন, ‘‘আমি বিশ্বাস করি এ দেশের মানুষ চেয়ারে বসে থাকা সমালোচক-বিশেষজ্ঞদের থেকে অনেক বেশি পরিণত।’’

কিন্তু কেন এই উল্টো সুর প্রধানমন্ত্রীর গলায়? রাজনীতিকরা মনে করছেন, দিল্লির ভোটে হারের পরে বিহার ভোটের ফলাফলকে গত ১৭ মাসে মোদী সরকারের কাজের মূল্যায়ন হিসেবেও দেখা হবে। যে ফলাফল নিয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত নয় বিজেপি নেতৃত্ব। এ দিকে রাজ্যসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাব নিয়েও মোদী সরকারের দুশ্চিন্তা যাচ্ছে না। কারণ জমি বিল হোক বা জিএসটি— লোকসভায় হই হই করে পাশ হলেও রাজ্যসভায় এসে তা আটকে যাচ্ছে। বিহারের মতো বড় রাজ্যে জয়রথ ছুটিয়ে রাজ্যসভায় সদস্য বাড়ানোরও লক্ষ্য ছিল বিজেপি নেতৃত্বের।
এ জন্য তাই শিল্পমহলের থেকেও এখন আমজনতার মন জয়ের চেষ্টাই মোদীর অগ্রাধিকার বলে অনেকে মনে করছেন।

আজ তাই গত ১৭ মাসে তাঁর সরকার কী কী কাজ করেছে, তার খতিয়ান শুনিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার জন্য নির্ধারিত আধ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও সেই খতিয়ানের তালিকা শেষ হয়নি। সেই তালিকায় সকলের জন্য ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বা সকলের জন্য আবাসনের কথাই বার বার ফিরে এসেছে। মোদী বলেছেন, রিজার্ভব্যাঙ্কের সুদের হার কমানো নিয়ে এত আলোচনা হয়। যাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টই নেই, তাদের সুদ না কমলে কী এসে যায়! অর্থনীতির হাল নিয়ে মোদীর একটাই দাবি, ‘‘১৭ মাস আগে আমরা যখন ক্ষমতায় এসেছিলাম, তার তুলনায় যে কোনও মাপকাঠিতেই এখন অর্থনীতির হাল অনেক ভাল।’’ কিন্তু আগামী ১৭ মাসে বা তাঁর সরকারের বাকি ৪৩ মাসে তিনি কোন পথে হাঁটবেন, সে বিষয়ে একটি শব্দও শোনা যায়নি।

মোদীর এই বক্তৃতার পরে তাঁর সরকারের মন্ত্রীরা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, সংস্কারের কাজটা মুখে বলা যতটা সহজ, তা করে ফেলা ততটাই কঠিন। কেবল শিল্পমহলের নয়, সকলের সমস্যার কথাই ভাবতে হয়। ভোটব্যাঙ্কের কোনও অংশে ভুল বার্তা যাচ্ছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখতে হয়। কিন্তু অর্থনীতিবিদ বা শিল্পমহলের একটা বড় অংশ এর সঙ্গে একমত নন। তাঁদের যুক্তি হল, সাহসী সংস্কারের কাজ এক ঝটকাতেই করতে হয়। ধাপে ধাপে হিসেব কষে তা হয় না। ঝটকায় সংস্কারের আশা মোদী নিজেই তৈরি করেছিলেন। এখন তিনি নিজেই উল্টো সুর গাইছেন।

economic reform issue resemblances sonia gandhi narendra modi
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy