Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

দাউদ চাই, দিল্লির চাপে কথায় রাজি পাক

দাউদ ইব্রাহিমকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের কাছে আবেদন জানাল নরেন্দ্র মোদী সরকার। মুম্বই বিস্ফোরণের মূল চক্রী দাউদকে প্রত্যর্পণের বিষয়ে ইতিমধ্যেই দু’দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার মধ্যে একপ্রস্ত আলোচনা হয়েছে। তবে গোটা বিষয়টাই রয়েছে ব্যাক চ্যানেল কূটনৈতিক স্তরে। নেপথ্যের এই প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত সাফল্য আসবে কি না, বা এলেও কবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

জয়ন্ত ঘোষাল
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৩ জুলাই ২০১৫ ০৩:২৩
Share: Save:

দাউদ ইব্রাহিমকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের কাছে আবেদন জানাল নরেন্দ্র মোদী সরকার।

মুম্বই বিস্ফোরণের মূল চক্রী দাউদকে প্রত্যর্পণের বিষয়ে ইতিমধ্যেই দু’দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার মধ্যে একপ্রস্ত আলোচনা হয়েছে। তবে গোটা বিষয়টাই রয়েছে ব্যাক চ্যানেল কূটনৈতিক স্তরে। নেপথ্যের এই প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত সাফল্য আসবে কি না, বা এলেও কবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তবে দাউদ প্রশ্নে দু’দেশের মধ্যে যে আলোচনা শুরু হয়েছে, সেটাকেই মোদী সরকারের বড় মাপের সাফল্য বলে মনে করছে কূটনৈতিক শিবির।

রাশিয়ার উফায় দু’দেশের প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাস প্রশ্নে এক জোটে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিলেও ওই বৈঠকের আগে থেকেই সীমান্তে উত্তেজনা শুরু হয়ে গিয়েছে। উফায় দুই প্রধানমন্ত্রীর যৌথ বিবৃতির পরেও তা কমেনি! চলছে লাগাতার গুলিবর্ষণও। এই অস্থিরতার মধ্যে সরকারি ভাবে দু’পক্ষের আমলা স্তরে বৈঠক হবে কিনা, তা নিয়ে একাধিক মহল প্রশ্ন তুললেও মোদী সরকার কিন্তু দাউদকে এ দেশের আদালতে তুলতে বদ্ধপরিকর। রাজনৈতিক ভাবে বিজেপিও জানে, দাউদকে ভারতের মাটিতে ফেরাতে পারলে, সেটা মোদী সরকারের সব থেকে বড় সাফল্য বলে গণ্য হবে। যার সুফল পাওয়া যাবে ভোটের রাজনীতিতে।

১৯৯৩ সালের মার্চে মুম্বই বিস্ফোরণের পর থেকেই পাকিস্তানে রয়েছে দাউদ এবং তখন থেকেই বিভিন্ন বৈঠকে এই জঙ্গিকে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য ইসলামাবাদের কাছে দাবি জানিয়ে আসছে দিল্লি। দাউদের পাশাপাশি মুম্বই বিস্ফোরণের আরও একাধিক অভিযুক্ত পাকিস্তানে রয়েছে বলে দীর্ঘদিন ধরেই জানিয়ে আসছেন গোয়েন্দারা। তাদেরও হাতে চেয়ে ইসলামাবাদকে চাপ দিয়েছে দিল্লি। পরে ওই তালিকায় নাম জুড়েছে জাকিউর রহমান লকভি, হাফিজ সইদ-সহ আরও প্রায় দু’ডজন জঙ্গির। কিন্তু কারও ব্যাপারেই ইতিবাচক সাড়া দেয়নি ইসলামাবাদ। দিল্লির বক্তব্য, লকভি ও হাফিজ সইদের প্রত্যর্পণের ব্যাপারে পাকিস্তানের আপত্তি থাকতেও পারে। কারণ তারা দু’জনেই পাক নাগরিক। কিন্তু দাউদের ক্ষেত্রে সেই যুক্তি ধোপে টিকবে না। দাউদ ভারতেরই নাগরিক, যে পাকিস্তানে গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে। তবে একটা কাঁটাও আছে। তা হল, ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের কোনও প্রত্যর্পণ চুক্তি নেই। ফলে চাইলে‌ও দাউদকে হাতে পাওয়া সহজ হবে না। তবে ভারতের বক্তব্য, সন্ত্রাস দমনের ব্যাপারে তারা যে আন্তরিক, তার প্রমাণ দিতেই পাকিস্তানের উচিত দাউদকে ফেরত পাঠানো এবং এ জন্য প্রত্যর্পণ চুক্তি না থাকাটা কোনও বাধা হতে পারে না।

ভারতের লাগাতার চাপের মুখে অবশেষে খানিকটা নরম হয়েছে পাকিস্তান। দাউদের প্রত্যর্পণ নিয়ে কূটনৈতিক ব্যাক চ্যানেলে আলোচনায় রাজি হওয়াটা তেমনই ইঙ্গিতবাহী বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত কী করবে, তা নিয়ে ভারতীয় গোয়েন্দাদের সংশয় রয়েছে পুরো মাত্রায়। তাই দাউদের বিরুদ্ধে সব দিক থেকে জাল গোটানোর কাজ চলছে। এ দেশে থাকা দাউদের যাবতীয় সম্পত্তি আগেই বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। এ বার তাঁর বেনামী সম্পত্তি চিহ্নিতকরণের কাজ শুরু হয়েছে। পাশাপাশি দেশের বাইরেও দাউদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার চেষ্টা চলছে জোর কদমে।

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্র জানাচ্ছে, গত কয়েক বছরে দুবাই ও পাকিস্তানের গণ্ডি ছাড়িয়ে মরক্কো, তুরস্ক এমনকী ব্রিটেনেও বিভিন্ন ব্যবসায় অর্থ লাগিয়েছে দাউদ। হোটেল ব্যবসা ছাড়াও রিয়েল এস্টেটেও বড় মাপের অর্থ বিনিয়োগ করেছেন তিনি। গোয়েন্দাদের হিসেব, এই বিনিয়োগের পরিমাণ দুই থেকে চার হাজার কোটি টাকা! তবে দাউদ গোটা অর্থটাই লাগিয়েছেন বেনামে। কার মাধ্যমে ওই টাকা লাগানো হয়েছে, তা খতিয়ে দেখতে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) চার জনের একটি প্রতিনিধি দল মরক্কো যাচ্ছে। প্রয়োজন পড়লে তুরস্ক এবং ব্রিটেনেও যাবে দলটি।

এর আগে এনডিএ জমানাতেও দাউদকে দেশে ফেরাতে উদ্যোগী হয়েছিল তৎকালীন অটলবিহারী বাজপেয়ীর সরকার। আইনজীবী রাম জেঠমলানীর মধ্যস্থতায় দাউদ শর্ত দিয়েছিলেন, তিনি ভারতে ফিরতে রাজি আছেন। কিন্তু তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যাবে না। ওই প্রস্তাবে সে সময়ে রাজি হয়নি ভারত। ফলে ভেস্তে যায় দাউদের প্রত্যর্পণ।

আগরা বৈঠকের সময়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আডবাণী তৎকালীন পাক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশারফের কাছে দাউদকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছিলেন। কিন্তু মুশারফ স্পষ্ট জানিয়ে দেন, দাউদ পাকিস্তানে নেই। সে সময়ে গোয়েন্দাপ্রধান ছিলেন কে পি সিংহ। আডবাণী বৈঠক শেষে কে পি সিংহের কাছে দাউদের অবস্থান জানতে চাইলে গোয়েন্দাপ্রধান তাঁকে জানান, মুশারফ সত্যি কথাই বলেছেন। বৈঠকের সময়ে দাউদকে দুবাই পাঠিয়ে দিয়েছিল পাক প্রশাসন। তবে ভারতীয় গোয়েন্দাদের দাবি, ২০০৪ সালের পর দাউদের নামে রেড কর্নার নোটিস জারি করে ইন্টারপোল। ফলে দাউদের পক্ষে অন্য দেশে চট করে পালিয়ে যাওয়া আগের চেয়ে অনেক কঠিন।

মোদী ক্ষমতায় আসার পর কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের একাংশের দাবি ছিল, আমেরিকা গোপন অপারেশন করে পাকিস্তানে ঘাঁটি গেড়ে থাকা ওসামা বিন লাদেনকে যে ভাবে নিকেশ করেছিল, দাউদের ক্ষেত্রে ভারতও তেমন অপারেশন করুক। কিন্তু তাতে ভারত-পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই দাউদকে ফেরাতে এখন ব্যাক চ্যানেল কূটনীতির উপর জোর দিতে চাইছে ভারত।

তবে দিল্লি খুব ভাল করেই জানে, পাক প্রশাসন আলোচনায় বসতে রাজি হয়েছে এর মানে এই নয় যে, দাউদ ভারতের হাতে চলে আসবেই। কেন না, পাকিস্তানের নওয়াজ প্রশাসন এ নিয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপ করলেও সে দেশে রয়েছে একাধিক ক্ষমতার কেন্দ্র।

সেনাবাহিনীর একাংশ, পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই বা কট্টর মোল্লাতন্ত্র বরাবরই ভারত-বিরোধী। তারা কোনও দিন দাউদকে ভারতের হাতে তুলে দিতে সম্মত হবে না। ফলে কট্টরবাদীদের চাপ এড়িয়ে নওয়াজ প্রশাসন আদৌ এ বিষয়ে কতটা ইতিবাচক পদক্ষেপ করতে পারবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয়ে রয়েছে দিল্লি।

আগরা বৈঠকের সময়ে তৎকালীন গোয়েন্দাপ্রধান কে পি সিংহের ডেপুটি ছিলেন বর্তমান জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল। দাউদ প্রশ্নে আলোচনার পরিস্থিতি তৈরি হলেও শেষ পর্যন্ত তাঁকে হাতে পাওয়া যে যথেষ্ট কঠিন, তা বিলক্ষণ জানেন তিনি। তাই আপাতত আটঘাট বেঁধেই এগোতে চাইছে ভারত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE