Advertisement
০৯ মে ২০২৪

গর্বিত ছাত্র ছিলাম স্কুলের, এখন শিক্ষক

স্বাধীনতা তখনও অর্ধ-দশক দূরে। ভেপার ল্যাম্প তো দূরের কথা, নিয়নের আলোতে তখনও ঝলমল করে ওঠেনি শিলচর। সেই সময় শিলচরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অম্বিকাপুর এমই স্কুল, আজ যার নাম অধরচাঁদ উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়।

গৌরব। শিলচর শহরের অধরচাঁদ উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয় ভবন। আগে তার নাম ছিল অম্বিকাপুর এমই স্কুল। ছবি: নিজস্ব চিত্র

গৌরব। শিলচর শহরের অধরচাঁদ উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয় ভবন। আগে তার নাম ছিল অম্বিকাপুর এমই স্কুল। ছবি: নিজস্ব চিত্র

দীপক সেনগুপ্ত
শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০১৭ ০৩:০৫
Share: Save:

স্বাধীনতা তখনও অর্ধ-দশক দূরে। ভেপার ল্যাম্প তো দূরের কথা, নিয়নের আলোতে তখনও ঝলমল করে ওঠেনি শিলচর। সেই সময় শিলচরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অম্বিকাপুর এমই স্কুল, আজ যার নাম অধরচাঁদ উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়।

সেটা ১৯৪০ সাল। ব্যক্তিগত উদ্যোগ, সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং শিক্ষার প্রতি অনুরাগে কয়েকজন বিশিষ্ঠ ব্যক্তি এক জায়গায় মিলিত হয়ে এই স্কুলের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তখন না ছিল সরকারি অনুদান, না ছিল আজকের মতো ফি আদায়ের ব্যবস্থা। পরবর্তী সময়ে সরকার ১০ টাকা অনুদানের ব্যবস্থা করে। ফলে স্কুলের নাম হয় অম্বিকাপুর গভর্নমেন্ট এডেড এমই স্কুল। ১৯৫১ সালে এই স্কুলের ছাত্ররা প্রথম এন্ট্রান্স বা প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসে। প্রথম বছরেই পাশের হার একশো শতাংশ। ছাত্ররা এসে ভর্তির জন্য ভিড় করতে থাকে। কিন্তু পরিকাঠামো নেই। উদ্ভুত পরিস্থিতি সামাল দিতে পরিচালন সমিতি প্রতিষ্ঠিত বস্ত্র ব্যবসায়ী অধীরচন্দ্র রায় ও সুধীরচন্দ্র রায়ের দ্বারস্থ হন। দুই ভাই স্কুলের জন্য ২৫ হাজার টাকা দান করেন। ১৯৫৬ সালে তাঁদের বাবার নাম যুক্ত করে স্কুলের নতুন পরিচয় হয় ‘অধরচাঁদ হাই স্কুল’। ১৯৭৭ সালে স্কুলটি সরকারের পূর্ণ অনুদান পায়। শিক্ষকদের বেতন বাড়ে, চাকরির নিরাপত্তা বাড়ে। ১৯৮৫ সালে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যায়ে উন্নীত করে খোলা হয় বিজ্ঞান শাখা।

আমার স্কুলের বহু ছাত্র শুধু জাতীয় নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও নিজ নিজ ক্ষেত্রে খ্যাতি অর্জন করেছেন। অনন্য দাশ ১৯৭৮ সালের ম্যাট্রিক পরীক্ষার মেধা তালিকায় স্থান পান। পরে চিকিৎসক হিসেবে আমেরিকার রাষ্ট্রপতির স্বাস্থ্য উপদেষ্টা হন। প্রকাশ সূত্রধর এই বিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে মুম্বই আইআইটি-তে পড়তে যান। এখন এনটিপিসি-র উচ্চপদে কর্মরত রয়েছেন।

আমি এই প্রতিষ্ঠানের গর্বিত প্রাক্তনী। আবার কর্মসূত্রে ৩১ বছর ধরে রয়েছি এই স্কুলেই। সব মিলিয়ে অধরচাঁদ স্কুলের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা ৩৯ বছরের। আমাদের সময়ে স্কুলে কোনও শিক্ষয়িত্রী ছিলেন না। শিক্ষকরা সবাই ধুতি-পাঞ্জাবী পরতেন। সৌম্যদর্শন গম্ভীর মুখের ভিতরে লুকনো থাকত নরম মানুষ। তার মধ্যে ‘কিংবদন্তি’ শিক্ষক হিসেবে এক নম্বরে উল্লেখ করতে হয় প্রভাসরঞ্জন ভট্টাচার্যের কথা। এই নামের সঙ্গে এতটা ভয় মিশ্রিত রয়েছে যে, কোনও হলিউডের ‘হরর’ সিনেমাকেও তা হার মানাবে। আবার শ্রদ্ধাও রয়েছে ততটাই। এক অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব। হুঙ্কারে কেঁপে উঠত পুরো স্কুল। কিন্তু প্রভাস স্যারকে খেলার মাঠে দেখেছি সরল শিশুর মতো। তাঁর কাছে সহজেই আব্দার করা যেত। স্কুল টুর্নামেন্ট জয়ের আনন্দে কাসর-ঘণ্টা বাজিয়ে ভেসে যাওয়ার উদ্দামতায় স্যার আমাদের নেতৃত্ব দিতেন। স্যারকে নিয়ে অনেক মিথ ছিল। গলায় ছিল দগদগে দাগ। কেউ কেউ বলত, স্যারকে নাকি কেউ ঘোড়া দিয়ে আক্রমণ করেছিল। এটা নাকি তারই চিহ্ন।

এ বার আসা যাক সুবোধ পালের কথায়। স্যার আমাদের ইংরেজি পড়াতেন। দশম শ্রেণিতে ‘ডিস্কভারি অব রেডিয়াম’ বলে একটি পাঠ ছিল। সেখানে একটি শব্দ ছিল ‘ক্রিস্ট্যাল’। স্যার প্রথম ক্লাশে এই শব্দের সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেননি। বলে গেলেন, পরের ক্লাশে বুঝিয়ে বলবেন। জেনেছি, সে রাত স্যার ঘুমোননি। পরের ক্লাশে ‘ক্রিস্ট্যাল’ বোঝাতে গিয়ে যে ক্লাশ নিলেন, সেটা ইংরেজি নয়, কেমিস্ট্রির ক্লাশ। আমি স্নাতক শ্রেণি পর্যন্ত রসায়ন নিয়ে পড়েছি, স্যারের সেদিনের পড়ানো আজও আমাকে শিহরিত করে।

গুরুপদ সেন ছিলেন প্রচণ্ড রাগী। ছাত্ররা ডাকতেন দুর্বাশা মুনি বলে। আবার কোনও কোনও মুহূর্তে ছিলেন শিশুর মত সরল। চরিত্রের এই বৈপরীত্যের খাঁজে খাঁজে ছিল আবেগ ভালবাসা। আগেকার দিনে এমবিবিএস ডাক্তাররা যেমন সব রোগের চিকিৎসা করতেন, তেমনই ছিলেন শিক্ষকরাও। সত্যব্রত দে স্যার সমান পারদর্শিতা নিয়ে আমাদের ইংরেজি ও বাংলা পড়াতেন। স্বরূপানন্দের ভাবশিষ্য প্রয়াত মহীতোষ স্যার ইউরোপীয় রেনেসাঁ আন্দোলন পড়াতে গিয়ে চরিত্র গঠন আন্দোলনের কাজ করতেন। আমাদের মনে এখনও তা জ্বলজ্বলে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

student Teacher
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE